আজকের শিরোনাম :

বিভাজিত বিশ্বে কৌশলগত কর্তৃত্ব অর্জনে মার্কিন-চীন মরিয়া ছায়া-যুদ্ধ

  আলাউদ্দিন মল্লিক

০৪ জুন ২০২৩, ১৬:৪১ | আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৬:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
পুঁজিবাদই শেষ কথা (১৯৮৯)
১৯৮৯ সালে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘দি এন্ড অব হিস্ট্রি’ -তে জোরের সাথে উল্লেখ করেন, ‘মানবজাতির মতাদর্শগত বিবর্তন শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে।’ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদারতায় অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের প্রত্যাশায় তিনি নীতিনির্ধারণ এবং এরই মধ্যে অধিকাংশ একাডেমিয়ার মানসম্মত পদ্ধতিতে পরিণত হওয়ার মতটির প্রচারক হিসেবে আবির্ভুত হন । বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের এই মতটি দুটি স্বতন্ত্র বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল:  প্রথমটি রাজনৈতিক উদারতাবাদ এবং অন্যটি হলো অর্থনৈতিক উদারতাবাদ। 

উনিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি হতে বিশ্ব নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হয় - দুই বিশ্ব ব্যবস্থার একটি যা সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিল তার পতন হতে শুরু]হয়; একমাত্র পুঁজিবাদই নিয়ন্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।  আর আমার বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের একক নিয়ন্ত্রণের চলে যায়।

গণতন্ত্রই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল -  ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা 
মানবতা তার নিজ অস্তিত্বের বেশির ভাগ সময়জুড়ে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার এবং আইনহীনতার মুখোমুখি ছিল। কিন্তু যখন থেকে গণতন্ত্র তার আধুনিক রূপে উদ্ভাবিত হয়েছে, তখন থেকেই গণতন্ত্রের এ ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যসব বিকল্প মতাদর্শ (নিরঙ্কুশবাদ, ফ্যাসিবাদ, সাম্যবাদ) ব্যর্থতার মুখ দেখার পর বহু পশ্চিমা এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে তাদের গণতন্ত্রের মডেলটি শেষ পর্যন্ত সর্বত্র জয়লাভ করবে, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মতো জায়গাতেও যেখানে খুব কম বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাস নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষ একটি দাবির কণ্ঠস্বর তুলবে, এমনকি লৌহ মুষ্টিবদ্ধ স্বৈরাচারীরাও এ পশ্চিমা ধারণার প্রভাব থেকে নিজেদের প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না।

নিশ্চিত করে বললে, প্রক্রিয়াটি কখনই নির্বিঘ্নে উন্মোচন হবে না। ফুকুইয়ামা এবং আরো অনেকে যারা তার মতো দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন তারা বুঝতে পেরেছিলেন গণতন্ত্রের বিজয়ে কয়েক দশক লেগে যাবে। এতে থাকবে বিদ্রোহ, বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ এবং সমগ্র সমাজব্যাপী বড় আকারের বিঘ্নতা ঘটবে। তবুও ইতিহাসের চাকা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছে।

চীনের উত্থান: নতুন অর্থনৈতিক যুদ্ধের সূচনা 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রায় চল্লিশ বৎসর (১৯৫০-১৯৯০) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে  নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এক প্রবল সামরিক আর আদর্শিক শক্তির মোকাবেলা করতে হয়; আর এই মোকাবেলার শেষ হয় দ্বিতীয় শক্তির পতনের মাধ্যমে।  তখন সমগ্র বিশ্ব মার্কিন একক নেতৃত্ব বলয়ে চলে যায়।  এই দীর্ঘ চার যুগের লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন আবির্ভুত হয়।  আর লড়াইটা ক্রমান্বয়ে মার্কিন আর চীনের অর্থনৈতিক যুদ্ধে পরিণত হয়।

