কার দায়মুক্তি কীসের দায়মুক্তি

১৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৫ | অনলাইন সংস্করণ

এম.এম.নাজমুল হাসান
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় হাজার হাজার বছর ধরে বহু আইন-প্রথা চালু হয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু আইন করে কোন সংগঠিত অপরাধের বিচারের পথ রুদ্ধ করার ঘৃণিত কাজটি করা একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। আর সেই আইনটি হল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত আইন।
কোন হত্যাকারী বা খুনীদের বিচার করা যাবেনা কিংবা বিচার হবেনা তেমন একটি ন্যাক্কারজনক আইন প্রণীত হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে। যে আইনটির মূল অনুঘটক ছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। মূলত আইনটি করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য। এসব কারণে দীর্ঘদিন স্তিমিত ছিল জাতির পিতার হত্যার বিচার।
নয় জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসের কলংকজনক দিন। ১৯৭৯ সালের এই দিনে স্বৈরশাসক জিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আইনটি পাস করেন। যেখানে বলা হয়েছিল জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার করা বা চাওয়া যাবে না।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা দায়মুক্তি আইন - ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা,অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। অধ্যাদেশের দ্বিতীয় অংশে বলা আছে,রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে,তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো,অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা,অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবেনা।
সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি,অসুস্থতা বা অন্য কোন কারনে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তদস্থলে উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হলে স্পীকার রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। সংবিধানের এই বিধান বলবৎ থাকার পরেও উপ-রাষ্ট্রপতি ও স্পীকারকে বাদ দিয়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পরে সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ২০ আগস্ট মার্শাল ল জারি করা হলেও সেসময় সংবিধান ছিল বলবৎ যা দ্বিমুখী নীতির শামিল। এরপর ২৫ আগস্ট ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি নিযুক্ত করা হয়।
জাতির পিতার খুনিদের দায়মুক্তি দিতে তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। যা ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ ৫০ নামে অভিহিত হয়। দ্য বাংলাদেশ গেজেট,পাবলিশড বাই অথরিটি‘ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষরের পর তৎকালীন আইন ,বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। পঁচাত্তরের তিন নভেম্বর কারগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সাত নভেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের নিকট থেকে প্রধান সমরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেয় । ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করেন। বিচারপতি সায়েম তার ‘অঃ ইধহমধনযধনধহ, খধংঃ ঢ়যধংব ’গ্রন্থে বিস্তরিত বলেছেন।
সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ-না গণভোটের আয়োজন করেন জিয়া। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া সামরিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। এসময় জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের নয় এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ,ষোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন,১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল।
পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা না করে আইনটি সংসদে পাশ করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে অনুমোদন দিয়ে জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রক্ষাকারী এবং হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে অন্যতম। মোস্তাক ও জিয়া সরকার খুনিদের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিচার না করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ভিন্ন ভিন্ন কূটনৈতিক পদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। তাদের মধ্যে-লে. কর্ণেল শরিফুল হক ডালিমকে চীনে প্রথম সচিব, লে.কর্ণেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্ণেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে.খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব,লে. নাজমুল হোসেন তৃতীয় সচিব, লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব পদে পদায়ন করেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার,এইচ এম এরশাদ ও জিয়ার সহধর্মীণী খালেদা জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি,বরং তারা দায়মুক্তি আইনের দোহায় দিয়ে খুনিদের দিয়ে রাজনীতি করিয়েছেন।
অপর আর এক জান্তা সরকার এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে করা ইনডেমনিটি আইন বাতিল না করে বরং নিজের ক্ষমতায় থাকার সুবিধার্থে দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন,যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সপ্তম সংশোধনীতে অর্ন্তভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের নয় নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সকল প্রকার সামরিক আইন,অধ্যাদেশ,বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় ।
খুনিচক্র জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলো। একইভাবে ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সরকারও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। এমনকি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনী লে. কর্ণেল খন্দকার আব্দুর রশিদকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার স্থান করে দেয়া হয়। অপর আর এক খুনী কর্ণেল ফারুককে ফ্রিডম পার্টির সাথে রাজনীতির মঞ্চে মঞ্চস্থ করা হয়।
দীর্ঘ ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট -১৯৯৬ নামে একটি বিল উত্থাপিত হয় জাতীয় সংসদে। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদের অধিবেশনে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ১৯৭৫ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও জিয়া কর্তৃক ১৯৭৯ সালে নয় এপ্রিল সংসদে বৈধতা দেওয়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে আইন পাস করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত হয়। খুলে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রুদ্ধ পথ। এ আইনটি পাসের বিরোধিতা করে বিএনপি জামায়াত হরতাল ডাকে এবং বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত থাকে। এতে প্রতীয়মান হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও পঁচাত্তরের খুনীদের বাঁচাতে তৎপর। এরপর ১৯৯৬ সালের দুই অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের আট নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে ১২ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে তিন জনকে খলাস দেয়।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি –জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে উচ্চ আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া অকার্যকার করে রেখেছিলো। এরপর বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩ নামে সর্বশেষ ইনডেমনিটি আইন পাস করে। বাংলাদেশে মোট তিনবার দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে পঁচাত্তরের খুনীদের বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিলের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল রাতে জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন(বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জাতির পিতার খুনীদের মধ্যে এখনও পলাতক রয়েছেন-খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। এরই মাঝে একজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
খুনীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ২০২৪ সালে দায়মুক্তি আইনটি স্মরণ করছি। নতুবা নুতন প্রজন্মের অগোচরে রয়ে যেত কিভাবে জিয়া ঠান্ডা মাথায় ধারাবহিক ঘটনার জন্ম দিয়ে পরিকল্পনামাফিক ক্ষমতা দখলে করেছে। ১৯৭৯ সালের নয় জুলাই খন্দকার মোশতাকের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানে যুক্ত করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে জিয়াউর রহমান। কলঙ্কিত দায়মুক্তি আইন পাসের মাধ্যমে জিয়া কার বা কীসের দায়মুক্তি দিয়েছিল তার বিচার করবে ইতিহাস।
এম.এম.নাজমুল হাসান : প্রতিবেদক,প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এই বিভাগের আরো সংবাদ