প্রয়োজন একটু মিষ্ট ভাষা

১৮ জুলাই ২০২৪, ১৯:৪৭ | অনলাইন সংস্করণ

মোশাররফ হোসেন মুসা
সামান্য মুখের ভাষা একটি দেশের সমগ্র চিত্রকে পাল্টে ফেলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন- আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা উচ্চ আদালতে ন্যায় বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না( সমকাল'১৮ জুলাই)। তিনি যদি সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথাটিই বলতেন, তাহলে দশ-এগারো জন তরুণের মুল্যবান জীবন যেতো না। ২০১৩ সালে দেশের অগ্নিগর্ভ সময়ে একই আশাবাদ নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম, যা বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৭ নভেম্বর' ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত হয় । লেখাটির প্রাসঙ্গিতা থাকায় পুন:প্রচার করা হলো।
"দুই নেত্রীর ফোনালাপ ও প্রাইমারি কালচার প্রসঙ্গ" ১. মিষ্টভাষী হওয়া, অনুচ্চ স্বরে কথা বলা, কথা শুরুর আগে অনুমতি নেওয়া, শৃঙ্খলা মেনে চলা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রভৃতি আচরণ উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে 'প্রাইমারি কালচার' নামে খ্যাত। সেখানে অল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ সব পর্যায়ের ব্যক্তির মাঝে প্রাইমারি কালচারের অনুশীলন দেখা যায়। সেখানে প্রাইমারি কালচার ভঙ্গকারী ব্যক্তিকে অসভ্য মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। এদেশে প্রাইমারি কালচারের অনুশীলন সেভাবে না থাকায় ক্ষুদ্র বিষয় থেকে সৃষ্ট ঘটনা খুনখারাবি পর্যন্ত গড়িয়ে থাকে। তারপরও এদেশের জনসাধারণ স্থানীয়তে এক প্রকার গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই বসবাস করছে। তবে স্থানীয়তে যতটুকু গণতন্ত্র আছে সেটুকুও বিলুপ্ত হতে চলেছে জাতীয়তে অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণ বিদ্যমান থাকার কারণে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে, দেশের সর্বত্র 'প্রাইমারি কালচার' প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে সর্বোচ্চ মহল থেকে এর চর্চা শুরু করতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, দুই শীর্ষ নেত্রীও আচার-আচরণে প্রাইমারি কালচার বজায় রাখেন না, সেটি তাদের ফোনালাপে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
২. গত ২৬ অক্টোবর '১৩ সন্ধ্যায় চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে দুই নেত্রীর মাঝে বহু কাঙ্ক্ষিত ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন কিছু পত্রিকা তাদের আলাপের কিছু অংশ প্রকাশ করে। তথ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন, 'তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। এটি জাতীয় সম্পদ। সে জন্য দেশের স্বার্থে সংলাপটি প্রকাশ করা হবে' (তিনি বলতে পারতেন, দুই নেত্রী রাজি হলে সংলাপটি প্রকাশ করা হবে। বিরোধী দল থেকেও বলা হয়নি, এটি প্রকাশে তাদের আপত্তি রয়েছে)। গত ২৯ অক্টোবর '১৩ সব মিডিয়া সংলাপের কথাগুলো হুবহু প্রকাশ করে। দুই নেত্রী সংলাপের শুরুতে সামান্য সৌজন্য দেখালেও পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ আচরণ করতে থাকেন। ৩৭ মিনিট সংলাপের ৫ মিনিট ব্যয় করেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর জন্য বরাদ্দকৃত রেড ফোনটি সক্রিয় থাকা-না থাকার বিষয় নিয়ে। তারা কেউই ধৈর্যসহকারে একে অপরের বক্তব্য মন দিয়ে শোনেননি। একজনের বক্তব্য শেষ না হতেই আরেকজন পাল্টা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী রেড ফোনটি ডেড থাকার অভিযোগটি 'মিথ্যা' বলে উল্লেখ করেন। বিরোধীদলীয় নেতাও এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাদের আলোচনায় ঘুরেফিরে অতীতের ঘটনাবলী চলে আসায় চলমান সমস্যা গুরুত্ব হারায়।
৩. মনোবিজ্ঞানীদের মতে, 'আচরণে মানুষের শিক্ষাদীক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।' তাই বলে দুই নেত্রী অনালোকিত মানুষ এটি বিশ্বাস করা সঙ্গত হবে না। সে জন্য কেউ কেউ মনে করেন, 'উদ্দীপক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আলোকিত মানুষও অশালীন আচরণ করতে পারেন।' দুই নেত্রী এই-ই প্রথম একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেননি, এর আগেও তাদের মুখে বহুভাবে একই অভিযোগ শোনা গেছে।