বিভাজিত বিশ্ব 
গত শতকের শেষ দশকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে একক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার শুরু হয়েছিল;যাকে অনেকেই একমাত্র আর শেষ ব্যবস্থা বলে রায় দিয়েছিল তারও আয়ু মাত্র দুই দশকের সীমায়িত। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে চীন-মার্কিন যুদ্ধ এমন একটা পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে যে বিশ্ব বহু কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে।  নতুন নতুন স্থানীয় নেতার আবির্ভাব হয়- চীন এর মধ্যে বৃহৎ; রাশিয়া অন্যতম, ব্রাজিল আর তুরস্ক অন্যতম, এমনকি ইরান আর সৌদি আরবও কম যায়না।

বিপর্যস্ত সাধারণ 
গত সাত দশকে বিশ্ব ব্যবস্থার এই উলট-পালট পরিবর্তন ছোট ছোট আর দরিদ্র দেশগুলোর জন্য মানিয়ে চলা একটি মহা সমস্যার বিষয়ে পরিণত হয়। এতে নানা ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে দেশগুলোকে। দেশগুলোর ক্ষমতার পালা বদলও ঘটে গেছে- শ্রীলংকা আর পাকিস্তানের ক্ষমতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা যে শুধু দেশগুলোর শাসকদের ক্ষমতা পরবর্তন হয়ে গেছে তাই নয়; এর সাথে সাথে সাধারণ মানুষদের ভাগ্যে অনেক বিড়ম্বনা জুটেছে। গত এক বৎসর বিশ্ব ব্যাপী ছোট আর দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় চলছে তার ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ।

সমাধানের সমস্যা 
সাধারণের অনুকূলে একটি টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বেছে নেওয়া বর্তমানে প্রায় অসাধ্য কাজ। গণতন্ত্র যা অত্যন্ত ধীরগতির আর সাধারণের জন্য অনেকাংশে বিরক্তকর তার উপর নির্ভর করে চলা বিশ্ব ব্যবস্থা আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে নতুন নতুন চটকদার বিশ্ব ব্যবস্থার হাতছানি সবার জন্য একটি দূরান্ত মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে।  

প্রাথমিকভাবে এর বিস্তৃত উপকারিতা সত্ত্বেও গণতন্ত্র যেকোনো সময়ে একনায়কতন্ত্রকে পরাজিত করতে পারে না। বিঘ্ন সৃষ্টিকারী নতুন প্রযুক্তির এ সময়ে, অসমতা ও বিশ্বায়নের উত্থানে ‘সংকীর্ণ করিডর’ ধারণার কথা বলা হয়। এটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থা যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সমৃদ্ধি হচ্ছে এমনকি সংকীর্ণতর হওয়ার ক্ষেত্রেও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানো অতীতের তুলনায় কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।  গত দুই দশকে প্রযুক্তি যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছে যে এটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা অবমূল্যায়ন করছে। সেই সঙ্গে একনায়কদের তাদের জনগণকে নিয়ন্ত্রণ ও মগজ ধোলাইয়ের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করছে। হ্যাঁ, এখনো আমরা কীভাবে নতুন প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে সেটি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হইনি, এমনকি এসব নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে মুখ্য কৌশল কাজ করেছে সেটি সম্পর্কেও নয়। 

সমাধানের সন্ধানে 
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম থেকেই পৃথিবীর মানুষ আর তাদের শাসকরা মূলত দুইভাবে তাদের সময়কার পৃথিবীকে শাসন করেছেন- প্রবল প্রতাবশালী একজন শাসক যিনি তার সময়ের পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে গেছেন; আর ছোট ছোট শাসকরা যারা বড় শাসকদের অনুকম্পায় শাসন করেছেন। আর সাধারণ মানুষ যারা শাসনে একেবারেই অপাংতেয়। গত শতকের প্রথম হতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রসার হতে থাকে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে। এই শাসন ব্যবস্থাটি সাধারণ মানুষের অধিকার কিছুটা দিতে শুরু করেছে- তাই মানুষ এর উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছে। 

