আধিপত্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার লেজেগোবরে অবস্থা
আলাউদ্দিন মল্লিক
১০ জুন ২০২৩, ১১:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ
সাম্প্রতিক বিশ্ব প্রবণতা
ডিজিটাল বিশ্ব: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতা, সমাজ, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রভাবে পালটে গেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও রাজনৈতিক চর্চা। যে জাতির প্রযুক্তি যত উন্নত, সে জাতির বিশ্ব সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাবও তত বেশি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বৃহৎ পরিসরেমেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে। ইন্টারনেট অফ থিংসের (আইওটি) ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পঞ্চম প্রজন্মের থাকবে বিশেষ ভূমিকা। বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্ম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। এর সঙ্গে ভবিষ্যত অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ২০৩৫ সালের মধ্যে কেবল পঞ্চম প্রযুক্তিই বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ও ২২ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: ২০৩০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান অনুমান করা হয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থনীতি তেল কিংবা অতীতের সব ধরনের উৎসের চেয়ে বেশি মূল্যবান। ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে এর বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর লড়াই চলবে।
দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ
দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হলো রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েনের বিরোধী ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্লকের মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধ। এতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর একটি বর্তমানের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি চীনের নেতৃত্বে চীন-রাশিয়া-ইরান-ভেনেজুয়েলা নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান শক্তি অর্জনকারী বাকি বিশ্ব এই দুই পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রগুলো জড়িত - মূলত এর মাধ্যেম বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে । একে দ্বিতীয় ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা নতুন স্নায়ুযুদ্ধও বলা হয়; কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রথম শীতল যুদ্ধ চলেছিল যার এক পক্ষ ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিশ্ব। বর্তমান শীতল যুদ্ধটি মূল প্রথম শীতল যুদ্ধের অনুরূপ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ব্লকের এবং রাশিয়ার পূর্বসূরীর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ব্লকের মধ্যে অচলাবস্থা এবং প্রক্সি যুদ্ধের শুরু করেছিল। বর্তমান সময়ে চীন আর মার্কিন বলয়ের মধ্যকার প্রতিটি বিরোধ প্রথম শীতল যুদ্ধকেই মনে করে দেয়। পেট্রোলিয়াম হতে তথ্য প্রযুক্তির প্রাধান্য
এক সময় তেল ছিল বিশ্ব রাজনীতির মূল স্বার্থ, যে স্থানটা এখন তথ্য বা ডাটার দখলে। তথ্যের মূল্যায়ন নিয়ে বহুদিন ধরেই গবেষণা চলছে, ২০১৭ সালে 'দ্য ইকোনোমিস্ট' তথ্যকে নতুন তেল বলে আখ্যা দিয়ে একটি স্টোরি প্রকাশ করে। তারপর থেকেই এই বিষয়ে বৈশ্বিক চর্চাটা তরান্বিত হয়। বর্তমানে, যার কাছে যতবেশি ডাটা, সে তত বেশি সম্পদশালী। প্রযুক্তি দানব গুগলের কথাই ধরা যাক, যাদের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ডাটা সংরক্ষিত আছে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির তালিকাতেও প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান উপরের দিকে। করোনা অতিমারীর আগ্রাসন