৪. এদেশ দীর্ঘকাল পরাধীন ছিল। বিদেশিরা ছিলেন শাসক, আমরা ছিলাম প্রজা। কোনো দাবিই অহিংস পথে আদায় হয়নি। সে কারণে সরকারের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থা আমাদের মজ্জাগত সংস্কৃতি। একই কারণে এখনো মিষ্ট আচরণকে দুষ্ট লোকের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার মনে করা হয়। কিন্তু ইউরোপীয় দেশে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়। তাদের শাসনের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকায় দেশের প্রতি মালিকানাবোধ ও কর্তব্যবোধ ভিন্নতর। সেখানে রেনেসাঁর হাত ধরে সভ্যতা আসায় এবং নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক শাসন বহাল থাকায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে। বলা যায়, সামাজিক ও আইনগত কারণে তারা আচার-আচরণে 'প্রাইমারি কালচার' অনুশীলন করতে বাধ্য থাকেন। দুই নেত্রীর উদ্দেশ যদি দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্র রক্ষা হতো তাহলে তাদের ফোনালাপটি এভাবে তিক্ততার মধ্য দিয়ে শেষ হতো না। যদি আলোচনাটি সৌজন্য ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে শেষ হতো তাহলে দ্বিতীয়বার আলোচনার পথ উন্মুক্ত থাকত। পুনরায় আলোচনা না হলেও ঘটনাটি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। তবে তাদের দুজনের মধ্যে চরম বৈরী সম্পর্ক থাকলেও অন্য নেতা-নেত্রীদের মাঝে সেরকম সম্পর্ক নেই (এখানে বিএনপি নেতা ইকবাল মাহমুদ টুকু এবং প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়ার পরিবারের সঙ্গে শেখ সেলিম ও শেখ হেলালের পারিবারিক আত্দীয়তার বিষয়টি উদাহরণ হতে পারে)। তাছাড়া এখনো গ্রামেগঞ্জে বয়সী মানুষকে মান্যগণ্য করা হয়। একে অপরের বিপদে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যাওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে। সে জন্য রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ হওয়া উচিত সর্বত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সময়োপযোগী ডিজাইন বের করা। মনে রাখা দরকার, দুই নেত্রীই একমাত্র গণতন্ত্রের রক্ষক হতে পারেন না। একটি দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকে জনগণের ক্ষমতায়ন ও উপযুক্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আওয়ামী লীগেরই উচিত ছিল প্রয়োজনীয় সংখ্যক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কিন্তু তারা তিনবার ক্ষমতায় এসেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করেনি, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেনি। বিএনপিও তাদের পথেই হেঁটেছে।
সে জন্য আমরা বারবার বলে আসছি দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় এবং স্থানীয়তে একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সে সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয়তে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও ন্যায়পাল সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে উন্নত দেশের মতো এদেশেও সুশাসনের অংশ হিসেবে 'প্রাইমারি কালচার' অনুশীলনের বিষয় হয়ে পড়বে।
লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক এবং পরিচালক, প্রাইমারি কালচার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (পিসিডিসি), ঈশ্বরদী, পাবনা।
"দুই নেত্রীর ফোনালাপ ও প্রাইমারি কালচার প্রসঙ্গ" ১. মিষ্টভাষী হওয়া, অনুচ্চ স্বরে কথা বলা, কথা শুরুর আগে অনুমতি নেওয়া, শৃঙ্খলা মেনে চলা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রভৃতি আচরণ উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে 'প্রাইমারি কালচার' নামে খ্যাত। সেখানে অল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ সব পর্যায়ের ব্যক্তির মাঝে প্রাইমারি কালচারের অনুশীলন দেখা যায়। সেখানে প্রাইমারি কালচার ভঙ্গকারী ব্যক্তিকে অসভ্য মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। এদেশে প্রাইমারি কালচারের অনুশীলন সেভাবে না থাকায় ক্ষুদ্র বিষয় থেকে সৃষ্ট ঘটনা খুনখারাবি পর্যন্ত গড়িয়ে থাকে। তারপরও এদেশের জনসাধারণ স্থানীয়তে এক প্রকার গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই বসবাস করছে। তবে স্থানীয়তে যতটুকু গণতন্ত্র আছে সেটুকুও বিলুপ্ত হতে চলেছে জাতীয়তে অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণ বিদ্যমান থাকার কারণে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতে, দেশের সর্বত্র 'প্রাইমারি কালচার' প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে সর্বোচ্চ মহল থেকে এর চর্চা শুরু করতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, দুই শীর্ষ নেত্রীও আচার-আচরণে প্রাইমারি কালচার বজায় রাখেন না, সেটি তাদের ফোনালাপে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
এই বিভাগের আরো সংবাদ