আজকের শিরোনাম :

না ফেরার দেশে হাসান জামিল সাত্তার

  দুলাল আচার্য

০২ জুলাই ২০২০, ১২:১০ | আপডেট : ০২ জুলাই ২০২০, ১২:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

না ফেরার দেশে চলে গেলেন শত-সহস্র কর্মীর প্রিয় ‘দাদা’ হাসান জামিল সাত্তার। ভক্তদের কাছে রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ তিনি। দাউদকান্দির রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে সজ্জনব্যক্তি। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) মহামারী করোনাভাইরাসের কাছে হার মানেন, নীতির প্রশ্নে হার না মানা এই রাজনীতিক।
হাসান জামিল সাত্তার কুমিল্লার ময়নামতি টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ছিলেন যুক্ত। ছিলেন কেন্দ্রীয় বঙ্গমাতা পরিষদের উপদেষ্টা। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার  মোশাররফ হোসেন, রাজনীতিবিদ বাদল রায় ও দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী সুমনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।
হাসান জামিল সাত্তার রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বাবা বিশিষ্ট সমাজসেবক ও দানবীর আবদুস সামাদ সরকার মুসলিম লীগের রাজনীতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ছিলেন। দলের নীতি ও আদর্শের কারণে সামাদ সরকার বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজের প্রকাশ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি। শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে তিনি এবং তার পরিবার বহু মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও সংখ্যালঘু পরিবারকে নানাভাবে জীবনরক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর দাউদকান্দির হাসানপুরে শহীদ নজরুলের নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম এখন হাসানপুর শহীদ নজরুল সরকারী ডিগ্রি কলেজ। আমি গর্বিত এই কারণে শহীদ নজরুল আমার গ্রামের বীর সন্তান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ নজরুল ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন এবং ’৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি শহীদ হন।  
সাত্তার সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৮৮ সালে হাসানপুর কলেজে। আমি তখন ওই কলেজের ছাত্র। তারিখটা মনে নেই, এক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা ও সদ্য বিদায়ী কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আউয়াল সরকার উপস্থিত ছিলেন। বহু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে হাসান জামিল সাহেব বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে এক পর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রশংসা করে তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রামী জীবনের নানা দিকের আলোচনা আমাদের আবেগময় করে তুলেছিল। বক্তব্য শোনার পর আমি ভেবেছিলাম তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। পরে জেনেছি তখনও তিনি সরাসরি কোন দলীয় রাজনীতিতে আসেননি। 
হাসান জামিল সাত্তার দাউদকান্দি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং বেহাল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন। সেবার জনমত জরিপে হাসান জামিল সাত্তার বিজয়ের কাছাকাছি ছিলেন। কথিত আছে, আগেই এই আসনে ফলাফল নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের দিন প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূইয়া এবং পরে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ সকল দল নির্বাচন বর্জন করে। 