মহামারির কারণে সৃষ্ট নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য শেয়ার, মানবীয় যোগাযোগ, তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ইন্টারনেট ও ইনোভেশনের প্রভাব অপরিহার্য। বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রচারণা ও জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল মাধ্যম। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়েও বিশেষ ভূমিকা রাখছে প্রভাবশালী এ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ থেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় আমেরিকার হাতে। আমেরিকার একচেটিয়া রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তৈরির পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান যেমন ছিল, ভাঙন ধরার পেছনেও সেই প্রযুক্তির বিকাশই অনেকাংশে দায়ী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া ও চীন আমেরিকার চোখে চোখ রেখে ভূ-রাজনীতির হিসাব দিচ্ছে পাল্টে। প্রযুক্তির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতিতে, পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব স্তরেই এর ছাপ পাওয়া যায়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। এর কারণ হিসেবে যাই উল্লেখ করা হয় না কেন তা আমাদের বাঘ আর ছাগলের পুরনো একটি নীতিগল্পের কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে ছাগল নদীর ভাটিতে থেকে পানি খাচ্ছিল। আর বাঘটি তার পানি ঘোলা করার অভিযোগ করে ছাগলের বিরুদ্ধে। ছাগল তার অবস্থানের কথা জানালে বাঘটি বলে,"তাহলে তোর মা পানি ঘোলা করেছিল। " আসলে বড় শক্তির দরকার একটি বাহানার - প্রয়োজন হলে কাল্পনিক অভিযোগ আনা হয়। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, ৪ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে, এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পথে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু ইউরোপকে পরিবর্তন করে দেয়নি বরং সারা পৃথিবীর পণ্য পরিবহনকেই নতুন একটা মাত্রায় ঠেলে দেয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন আর পণ্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। বিশ্বব্যাপী ব্যবসার নতুন নতুন দুয়ার চালু হয়েছে; পূর্বের চিরায়ত ব্যবসা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। পণ্যমূল্যের উর্ধগতি
২০২২ এর ফেব্রুয়ারী হতে আমাদের দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ হতে ১০০ শতাংশ - কোন কোনটি আরো বেশি; যেমন সয়াবিন তেলের কেজিপ্রতি ৯০ টাকা হতে প্রায় ২০০ টাকা। জীবন রক্ষার ঔষুধের মূল্য ৫০ হতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সব্জির মূল্য বেড়েছে সমান হরে; মাংস আর মাছের মূল্য প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে। করোনা অতিমারী দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির করে দিয়েছিল; সাধারণ মানুষ নিজেদের উপার্জন সক্ষমতা হারিয়ে ক্রমাগত শহর হতে গ্রামে স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না - জীবন যাত্রার মান এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে সাধারণ মানুষ কোনভাবেই সামলে উঠতে পারছে না। সাধারণের দীর্ঘশ্বাস
বেশির ভাগ মানুষ আজ সারা পৃথিবীতে এমন একটা অবস্থানে আসতে বাধ্য হয়েছে যে, নিজের জীবন চালাতে গিয়ে ক্রমাগত আপোষ করতে করতে আর পিছাতে পিছাতে যেন অস্তিত্বের সংকটে পরে গেছে। করোনা পরবর্তী অবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের অভিগাত। প্রতিটি সেক্টরের মূল্যের উর্ধগতি পৃথিবী ব্যাপী মানুষের যে দুর্গতি সৃষ্টি করেছে তা এর আগে পৃথিবী কখনোই মোকাবেলা করেনি। তাই তাদের দীর্ঘশ্বাসে পৃথিবীর আকাশটা যেন ভারী হয়ে গেছে; এই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিইই বা করার আছে। মানবতার অন্তিম সংস্কার
ইউরোপীয় রেনেসাঁ পৃথিবীর মানুষকে নতুন মানবতার আশা জাগিয়েছিল। সাম্য আর মানবতার নতুন নতুন ইস্যুগুলো মানুষকে ক্রমাগত নতুন করে উজ্জীবিত করে চলেছিল। এই বিষয়টির দার্শনিক ভিত্তি মূলত ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত এসে নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এর বাস্তবায়ন বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল। অনেকের মতে, বিশ্ব তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল; আর তাই দুই শিবিরের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল; আর তার ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষদের অনেক দাবি পূরণ হয়েছে। সবকিছুর যেমন একটা শেষ আছে, তেমনি এই সুসময়টা এক সময় শেষ হয়ে যায়; মূলত গত শতকের নব্বইর দশকে প্রতিযোগিতার এক পক্ষের পরাজয়ের মাধ্যমে যখন একক বিশ্ব সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে। আর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার নেতৃত্বে তারা যে ব্যবসা আর লাভকেই প্রধান হিসেবে বিবেচনায় নিবে সেটা আর নতুন কি। তাই, গত শতকের শেষ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) পতনের মাধ্যমে যে মার্কিন একক আধিপত্যের শুরু হয়েছিল তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মানবতার সংস্কার হয়ে যায়। যেটুকু অধিকার সাধারণ মানুষ পেয়েছিল তার সবই অল্প কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা আর ব্যবসা
