বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২৩
আসুন পরিবারকে ডায়াবেটিসমুক্ত রাখি

১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:৪৬ | আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৬:১৩ | অনলাইন সংস্করণ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
নীরব ঘাতক-স্বভাবের যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক, সেই ডায়াবেটিস রোগটির অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতেই অন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডারিক ব্যান্টিং (১৮৯১-১৯৪১) এবং চার্লস বেস্ট (১৮৯৯-১৯৭৮) কর্তৃক ইনসুলিনের আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। বলা বাহুল্য, ১৪ নভেম্বর ফ্রেডারিক ব্যান্টিংয়ের জন্ম দিবসকেই তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
বিশ শতকের শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধি নিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটি বসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি নির্মূলে সফল হতে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর-সাবলীল জীবন-যাপনের পথে নীরবে তার সর্ব কর্মক্ষমতা হরণকারী অ-সংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আসছে না বলে প্রতীয়মান হয়। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির আহ্বানে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দুইশর অধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কোম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিক রোগীদের মাঝে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানান প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। ২০০৭ সালেই জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবসের ব্লু সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিনিচয়কে সংঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসংঘের পতাকার রংও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐকবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। এ রোগের ভয়াবহ বিস্তার ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গণদৃষ্টি আকর্ষণার্থে এবার ২০২৩ সালে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবসের অন্যতম প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়বেটিক রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি ( বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩ ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে টাইপ ২ অর্থাৎ ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি (১৮০%), এর পর আফ্রিকা মহাদেশে (১৬০%) , তারপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ( ১৫৫%) হারাহারিমতে ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে এই রোগের গড় বিস্তার যেখানে ১১৪%, আমাদের বাংলাদেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯%, যা য়থেষ্ট আশঙ্কাজনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশের ভারসমাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে এই শতকের মাঝামাঝিতক পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারি রূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাবমতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতক ব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে সে দেশের জাতীয় অর্থনীতির।
গ্রিক ক্রিয়াপদ ডায়াবাইনেইন থেকে ডায়াবেটিক শব্দের উৎপত্তি । মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) ১০২৫ সালে সমাপ্ত তাঁর ১৭ খণ্ডের চিকিৎসা বিশ্বকোষ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’-এ সর্বপ্রথম ‘বহুমূত্র, অধিক ক্ষুধা এবং যৌনশক্তির ক্রমনাশক’ ডাযাবেটিক রোগের স্বভাব-চরিত্র বর্ণনা করেন। ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিনের কথাও লিখেছেন তিনি। ইবনে সিনা লিউপিন বা নয়নতারা ফুল, ট্রিগোনেলা আর জেডোয়ারির বিজ সমন্বয়ে তৈরি ভেষজ ওষুধ দ্বারা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও নির্দেশ করেছিলেন, যা আধুনিক চিকিৎসা গবেষণাতেও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশিদিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সবসময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না- গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রপাচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের : (ক) ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং (খ) ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায় । খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আজীবনের রোগ ডায়াবেটিস চূড়ান্তভাবে নিরাময়যোগ্য নয়, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নানান উপসর্গের জটিলতা পরিহারপূর্বক দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। আর সেই নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হলো তিনটি- জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের (১৯১১-১৯৮৯) মূলমন্ত্র- থ্রি ডি- ডিসিপ্লিন, ডায়েট অ্যান্ড ড্রাগ। আর এই তিন উপায় বা উপকরণে যিনি প্রধান নিয়ামক সেবা দান করে থাকেন তিনি নার্স। তিনি অবশ্যই একজন পেশাজীবী এবং হেলথ টেকনোলজিস্ট। নার্সই রোগীর প্রশিক্ষক, তাকে পরিচর্যা পরিবীক্ষণ পর্যালোচনা এবং (চিকিৎসকের কাছে) রিপোর্টিংয়ের অন্যতম বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব। ক্রিমিয়ান ওয়ারের সময় যুদ্ধাহত রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা করে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ খ্যাতি নিয়ে মানবীয় গুণাবলি বিকাশের আদর্শ স্থাপন করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল (১৮২০-১৯১০)। নার্সিং পেশাকে যথাযোগ্য সম্মান ও গৌরবে বিভূষিত করতে এবং বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের পরিচর্যা প্রদানে তাদের ভূমিকার তাৎপর্য জগৎময় উদ্ভাসিত করতেই আইডিএফ কয়েক বছর আগে নার্সিং ব্যবস্থাপনাকে দিয়েছিল এই স্বীকৃতি। সে সময় আই ডিএফ বলেছিল, নার্স পর্যাপ্ত সেবা দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীকে খাদ্য নিয়ন্ত্রণে, জীবন-যাপনে সব পর্যায়ে শৃঙ্খলা বিধানে এবং সময়মতো উপযুক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনে সহায়তা করতে পারেন। চিকিৎসক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন, পরামর্শ দিয়ে থাকেন কিন্তু তার ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ মতো রোগীকে নার্সের সহায়তা অনিবার্য হয়ে ওঠে। একান্ত সহচরের মতো একজন নার্স রোগীকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে শৃঙ্খলা অনুসারী হতে উদ্বুদ্ধ করেন, ওষুধ ও খাদ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন, হস্তক্ষেপ করতে পারেন। পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি যথা দায়িত্বশীল হয়ে নার্সিংয়ের ভূমিকায় না থাকলে ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণ করা রোগীর পক্ষে সহজসাধ্য নয়।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য।
সৌজন্যে : দৈনিক বাংলা।
এই বিভাগের আরো সংবাদ