বৈশাখ এবং বাঙালির উৎসব ঐতিহ্য

  নূরুননবী শান্ত

১২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩০ | অনলাইন সংস্করণ

পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বর্তমান নগরীয় রীতি হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য কিনা– তা নিয়ে প্রায়শ আলোচনা ও বিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। মনে রাখতে হবে, ঐতিহ্য যেমন সুদূর অতীত থেকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব সহকারে পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে অব্যাহত থাকে, তেমনি একটি যূথবদ্ধ জনপদে নতুন ঐতিহ্যও সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে পরম্পরাগতভাবে চর্চিত অনুষ্ঠান, আচার, প্রথা, এমনকি যুগের পর যুগ টিকে থাকা স্থাপনা ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সময়ের সাথে সাথে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়; বস্তুগত ও বিমূর্ত উভয় দিক থেকে। আবার বিলুপ্তও হতে পারে। এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।  

বাংলার প্রাক-ইতিহাসকালে কার্তিকসংক্রান্তি এবং অগ্রহায়ণকে বরণ উদযাপনের ধারণা পাওয়া যায়। কৃষিভিত্তিক প্রাচীন বাংলাদেশে, এমনকি নিকট অতীতের বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জীবনচিত্রের আলোকে আমরা দেখতে পাই, কার্তিক চিরাচরিতভাবে সংকটের মাস। খাদ্য ও অর্থ সংকট দুই-ই দেখা দিত। সুতরাং নিরন্ন কার্তিক পার করে ফসল তোলার মাস অগ্রহায়ণকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দ জনমনে বিরাজ করা স্বাভাবিক। সে কারণে চিরায়ত মৌখিক সাহিত্যে নবান্নের সৌকর্যমণ্ডিত বিবরণ যতটা পাওয়া যায়, বৈশাখ ঘিরে আড়ম্বরপূর্ণ লোক-আখ্যান কমই। বরং বৈশাখের রুদ্র রূপের খ্যাতি আবহমানকাল থেকেই রয়েছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যের বহু-বিচিত্র টেক্সটে রীতিমাফিক যে বারোমাসী বিবরণ পাওয়া যায়, তাতেও কার্তিকের হাহাকারের কাব্যিক প্রতিফলন রয়েছে। আর অগ্রহায়ণের বিবরণে আশা ও সম্ভাবনা এবং বৈশাখে উত্তাপ ও দুর্যোগের ঘনঘটা। সেদিক থেকে অগ্রহায়ণ উদযাপনের স্বাভাবিক চর্চা ফসলনির্ভর বাঙালি জীবনে থাকারই কথা।

তবে কালক্রমে আজ যে পহেলা বৈশাখ বাংলা বছরের প্রারম্ভ হিসেবে উদযাপিত হয়, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। তবুও পহেলা বৈশাখের উৎসবকে চিরায়ত ঐতিহ্যের মর্যাদা দেওয়া অতিরঞ্জন হিসেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। কেননা, সম্রাট আকবর নির্দেশিত, জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লা সিরাজী প্রণীত ‘তারিখ-এ-এলাহি’ বা ‘ফসলি সন’ তথা ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত প্রক্রিয়া হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে সর্বসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব উদযাপনের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হবার প্রমাণ মেলে না।

সেকালের শাসকগোষ্ঠী বাংলা সন প্রচলনের প্রক্রিয়াকে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন। কৃষক সমাজ খাজনা প্রদানের পর রাজমিষ্টান্নে আপ্যায়িত যেমন হতো, তেমনি রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত মেলায় সুযোগ পেত উদ্বৃত্ত পণ্য বেচা এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের। বৈশাখে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক ও আয়োজনের চল বাংলার জনপদে সুপ্রাচীন কাল থেকেই অস্তিত্বশীল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল মেলা। সেসব মেলা চৈত্রের সনাতনী কৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে যেমন হতো, তেমনি বৈশাখের প্রারম্ভেও চলত। বর্তমানেও এই ঋতুভিত্তিক ঐতিহ্য জীবন্ত। কিন্তু নানান উপলক্ষে প্রাচীন শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের কথা জানা গেলেও বৈশাখ উপলক্ষে আড়ম্বরপূর্ণ শোভাযাত্রা আয়োজনের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বিরল। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা নতুন ঐতিহ্য হিসেবে আবির্ভূত।