একক বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বে ব্যবসার ব্যাপক প্রসার হয় - যেটা মধ্যপ্রাচ্য হতে দূরপ্রাচ্য (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ননের তেল-প্রধান উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান আর কাজাকাস্তান) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পারে। নতুন নতুন সুযোগ তৈরী হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়ীদের সামনে। এর সাথে যুক্ত হয় পুরনো সব অধিকার যা সাধারণ মানুষের জন্য উপযোগী তার সবই বিলীন করার মাধ্যমে। ফলে সারা পৃথিবীতে শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা - আর তত সাথে লাভ আর লাভ। মার্কিন, পাশ্চাত্য আর তাদের অনুগামী কোম্পানিগুলোর ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠার মাধ্যমে। সম্পদ এমনভাবে কিছু কোম্পানিগুলোর হাতে জড়ো হতে থাকে যাতে তারা মাল্টি বিলিওনার হতে ট্রিলিওনার কোম্পানিতে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থাগুলো যে সমস্ত পরিসংখ্যান পরিবেশন করেছে তাতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ মাত্র একশটি কোম্পানির হাতে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা
গত শতকের পঞ্চাশ হতে আশির দশক পর্যন্ত পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলো টিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে। এরপর নব্বই দশকের পর গণতন্ত্রের একটা ছদ্ম সময় পার হয়েছে - যেখানে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের একটা চর্চা মার্কিন কর্তারা করিয়েছেন; যদিও ব্যবসাই ছিল মুখ্য। ইরাক আক্রমণ আর তার তেল সম্পদের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ এরই একটি উদাহরণ। এর সাথে মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার দেশগুলোতে ক্ষমতার পরিবর্তনের যে হিড়িক পরেছিল যে তও মূলত ব্যবসার ব্যাপক প্রসার করার স্বার্থে। তাই সবাই এমন একটা অবস্থায় পড়েছিল যে নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষাই একমাত্র মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। সবগুলো দেশ আর তাদের সরকারগুলো আপন প্রাণ বাঁচানোতে ব্যস্ত হতে পড়ে। আপনের চাইতে পর ভাল
বহুদিনের শত্রু-মিত্র নতুনভাবে চিত্রায়িত হতে থাকে - সোভিয়েত বলয়ে থাকা গাদ্দাফির লিবিয়া, সাদ্দাম হোসেনের ইরাক, চীনা বলয়ের ভিয়েতনাম প্রভূত দেশগুলো দ্রুত মার্কিন বলয়ে চলে যায়। যদিও গাদ্দাফি আর সাদ্দাম হোসেনের শেষ রক্ষা হয়নি। আবার নিরপেক্ষ বলয়ে থাকা সিরিয়া রাশিয়ান (সোভিয়েত বলয়ের বর্তমান উত্তরাধিকার) বলয়ে ভিড়ে গিয়ে নিজেদের এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছে। মার্কিন বলয়ের লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা নতুন চীনা বলয়ে ঢুকে গেছে। এমনটি হয়েছে আরো অনেক আফ্রিকান আর লাতিন আমেরিকান আরো কিছু দেশের ক্ষেত্রে। আর সবাই অপেক্ষায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের আশায়। স্বার্থ, স্বার্থ আর স্বার্থ
টিকে থাকার এই কঠিন সময়ে শুধু নিজ স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। আর যারা এর বিপরীত তারা আর টিকতে পারছে না। যেমনটি ক্রমাগত ভাগ হয়ে যাচ্ছে ইথিওপিয়া আর সুদান; বিভক্ত হয়ে গেছে পূর্ব তিমুর। আর শাসকরা তো বিবেচ্যই নয়; শ্রীলংকার রাজাপাকসে আর অতীত, পাকিস্তানের ইমরান খাঁন মামলা আর হামলায় বিপর্যস্ত। আর নিজ স্বার্থ রক্ষাই মূল বিবেচ্য নয়; বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির ব্যবসা-বাণিজ্যই প্রধান। যে সরকার যত বেশি মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে তারা তত বেশি সময় টিকে থাকবে। কঠিন সময়ের সম্মুখীন
একক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েমের তিন দশক পর বিশ্ব অতিমারীর অভিগাত আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমরা একটা অতি কঠিন সময় পার করছে। বিশ্ব আজ গণতন্ত্র হতে বহুদূরে; সরকারগুলো যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বিশ্ব বাজারে আগুন আর বিতরণ ব্যবস্থার নতুন সমীকরণ বেশির ভাগ দেশ আর সাধারণ মানুষদের এমন একটা কঠিন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে বেশির ভাগ মানুষ আজ যেন অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত।