বিশ্ব আজ দুই বলয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে; ছোট ছোট আর দরিদ্র দেশগুলোকে এর যেকোন এক দেশের সাথে যেতে হবে।  বিশ্বে ল্যাটিন আমেরিকান বেশ কিছু দেশ আর আফ্রিকার বহু দেশ এরই মধ্যে চীন বলয়ে চলে গেছে। চীন অর্থনৈতিক শক্তির উত্থান দ্রুত গতিতে এই বিভাজন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক যুদ্ধ নতুন নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে। এতে বিশ্বের কিছু দেশের আপাতঃ উপকার হলেও শেষ বিচারে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমস্যা হয়। 

কর্তৃত্বের ছায়া যুদ্ধ 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চার দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (যা বর্তমানে রাশিয়া) সাথে আদর্শিক আর সামরিক ছায়াযুদ্ধ চালিয়েছে। এর মানে যেখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি সেখানেই মার্কিন উপস্থিতি - যদিও সরাসরি নয়; সাহায্যের মাধ্যমে। এশিয়া, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে এই ছায়াযুদ্ধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে; আফগানিস্তান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ছায়াযুদ্ধ বিশ্বকে একটি অনিয়ন্ত্রিত সামরিক যুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেয়। বিশ্ব সামরিক ব্যয় বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যে, মনে হয় খাদ্য কোন ব্যাপার নয়; যুদ্ধই একমাত্র সমাধান।  আর অস্ত্র ব্যবসায়ে প্রাধান্য বিস্তারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ বিচারে জয়ী হয়।  কারণ তার অস্ত্র বিশ্বব্যাপী সমাদৃত; আর তার অর্থনীতি অস্ত্র ব্যবসা ভিত্তিক। 

১৯৯০ এর পর মার্কিনীরা নতুন যুদ্ধক্ষেত্র শুরু করে - সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করার মাধ্যমে। এই তালিবান আর আল কায়েদার মাধ্যমে মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু হয় তার শেষ হতে না হতেই শুরু হয় আইএস বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে।  কিন্তু মাত্র দুই দশকের মধ্যে চীন বিরোধী অর্থনৈতিক যুদ্ধের শুরুর মাধ্যেম আরেকটি ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  এই দেশটির পরিকল্পনাবিদরা প্রতিটি বিষয়ে মোটামুটি দুই/তিন দশক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ফেলে।  দেশটির নেতৃত্বের যোগ্যতা আর পরিপক্কতা এতটাই অসামান্য যে গত ২৪৭ বৎসর ক্রমান্বয়ে আঞ্চলিক থেকে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে। 

বর্তমানে যে কর্তৃত্বের যুদ্ধ চলছে তাতে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা একবারে রাশিয়া আর চীনের বিরুদ্ধে বুদ্ধির খেলে চালাচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন নতুন জোট (Quad, AUKUS ইত্যাদি) করার মাধ্যমে। আর এইসব কর্মকান্ড বিশ্ব এমন একটা অবস্থানে চলে গেছে যে, ছোট ছোট আর দরিদ্র দেশগুলো পড়েছে মহাবিপদে; তার সাথে দেশগুলোর সাধারণ মানুষ পড়েছে মহা মহা বিপদে।  বিশ্বব্যাপী যে নতুন ছায়াযুদ্ধ চলছে তার শেষ কি হবে তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

পরিশেষে 
শেষ বিচারে যার কাজ তাকেই করতে হবে।  আর তাই সাধারণ মানুষকেই তাদের নিজেদের ভালোটা বুঝে নিতে হবে। এই কাজটা কোন নেতা বা অন্য কেউ করে দেবে না। যদি সাধারণ মানুষ নিজেদের ভালোটা বুঝতে পারে আর যদি নিজেদের উদ্যোগ বজায় রাখতে পারে তাহলে নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেই বের করতে পারবে। কারণ বিশ্ব চলমান ব্যবস্থা সাধারণের অনুকূল নয়। এর জন্য দরকার সাধারণের জ্ঞান ভিত্তিক প্রচেষ্টা।

 

আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