আজকের যুগে বৈশাখ মাস বা খ্রিষ্টীয় এপ্রিলের মধ্যভাগে কেবল বাংলাদেশে নয়; ভারতের আসাম, কেরালা, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, মণিপুর, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গসহ শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড ইত্যাদি অঞ্চলের সব জনজাতির সাধারণ উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং তা ধর্মনিরপেক্ষ রূপ পরিগ্রহ করেছে। ফলে সময়ের পরিক্রমায় বৈশাখ উদযাপনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সমাজের বৈচিত্র্যের মধ্যে সমন্বয় সাধনের অসীম শক্তি। এই শক্তিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকশিত হতে দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্প্রীতি ও শান্তির নিশ্চিত সম্ভাবনা।

বাংলাদেশে, বিশেষ করে নগরীয় পরিমণ্ডলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনা। এই চেতনার প্রথম প্রকাশ সাংস্কৃতিকভাবে ছায়ানটের মাধ্যমে ঘটলেও তা বাঙালির নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিল। কেননা, এর উদ্দেশ্য ছিল ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সংস্কৃতিগতভাবে মোকাবিলা করা। এরশাদের স্বৈর শাসনামলেও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মাধ্যমে সংস্কৃতিগতভাবে অপরাজনীতি মোকাবিলার আন্দোলন শুরু হয়। এই পর্বে নগরীয় পরিসরে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। এর উত্থান যশোরে হলেও ঢাকার মাধ্যমেই তা দ্রুত জাতীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রভাবশালী উপাদানে পরিণত হয়।

এর বিপরীত দিকে, গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে আজও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চর্চিত হতে থাকা চৈত্রসংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী আয়োজন বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিচিত্র রূপের বৈশাখী মেলা প্রচারমাধ্যমের কার্পণ্যে বিশ্বদৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে থাকে। পাশাপাশি গ্রামকে শহরে পরিণত করার অপরিপক্ব প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে গ্রামীণ বারুণী স্নান উৎসবের মেলা, চড়ক মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির শিবের নাচন, গাজন মেলাসহ বৈশাখী মেলাগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এসব মেলা উপলক্ষে হয়ে আসা সার্কাস, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, ভ্যারাইটি শো বা মৃত্যুকূপের মতো জনপ্রিয় আয়োজন আর্থসামাজিক ও আইনি বিধিনিষেধের চাপে সংকুচিত হতে থাকে। যেখানে এসব মেলা মানুষে মানুষে আনন্দময় মিথস্ক্রিয়ার স্থান হওয়ার পাশাপাশি মসলা, তুলো, চুন, আসবাব, গৃহস্থালি দ্রব্য, কৃষি উপকরণসহ গ্রামীণ মানুষের সাধ্য-সাপেক্ষ বহুবিধ শৈল্পিক কারুপণ্যের সমাহারে পূর্ণ ছিল, আজ সেখানে দেখা দিয়েছে করপোরেটের আধিপত্য। তবুও গ্রামবাংলা থেকে হারায়নি বৈশাখী মেলা, চৈত্র মাসের চিরায়ত সাংস্কৃতিক আয়োজন।

এসব চিরায়ত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে শুধু নগরীয় আয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া হলে বৈশাখ উদযাপনকে খণ্ডিত করেই তুলে ধরা হয় বিশ্বদৃষ্টির সামনে। যদি বৈশাখ উদযাপনের আবহমান রীতিসহ বাঙালি ও বাংলাদেশের সব জনজাতির উৎসব ও বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদানকে আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আয়োজনে ভরপুর বৈশাখের পূর্ণাঙ্গ ছবিকেই আমলে নিতে হবে। এই বিশ্বায়নের যুগে জাতিগত পরিচয়, স্বাতন্ত্র্য সমুন্নত রাখতে হলে ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত থাকার বিকল্প নেই।

আজকে দেখা যাচ্ছে, কোনো না কোনো জুজুর ভয়ে ঐতিহ্যবাহী উৎসব আয়োজনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা অবশ্যই জাতিগত আত্মপরিচয় বিনির্মাণ ও সমুন্নত রাখার পথে বড় বাধা। সুসংহত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পালনের অবাধ ও নিঃশঙ্ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

নূরুননবী শান্ত: গল্পকার ও লোকসংস্কৃতি গবেষক  ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