সামান্য কয়েকটা দেশ, অল্পকিছু কোম্পানি আর আরো সীমিত সংখ্যক মানুষ এই পৃথিবীর সবটুকু সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আছে। যেন এরাই আধুনিক বিশ্বের ঈশ্বর - যাদের ইচ্ছার উপরই দুনিয়া চলে। আর বাকি সবাই যেন পিঁপড়ের চাইতেও কম মূল্যবান। দরকার একত্রিত প্রচেষ্টা
যুগ যুগ ধরে মানব সমাজ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়েই মানব সমাজের নিরন্তর অভিযাত্রা; আর এর মোকাবেলার জন্য মানুষের হাতে ছিল নিজেদের একত্রিত হওয়া। একত্রিত মানব সমাজ সমস্ত সমস্যার অতিক্রম করতে সক্ষম। যে সমস্যায় সারা মানব জাতি আজ নিমজ্জিত; তাতে একমাত্র একত্রিত হওয়াই একমাত্র সমাধান। আজকের বিশ্ব বহু জাতি রাষ্ট্রে বিভক্ত- দেশগুলোও সীমানা দিয়ে পরিষ্কার বিভক্ত। তবে তথ্য প্রযুক্তির এই সময় সারা পৃথিবীর মানুষরা বড় বেশি কাছাকাছি। আর তাই, তাদের একত্রিত হওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়। দরকার শুধু একত্রিত হওয়ার একাগ্র ইচ্ছা। দরকার মানবিক দৃষ্টিভিঙ্গি
সমস্যাটি সারা মানব জাতির - তাই পুরো বিষয়টি একটি সামগ্রিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কারণ, সমগ্র মানুষের নিজের রক্ষার জন্যই সবার বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে। যদি কোন দেশ বা অঞ্চলের মত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বাকী মানুষদের ক্ষেত্রে অনেক বড় অসুবিধার সৃষ্টি হয়ে পারে। বর্তমান সময়ে একটি বড় রাষ্ট্র রাশিয়া তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ইউক্রেন আক্রমণ করেছে যা ঐ অঞ্চলে একটি ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। যদি, বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হলে অবশ্যই যুদ্ধটি আর সৃষ্টি হতো না। এর শেষটা কোথায়
পৃথিবীর শাসন-ব্যবস্থার দিকে তাকালে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার - সেটা হল ক্ষমতায় থাকে অল্প কিছু মানুষ আর বেশির ভাগ মানুষকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই ব্যবস্থায় মূলত সম্পদ অতি অল্প কিছু মানুষের হাতে জমা হতে থাকে। এটাই আধিপত্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার মূল বিষয়। অল্পকিছু মানুষ একটা বিশাল সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণকরবে এটাই বর্তমান শাসন ব্যবস্থার আসল রহস্য। আর তাই, এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কোন স্বার্থই রক্ষিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ফলে এই অবস্থার স্থায়িত্ব যত বেশি থাকবে, ততই সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে। আসলে এর শেষে কখনোই ভাল কিছু নেই। ভাল কিছু পেতে সাধারণ মানুষকেই উদ্যোগী হয়ে একটি আন্তরিক আর অব্যাহত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আর অবশ্যই সাধারণ মানুষকে একতাবদ্ধ হতে হবে এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য। পরিশেষে
আধিপত্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা আজ একটা সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। অল্প কিছু মানুষ সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে এমন একটা সময়ের সামনে উপস্থিত হয়েছে যে, এর নায্যতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এই ব্যবস্থাটি যে 'আর ভালোভাবে কাজ করছে না তা আজ পরিষ্কার। বিগত দুই দশকে বিশ্ব একটি একক বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্গত থেকে ক্রমাগত ব্যবসা আর মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের অধিকারগুলোকে সংকুচিত ওরে ফেলেছে। ফলে এর সাথে কোন প্রকার সমন্বয় করে আরো কিছুদিন চলার কোন সুযোগ নেই। দরকার এর আমূল পরিবর্তন; নতুন কোন কার্যকরী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা যার মুলে থাকবে বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা।
বিশ্ব আজ একটা তথ্য জালের অন্তর্গত; তাই সহজেই সবাই একত্রিত হয়ে আরেকটি বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি খুব একটা কঠিন নয়। এই একত্রিত প্রচেষ্টা বিশ্ব মানবতার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; আর এটাই হবে লেজেগোবরে আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার সত্যিকার বিকল্প।
আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।
ডিজিটাল বিশ্ব: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতা, সমাজ, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রভাবে পালটে গেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও রাজনৈতিক চর্চা। যে জাতির প্রযুক্তি যত উন্নত, সে জাতির বিশ্ব সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাবও তত বেশি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বৃহৎ পরিসরেমেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে। ইন্টারনেট অফ থিংসের (আইওটি) ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘটবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পঞ্চম প্রজন্মের থাকবে বিশেষ ভূমিকা। বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্ম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে এক তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পঞ্চম প্রজন্মের বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। এর সঙ্গে ভবিষ্যত অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ২০৩৫ সালের মধ্যে কেবল পঞ্চম প্রযুক্তিই বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ও ২২ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ হলো রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েনের বিরোধী ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্লকের মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধ। এতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর একটি বর্তমানের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি চীনের নেতৃত্বে চীন-রাশিয়া-ইরান-ভেনেজুয়েলা নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান শক্তি অর্জনকারী বাকি বিশ্ব এই দুই পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রগুলো জড়িত - মূলত এর মাধ্যেম বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে । একে দ্বিতীয় ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা নতুন স্নায়ুযুদ্ধও বলা হয়; কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রথম শীতল যুদ্ধ চলেছিল যার এক পক্ষ ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিশ্ব। বর্তমান শীতল যুদ্ধটি মূল প্রথম শীতল যুদ্ধের অনুরূপ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ব্লকের এবং রাশিয়ার পূর্বসূরীর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ব্লকের মধ্যে অচলাবস্থা এবং প্রক্সি যুদ্ধের শুরু করেছিল। বর্তমান সময়ে চীন আর মার্কিন বলয়ের মধ্যকার প্রতিটি বিরোধ প্রথম শীতল যুদ্ধকেই মনে করে দেয়। পেট্রোলিয়াম হতে তথ্য প্রযুক্তির প্রাধান্য
এক সময় তেল ছিল বিশ্ব রাজনীতির মূল স্বার্থ, যে স্থানটা এখন তথ্য বা ডাটার দখলে। তথ্যের মূল্যায়ন নিয়ে বহুদিন ধরেই গবেষণা চলছে, ২০১৭ সালে 'দ্য ইকোনোমিস্ট' তথ্যকে নতুন তেল বলে আখ্যা দিয়ে একটি স্টোরি প্রকাশ করে। তারপর থেকেই এই বিষয়ে বৈশ্বিক চর্চাটা তরান্বিত হয়। বর্তমানে, যার কাছে যতবেশি ডাটা, সে তত বেশি সম্পদশালী। প্রযুক্তি দানব গুগলের কথাই ধরা যাক, যাদের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ডাটা সংরক্ষিত আছে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির তালিকাতেও প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান উপরের দিকে। করোনা অতিমারীর আগ্রাসন
মহামারির কারণে সৃষ্ট নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে একটি গভীর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য শেয়ার, মানবীয় যোগাযোগ, তথ্য সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে ইন্টারনেট ও ইনোভেশনের প্রভাব অপরিহার্য। বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রচারণা ও জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো ডিজিটাল মাধ্যম। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়েও বিশেষ ভূমিকা রাখছে প্রভাবশালী এ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ থেকে বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় আমেরিকার হাতে। আমেরিকার একচেটিয়া রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তৈরির পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান যেমন ছিল, ভাঙন ধরার পেছনেও সেই প্রযুক্তির বিকাশই অনেকাংশে দায়ী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া ও চীন আমেরিকার চোখে চোখ রেখে ভূ-রাজনীতির হিসাব দিচ্ছে পাল্টে। প্রযুক্তির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে অর্থনীতিতে, পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ সব স্তরেই এর ছাপ পাওয়া যায়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। এর কারণ হিসেবে যাই উল্লেখ করা হয় না কেন তা আমাদের বাঘ আর ছাগলের পুরনো একটি নীতিগল্পের কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে ছাগল নদীর ভাটিতে থেকে পানি খাচ্ছিল। আর বাঘটি তার পানি ঘোলা করার অভিযোগ করে ছাগলের বিরুদ্ধে। ছাগল তার অবস্থানের কথা জানালে বাঘটি বলে,"তাহলে তোর মা পানি ঘোলা করেছিল। " আসলে বড় শক্তির দরকার একটি বাহানার - প্রয়োজন হলে কাল্পনিক অভিযোগ আনা হয়। এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, ৪ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে, এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পথে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু ইউরোপকে পরিবর্তন করে দেয়নি বরং সারা পৃথিবীর পণ্য পরিবহনকেই নতুন একটা মাত্রায় ঠেলে দেয়। এর ফলে বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন আর পণ্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। বিশ্বব্যাপী ব্যবসার নতুন নতুন দুয়ার চালু হয়েছে; পূর্বের চিরায়ত ব্যবসা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। পণ্যমূল্যের উর্ধগতি
২০২২ এর ফেব্রুয়ারী হতে আমাদের দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ হতে ১০০ শতাংশ - কোন কোনটি আরো বেশি; যেমন সয়াবিন তেলের কেজিপ্রতি ৯০ টাকা হতে প্রায় ২০০ টাকা। জীবন রক্ষার ঔষুধের মূল্য ৫০ হতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সব্জির মূল্য বেড়েছে সমান হরে; মাংস আর মাছের মূল্য প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে। করোনা অতিমারী দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির করে দিয়েছিল; সাধারণ মানুষ নিজেদের উপার্জন সক্ষমতা হারিয়ে ক্রমাগত শহর হতে গ্রামে স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না - জীবন যাত্রার মান এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে সাধারণ মানুষ কোনভাবেই সামলে উঠতে পারছে না। সাধারণের দীর্ঘশ্বাস
বেশির ভাগ মানুষ আজ সারা পৃথিবীতে এমন একটা অবস্থানে আসতে বাধ্য হয়েছে যে, নিজের জীবন চালাতে গিয়ে ক্রমাগত আপোষ করতে করতে আর পিছাতে পিছাতে যেন অস্তিত্বের সংকটে পরে গেছে। করোনা পরবর্তী অবস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের অভিগাত। প্রতিটি সেক্টরের মূল্যের উর্ধগতি পৃথিবী ব্যাপী মানুষের যে দুর্গতি সৃষ্টি করেছে তা এর আগে পৃথিবী কখনোই মোকাবেলা করেনি। তাই তাদের দীর্ঘশ্বাসে পৃথিবীর আকাশটা যেন ভারী হয়ে গেছে; এই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিইই বা করার আছে। মানবতার অন্তিম সংস্কার
ইউরোপীয় রেনেসাঁ পৃথিবীর মানুষকে নতুন মানবতার আশা জাগিয়েছিল। সাম্য আর মানবতার নতুন নতুন ইস্যুগুলো মানুষকে ক্রমাগত নতুন করে উজ্জীবিত করে চলেছিল। এই বিষয়টির দার্শনিক ভিত্তি মূলত ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত এসে নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এর বাস্তবায়ন বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল। অনেকের মতে, বিশ্ব তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল; আর তাই দুই শিবিরের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল; আর তার ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষদের অনেক দাবি পূরণ হয়েছে। সবকিছুর যেমন একটা শেষ আছে, তেমনি এই সুসময়টা এক সময় শেষ হয়ে যায়; মূলত গত শতকের নব্বইর দশকে প্রতিযোগিতার এক পক্ষের পরাজয়ের মাধ্যমে যখন একক বিশ্ব সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে। আর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বর্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার নেতৃত্বে তারা যে ব্যবসা আর লাভকেই প্রধান হিসেবে বিবেচনায় নিবে সেটা আর নতুন কি। তাই, গত শতকের শেষ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) পতনের মাধ্যমে যে মার্কিন একক আধিপত্যের শুরু হয়েছিল তার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে মানবতার সংস্কার হয়ে যায়। যেটুকু অধিকার সাধারণ মানুষ পেয়েছিল তার সবই অল্প কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা আর ব্যবসা