২০০৩ সালে ৪ এপ্রিল মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূইয়া জুরানপুরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুল দিয়ে দলে যোগদান করেন। সেই যোগদান অনুষ্ঠানে হাসান জামিল সাত্তারও নেত্রীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। তারপর তাকে দাউদকান্দির প্রকাশ্য রাজনীতিতে দেখা যায়নি। স্থানীয় রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রীয় হয়ে যান তিনি। তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ছোঁয়া রাজনীতিপাগল এই মানুষটিকে রাজপথে নামিয়ে আনে। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি বঙ্গমাতা পরিষদের ব্যানারে হরতাল-মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার দিনও দলের মিছিলপূর্ব সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শুনেছি, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও চেতনায় আওয়ামীধারার ছিলেন অনেক আগে থেকেই।
আমি এই লেখায় তার সঙ্গে দুটি স্মৃতিময় ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগের কথা। নেত্রী তখন মুক্ত। আমি সাংবাদিকতার পাশাপাশি মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূইয়ার প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছিলাম। অফিস শেষে তাঁর মহাখালীর ডিওএইচএস-এর বাসায় কাজ করি। দাউদকান্দির ছোট ভাই ছাত্রলীগের রুবেল (সাহাপাড়া) সন্ধ্যায় মহাখালীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে বললো দাদা চলেন একজনের বাসায় যাব। আমি বললাম কোথায়? কার বাসায়? বললো চলেন না। সেদিন কাজ ছিল না তাই বেরিয়ে পরলাম। বনানীর একটি গলিতে ঢোকার মুখে বললাম, রুবেল কার বাসায় যাব বল্লে নাতো। সে বললো, সাত্তার সাহেবের বাসায়। আমি রিকসা থামালাম, বললাম রুবেল আমি যাব না। বললাম আমি সুবিদ আলী ভূইয়ার লোক জানতে পারলে...। রুবেল বললো, দাদা চলেনই না, পরিচয় দেব না। নানা ইতস্তত, পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যাব তবে পরিচয় দেব না।
বাসায় একটি রুমে বসলাম। ৫ মিনিট পর তিনি আসলেন। দেখলাম রুবেল তার খুবই পরিচিত। নানা কথার ফাঁকে আমার প্রসঙ্গ এলো। নাম শুনেই বুঝলেন আমি কে? প্রশ্ন করলেন জেনারেল সাহেব কেমন আছেন? আমি বললাম ভালো আছেন? খুব পরিশ্রম করছেন মনে হয়, লেখালেখিও করছেন। আমি বললাম জ্বি, সারাদিনই লোকজন সামলাচ্ছেন। রুবেল সাত্তার সাহেবকে বললো, এবার মনোনয়ন চাইবেন নাÑ দলতো প্রার্থী নির্ধারণ করবে। মৃদু হেসে বললেন, ক্যান্ডিডেট তো ঠিক হয়েই আছে। শুধু শুধু...। আর আমি তো আওয়ামী লীগেই আছি। রুবেল বললো, মাঠে নামবেন না? দাউদকান্দিতে আপনার অনেক নেতাকর্মী? বললেন. সবাই তো মাঠেই আছে, তোমরা মাঠে আছো না। আমার কি প্রয়োজন আছে মাঠে নামার? এক পর্যায়ে ভাবী এলেন, আপ্যায়ন করলেন। 
ঘটনাটি ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস। জাতীয় নির্বাচনের কয়েকদিন বাকী। তখনও সাত্তার সাহেব দলের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে নামেননি। নানাভাবে তাকে বলা হলো। জেনারেল সাহেবও বললেন। অবশেষে বাদল রায়, রতন সিকদার (বর্তমানে মেঘনা উপজেলা চেয়ারম্যান) ও মেজর মোহাম্মদ আলী (বর্তমানে দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান), আর ছোট করে বললে আমি ও শিবলীসহ বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে মেঘনা উপজেলায় এক জনসভায় উপস্থিত হই। সেদিনের পুরো মেঘনা উপজেলা যেন নতুনভাবে জেগে ওঠেছিল। 
