আজকের শিরোনাম :

আমাদের মাটির ছেলেরা...

  কাজী বনফুল

৩০ মে ২০২৩, ১৩:২৬ | আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৬:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

কিছুদিন আগে একটি ছেলে মেঘনা নদীতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নিজেকে বিলীন করেছে অসীম শূন্যতায়। ছেলেটির হারিয়ে যাওয়ার সেই মুহূর্তের সিসিটিভি ফুটেজটি দেখলাম এবং ভিডিওটি দেখার পর হৃদয়ের গভীরে এক অতৃপ্ত চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। এমন তাজা পুষ্পের মতো জীবন এত সহজেই হারিয়ে গেল কিন্তু কেন? কেন আমাদের মাটির ছেলেরা কিছুদিন পরপর এমন করে হারিয়ে যায়, যারা আমাদের স্বপ্নের সারথি হওয়ার কথা ছিল, যারা হবে পরবর্তী দিকপাল, পথপ্রদর্শক কিন্তু কেন তারা মুখ লুকায় অজানা দিগন্তে! এই হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত।

মানুষ আসলে দুইভাবে হারিয়ে যায়। এক. মানসিকভাবে। দুই. শারিরীকভাবে। একটা মানুষ মানসিকভাবে হারানোর পরই সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শারীরিক প্রস্থানের। আর সেই দৃশ্যমান শারীরিক প্রস্থানকেই আমরা অপমৃত্যু বলি। মৃত্যুর আগে অপ শব্দটিকে যোগ করে আমাদের এই সমাজ বিবেক ও শব্দ বিশারদরা বুঝাতে চেয়েছেন যে এটা একটা খারাপ মৃত্যু এবং এই মৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে সে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে। তাই তারা এই মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে নামকরণ করেছেন।

ছেলেটার যখন প্রথমে মানসিক মৃত্যু ঘটেছিল, তখন সে হয়তো শারীরিক মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য  বিভিন্ন জীবন বাঁচানোর বিপণি প্রতিষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে গিয়েছিল একটু বেঁচে থাকার আশ্রয়ের খোঁজে, কিন্তু তারা হয়তো আশা দিয়েছিল, সান্ত¡না দিয়েছিল, কিন্তু কোনো সুযোগ বা মুক্তি দেয়নি। কিন্তু মৃত্যুর পরে তারাই শব্দগতভাবে নাম দিয়েছে অপমৃত্যু বা খারাপ মৃত্যু। 

যে ছেলেটি নিজেকে হত্যা করেছে তার একটি ভালো ও স্বাভাবিক  মৃত্যুর জন্য যে মসৃণ ও প্রসস্থ পথের দরকার ছিল , সেটা কি সে আদৌও  পেয়েছে? পায়নি বরং আমাদের সমাজ এবং সামাজিক চাপের কারণে স্বয়ং তার পরিবারও তার জীবনটাকে সর্বদিক দিয়ে করেছে বিপর্যস্ত, আকাশ সমান বোঝা  তার মাথায় উঠিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চেয়েছে সবাই।

আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেখানে একটা পড়াশোনা শেষ করা ছেলেমেয়েকে মাপা হয় একটি নির্দিষ্ট চাকরির গন্ডিতে। তার বাইরে তার কোনো স্থান নেই, তার কোনো জীবন নেই, অনুভূতি নেই, কোনো সম্মান নেই, কোনো অবস্থান নেই। আমি একবার এক অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম একজন চিত্রশিল্পীর বসার চেয়ারটা কেড়ে নিয়ে একজন ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করা ব্যক্তিকে চেয়ারটাতে বসতে দেওয়া হয়েছিল।

 

আরেকবার এক অনুষ্ঠানে একজন সুরকারকে দেখেছিলাম অনুষ্ঠানের এক কোণে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। কেউ তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছে না কারণ তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য।

সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হচ্ছে সেই সব ব্যক্তিবর্গ যাদের মানুষকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজ শুধুমাত্র তাদেরই মূল্যায়ন করছে যারা কোন না কোন ভাবে মানুষকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে।

আমাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি পরিণত হয়েছে ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করার ওপরে। তাই সমাজ ও পরিবার চায় পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েটা এমন কিছু করুক যাতে তাকে দেখে মানুষ ভয় পায় যার সম পরিমাণ ভয় দেখানোর ভাগ তারাও ভোগ করতে পারে। এজন্য আমাদের সমাজের অন্য সকল পেশাজীবী মানুষ কোনো রকম মুখ লুকিয়ে বাঁচে।

প্রদোষের আলোয় যেমন সব কিছু আবছা ও ভাসা ভাসা দেখা যায় আমরাও ঠিক সেইভাসা ভাসা অবস্থায় আছি ডুবতে আমাদের খুব বেশি দেরি নেই। আমাদের সব কিছু এখন পুরাতন বাংলা খবরের কাগজের ছবির মতো অস্পষ্ট ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের এখন আর কে নো দার্শনিক নেই, নেই কোনো শিল্পী, নেই কোনো লেখক, নেই কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ। এখন আমাদের মানসম্মত কোনো কবি নেই, যা আছে তা শুধু ছবি আর ছবি। দু-চারজন সুচিন্তার মানুষ যারাই আছে, তারা কোনো রকম গোপনে নিভৃতে জীবনকে অতিবাহিত করছে মাত্র। এককেন্দ্রিক কর্মের ঝোঁক আমাদের জীবনকে জীবন থেকে দূর বহুদূর নিয়ে গেছে। জীবনকে অনুভব বা উপলব্ধি করার এখন আর আমাদের কোনো সময় নেই। সবাই কেবলই দৌড়ের উপরে জীবনের মূল্যবান সময় অতিক্রম করছে মাত্র । কেউই বুঝতে পারছে না ‘জিন্দিগি না মিলে দোবারা’।

আজ যে ছেলেটা বেকারত্বের কারণে মেঘনা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, তার এই আত্মহত্যার মূল কারণ হচ্ছে  এই সামাজিক অবমূল্যায়ন। সমাজ তাকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েঝে যে পড়াশোনা শেষ করে সে আসলে এখনো কোনোপ্রকার ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সে একটা অথর্ব সে এই সমাজের বোঝা তাকে দিয়ে সমাজের কোন উপকার হবে না কারন তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য। তার মানে তার অবস্থানও এই সমাজের কাছে শূন্য। অতএব  কোন মানুষই শূন্য অবস্থায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়না তাই সে এই পথ বেছেঁ নিয়ে নিজে শূন্যতায় হারিয়ে গিয়ে সমাজকে দিয়েছে পূর্ণতা।

কেন আমাদের মাটির ছেলেরা নিজেদের এভাবে হত্যা করছে?

লেখক : কলামিস্ট

এই বিভাগের আরো সংবাদ