একক বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন নেতৃত্বে ব্যবসার ব্যাপক প্রসার হয় - যেটা মধ্যপ্রাচ্য হতে দূরপ্রাচ্য (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ননের তেল-প্রধান উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান আর কাজাকাস্তান) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পারে। নতুন নতুন সুযোগ তৈরী হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ব্যবসায়ীদের সামনে। এর সাথে যুক্ত হয় পুরনো সব অধিকার যা সাধারণ মানুষের জন্য উপযোগী তার সবই বিলীন করার মাধ্যমে। ফলে সারা পৃথিবীতে শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা - আর তত সাথে লাভ আর লাভ। মার্কিন, পাশ্চাত্য আর তাদের অনুগামী কোম্পানিগুলোর ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠার মাধ্যমে। সম্পদ এমনভাবে কিছু কোম্পানিগুলোর হাতে জড়ো হতে থাকে যাতে তারা মাল্টি বিলিওনার হতে ট্রিলিওনার কোম্পানিতে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থাগুলো যে সমস্ত পরিসংখ্যান পরিবেশন করেছে তাতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ মাত্র একশটি কোম্পানির হাতে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা
গত শতকের পঞ্চাশ হতে আশির দশক পর্যন্ত পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলো টিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে। এরপর নব্বই দশকের পর গণতন্ত্রের একটা ছদ্ম সময় পার হয়েছে - যেখানে নির্বাচন আর গণতন্ত্রের একটা চর্চা মার্কিন কর্তারা করিয়েছেন; যদিও ব্যবসাই ছিল মুখ্য। ইরাক আক্রমণ আর তার তেল সম্পদের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ এরই একটি উদাহরণ। এর সাথে মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার দেশগুলোতে ক্ষমতার পরিবর্তনের যে হিড়িক পরেছিল যে তও মূলত ব্যবসার ব্যাপক প্রসার করার স্বার্থে। তাই সবাই এমন একটা অবস্থায় পড়েছিল যে নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষাই একমাত্র মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। সবগুলো দেশ আর তাদের সরকারগুলো আপন প্রাণ বাঁচানোতে ব্যস্ত হতে পড়ে। আপনের চাইতে পর ভাল
বহুদিনের শত্রু-মিত্র নতুনভাবে চিত্রায়িত হতে থাকে - সোভিয়েত বলয়ে থাকা গাদ্দাফির লিবিয়া, সাদ্দাম হোসেনের ইরাক, চীনা বলয়ের ভিয়েতনাম প্রভূত দেশগুলো দ্রুত মার্কিন বলয়ে চলে যায়। যদিও গাদ্দাফি আর সাদ্দাম হোসেনের শেষ রক্ষা হয়নি। আবার নিরপেক্ষ বলয়ে থাকা সিরিয়া রাশিয়ান (সোভিয়েত বলয়ের বর্তমান উত্তরাধিকার) বলয়ে ভিড়ে গিয়ে নিজেদের এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছে। মার্কিন বলয়ের লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা নতুন চীনা বলয়ে ঢুকে গেছে। এমনটি হয়েছে আরো অনেক আফ্রিকান আর লাতিন আমেরিকান আরো কিছু দেশের ক্ষেত্রে। আর সবাই অপেক্ষায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের আশায়। স্বার্থ, স্বার্থ আর স্বার্থ
টিকে থাকার এই কঠিন সময়ে শুধু নিজ স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। আর যারা এর বিপরীত তারা আর টিকতে পারছে না। যেমনটি ক্রমাগত ভাগ হয়ে যাচ্ছে ইথিওপিয়া আর সুদান; বিভক্ত হয়ে গেছে পূর্ব তিমুর। আর শাসকরা তো বিবেচ্যই নয়; শ্রীলংকার রাজাপাকসে আর অতীত, পাকিস্তানের ইমরান খাঁন মামলা আর হামলায় বিপর্যস্ত। আর নিজ স্বার্থ রক্ষাই মূল বিবেচ্য নয়; বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির ব্যবসা-বাণিজ্যই প্রধান। যে সরকার যত বেশি মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে তারা তত বেশি সময় টিকে থাকবে। কঠিন সময়ের সম্মুখীন
একক বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েমের তিন দশক পর বিশ্ব অতিমারীর অভিগাত আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমরা একটা অতি কঠিন সময় পার করছে। বিশ্ব আজ গণতন্ত্র হতে বহুদূরে; সরকারগুলো যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বিশ্ব বাজারে আগুন আর বিতরণ ব্যবস্থার নতুন সমীকরণ বেশির ভাগ দেশ আর সাধারণ মানুষদের এমন একটা কঠিন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে বেশির ভাগ মানুষ আজ যেন অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত।