পরের দিন দাউদকান্দিতে নির্বাচনী প্রচারে জেনারেল ভূইয়ার গাড়িতে আমি ও শিবলী ভাই (জেনারেল ভূইয়ার পিএ) এবং সাত্তার সাহেবের পিএ সম্ভবত সালাম ভাই ছিলাম। মাঝের সিটে জেনারেল ভূইয়া ও সাত্তার সাহেব। আমরা তার পেছনের সিটে। এক একটি সভাস্থলে যাচ্ছি আর দুই নেতার মন্ত্রমুগ্ধ কথাবার্তা শুনছি। মাঝে মাঝে দুজন কানে কানে কি যেন বলছেন। আমরা প্রথমে সুন্দলপুর হয়ে শহীদনগর তারপর পেন্নাই হয়ে মানিক কান্দি, বাড়ইকান্দি হয়ে জয়বাংলায় পথসভা। পথসভা হলে প্রচুর লোকজন। নৈয়াইরে একটি পথসভা জনসভায় রূপ নেয়। পরে পালেরবাজার হয়ে বশির মিজির বাড়ির বাস্তার মোড় হয়ে খানেবাড়িতে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি। খানেবাড়ি জেনারেল ভূইয়ার শ্বশুর বাড়ি। আমরা বাহিরে কথা বলছি, এক পর্যায়ে সাত্তার সাহেব বললেন কি সাংবাদিক কি বুঝছো। আমি বললাম, সবকিছু ঠিক থাকলে ‘বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে সুবিদ আলী ভূইয়া’। তিনি হেসে বললেন, আমারও পরিসংখ্যান তাই বলে। তারপর আমরা চক্রতলা যাই। বাজার পেরিয়ে কিছু দূরে শামসু সওদাগরের বাড়ি। ভদ্রলোক দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান। সাত্তার সাহেব বললেন, চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাব আমাদের পুরনো লোক। এক কর্মী বললো, না ওনি এখন বিএনপি করেন। সাত্তার সাহেব বললেন তাতে কি আমরা যাব। জেনারেল সাহেবও সম্মতি দিলেন। বাড়ির উঠানে পা রাখতেই চেয়ারম্যান বেরিয়ে এলেন। হাত মিলিয়ে কেমন যেন আমতা আমতা করতে লাগলেন। সাত্তার সাহেব বললেন, না না ভোট নয়, দোয়া চাইতে এসেছি। চেয়ারম্যান অপলক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমার চিনামুড়া এক কর্মীর বাড়িতে দুপুরের খাবার সেরে নেই। খেতে বসে শিবলী ভাই আমাকে বললোÑ ‘দুলালদা, আজ দাউদকান্দির রাজনীতির চিত্রটাই যেন পাল্টে গেল। ঐক্য রাজনীতিতে কত শক্তি তা স্পষ্ট হলো।’ বিকেলে বরকোটা হয়ে গৌরিপুরে জনসভা, তারপর শহীদনগর হয়ে দাউদকান্দি আমরা ফিরে আসি।     
দুটি স্মৃতির ঘটনা বললাম এই কারণে যে, আসলে সিনিয়র নেতাদের আদর্শের দূরত্ব কখনও হয় না। এটা সৃষ্টি করা হয়। আর এটা করেন কতিপয় ‘সুবিধাবাদী নেতা বা কর্মী’ পর্যায়ের লোক। প্রথম ঘটনায় আমার পরিচয় জেনেই জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল সাহেব কেমন আছেন? আর দ্বিতীয় ঘটনায় সারাদিনের চিত্রই তো তার প্রমাণ। আমি রাজনীতির মানুষ নই, রাজনীতি করার ইচ্ছেও আমার নেই। তবে একজন সাংবাদিক হিসেবে রাজনীতিকে যেভাবে দেখেছি, দেখছিÑ সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই ‘সুবিধাবাদী নেতা বা কর্মী’পর্যায়ের লোকদের চিহ্নিত করা না গেলে যে কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দূরত্বের রাজনীতির অবসান হবে না। আর রাজনীতিতে বড় কথা ত্যাগী নেতা বা কর্মীদের মূল্যায়ন। কর্মীদের ত্যাগের মূল্যায়ন করলে তারা উৎসাহ বোধ করেন। জনগণের কল্যাণে নিজেকে আরও বেশি বেশি সম্পৃক্ত করার সুযোগ পান। 
মানুষ মরে যায়, রেখে যায় স্মৃতি ও কীর্তি। হাসান জামিল তার জীবনের পথে পথে ছড়িয়েছেন ফুল্ল কুসুম। রোপণ করেছেন বোধিবৃক্ষ। যে বৃক্ষ আজ ছায়া দেয়। শান্তির সুবাতাস বয়ে যায়। তার জীবন ও কর্ম আলোড়িত করে বুদ্ধিমত্তায়, আলোর প্রশ্রবণে। 
আসলে মৃত্যু মানুষের অনিবার্য নিয়তি। একদিন মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে। প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয় কারো ক্ষেত্রেই ঘটবে না। হাসান জামিল সাত্তারও তেমনি একজন। মানুষ বাঁচে তার কর্মে-তার সেবায়। হাসান জামিল সাত্তারও বেঁচে থাকবেন তার কর্মে শত-সহ¯্র নেতা কর্মীর ভালোবাসার মাঝে। মানুষের সেবার মধ্যদিয়ে যা তিনি শিখিয়েছেন তা আমরা কর্মীরা কখনই ভুলবে না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তার কাছে শিখেছি। তিনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন এই প্রার্থনা রইল। 

লেখক : সহকারী সম্পাদক (প্রকাশনা), প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এই বিভাগের আরো সংবাদ