সামান্য কয়েকটা দেশ, অল্পকিছু কোম্পানি আর আরো সীমিত সংখ্যক মানুষ এই পৃথিবীর সবটুকু সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আছে। যেন এরাই আধুনিক বিশ্বের ঈশ্বর - যাদের ইচ্ছার উপরই দুনিয়া চলে। আর বাকি সবাই যেন পিঁপড়ের চাইতেও কম মূল্যবান। দরকার একত্রিত প্রচেষ্টা
যুগ যুগ ধরে মানব সমাজ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়েই মানব সমাজের নিরন্তর অভিযাত্রা; আর এর মোকাবেলার জন্য মানুষের হাতে ছিল নিজেদের একত্রিত হওয়া। একত্রিত মানব সমাজ সমস্ত সমস্যার অতিক্রম করতে সক্ষম। যে সমস্যায় সারা মানব জাতি আজ নিমজ্জিত; তাতে একমাত্র একত্রিত হওয়াই একমাত্র সমাধান। আজকের বিশ্ব বহু জাতি রাষ্ট্রে বিভক্ত- দেশগুলোও সীমানা দিয়ে পরিষ্কার বিভক্ত। তবে তথ্য প্রযুক্তির এই সময় সারা পৃথিবীর মানুষরা বড় বেশি কাছাকাছি। আর তাই, তাদের একত্রিত হওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়। দরকার শুধু একত্রিত হওয়ার একাগ্র ইচ্ছা। দরকার মানবিক দৃষ্টিভিঙ্গি
সমস্যাটি সারা মানব জাতির - তাই পুরো বিষয়টি একটি সামগ্রিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কারণ, সমগ্র মানুষের নিজের রক্ষার জন্যই সবার বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে। যদি কোন দেশ বা অঞ্চলের মত সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বাকী মানুষদের ক্ষেত্রে অনেক বড় অসুবিধার সৃষ্টি হয়ে পারে। বর্তমান সময়ে একটি বড় রাষ্ট্র রাশিয়া তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ইউক্রেন আক্রমণ করেছে যা ঐ অঞ্চলে একটি ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। যদি, বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হলে অবশ্যই যুদ্ধটি আর সৃষ্টি হতো না। এর শেষটা কোথায়
পৃথিবীর শাসন-ব্যবস্থার দিকে তাকালে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার - সেটা হল ক্ষমতায় থাকে অল্প কিছু মানুষ আর বেশির ভাগ মানুষকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই ব্যবস্থায় মূলত সম্পদ অতি অল্প কিছু মানুষের হাতে জমা হতে থাকে। এটাই আধিপত্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার মূল বিষয়। অল্পকিছু মানুষ একটা বিশাল সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণকরবে এটাই বর্তমান শাসন ব্যবস্থার আসল রহস্য। আর তাই, এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কোন স্বার্থই রক্ষিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ফলে এই অবস্থার স্থায়িত্ব যত বেশি থাকবে, ততই সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে। আসলে এর শেষে কখনোই ভাল কিছু নেই। ভাল কিছু পেতে সাধারণ মানুষকেই উদ্যোগী হয়ে একটি আন্তরিক আর অব্যাহত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আর অবশ্যই সাধারণ মানুষকে একতাবদ্ধ হতে হবে এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য। পরিশেষে
আধিপত্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা আজ একটা সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। অল্প কিছু মানুষ সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে এমন একটা সময়ের সামনে উপস্থিত হয়েছে যে, এর নায্যতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এই ব্যবস্থাটি যে 'আর ভালোভাবে কাজ করছে না তা আজ পরিষ্কার। বিগত দুই দশকে বিশ্ব একটি একক বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্গত থেকে ক্রমাগত ব্যবসা আর মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের অধিকারগুলোকে সংকুচিত ওরে ফেলেছে। ফলে এর সাথে কোন প্রকার সমন্বয় করে আরো কিছুদিন চলার কোন সুযোগ নেই। দরকার এর আমূল পরিবর্তন; নতুন কোন কার্যকরী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা যার মুলে থাকবে বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা।
বিশ্ব আজ একটা তথ্য জালের অন্তর্গত; তাই সহজেই সবাই একত্রিত হয়ে আরেকটি বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি খুব একটা কঠিন নয়। এই একত্রিত প্রচেষ্টা বিশ্ব মানবতার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; আর এটাই হবে লেজেগোবরে আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার সত্যিকার বিকল্প।
আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।
এই বিভাগের আরো সংবাদ