আজকের শিরোনাম :

সতর্ক ও সময়োচিত বাজেটের প্রত্যাশা

  অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান

২৭ মে ২০২৩, ১৫:১১ | অনলাইন সংস্করণ

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান
‘কেমন বাজেট চাই?’ প্রতিবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের আগে আগে বিশেষ করে মে মাস জুড়ে প্রশ্নটি সামনে আসে গণমাধ্যমসহ বৃহত্তর জনপরিসরে। বাজেটকে ঘিরে সবস্তরের নাগরিকেরাই তাদের প্রত্যাশা জানান দেন। আর গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাতে সেই প্রত্যাশাগুলো আমরা সবাই জানতে পারি।

ব্যক্তিগত বিবেচনার জায়গা থেকে বাজেটের কাছে প্রত্যাশাটুকু স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়তো সহজ। তবে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আসন্ন অর্থবছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত—তা নির্মোহভাবে তুলে ধরা মোটেও সহজ নয়।

বিশেষ করে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট কেমন হওয়া উচিত—এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দেওয়া আরও কঠিন। কারণ করোনা পরবর্তী ধাক্কা সামাল দিয়ে উঠতে না উঠতেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার জেরে আমাদের অর্থনীতিও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ডলার ব্যয় কমানোর তাগিদের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নাগরিক সুরক্ষা দেওয়ার চাপ রয়েছে।

অন্যদিকে বছর শেষে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাজেটে কিছু জনতুষ্টিবাদী উদ্যোগও রাখতে সচেষ্ট থাকবেন। সর্বোপরি বৈশ্বিক বাস্তবতার ঘন ঘন পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপযোগী আর্থিক পরিকল্পনা দাঁড় করানোর কথাও মাথায় রাখতে হবে।

এমন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে আসছে বছরের জন্য কেমন বাজেট হওয়া দরকার—এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দেওয়া তাই কেবল দুরূহই নয়, বরং অনেকটা অসম্ভব। তবুও বলা যায়, আমাদের প্রত্যাশা—আসছে অর্থবছরের জন্য সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনায় যেন খুব বেশি উচ্চাভিলাষী না হয়ে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতি যথাযথ সংবেদনশীল থাকা যায়।

পাশাপাশি বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় যারা বেশি বিপাকে পড়ছেন সেই প্রান্তিক বা কম আয়ের মানুষগুলোর জন্য সময়োচিত সুরক্ষার ব্যবস্থাও বাজেটে করা হয়। অর্থাৎ, আমাদের প্রত্যাশা একটি সতর্ক ও সময়োচিত বাজেটের।

এই প্রেক্ষাপটে প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা বলে আসছিলাম আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সরকার সেই হারে রাজস্ব বাড়ছে না। কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের আশেপাশেই আটকে থাকছে। কিন্তু সমতুল্য অন্য অর্থনীতিগুলোর গতিপথ বিবেচনা করে আমাদের মনে হয়েছে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ করা খুবই সম্ভব।

ইদানীং আইএমএফসহ অন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারের আয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছে। জিডিপির অন্তত আধা শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের তাগিদ দিচ্ছে তারা। তাই আসছে বছরের বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিকে আগের তুলনায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন নীতিনির্ধারকরা।

সন্দেহ নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য। তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে আগালে এই লক্ষ্য অর্জন খুবই সম্ভব। রাজস্ব নিয়ে বিশেষত বৃহৎ করদাতাদের সঙ্গে যে বিপুল পরিমাণ মামলার জট রয়েছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে অল্টারনেটিভ ডিসপুট রেজল্যুশনসহ (এডিআর) প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে রাজস্ব আয়ে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা নিশ্চয় সম্ভব।

তবে আগামীতে রাজস্ব আরও বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আয় বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রমে হাত দেবে, ভ্যাট আদায় বাড়াতে জুন থেকে ইএফটি মেশিন স্থাপন কার্যক্রম শুরু করা হবে, বাড়ানো হবে কর আদায়ের ক্ষেত্র।

রাজস্ব বোর্ড ও সরকারের দিক থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য এমন আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সূত্রপাত নিশ্চয়ই এবারের বাজেটে দেখার আশা আমরা করতে পারি। তবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি এক্ষেত্রে সমাজের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে সেটিও আমাদের মনে রাখতে হবে। সবাই যেন রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নিজের কর সঠিক সময়ে প্রদান করতে উদ্বুদ্ধ হন তা নিশ্চিত করতে একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা আমরা ভাবতেই পারি।

আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার এই সঙ্কটকালে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষদের সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। তা না হলে সমাজে বাড়তি অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার মতো পথে না হাঁটার পরামর্শই আসছে। কারণ এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়ার কারণে যাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার তাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যয় বেড়ে যায়। তারচেয়ে যথাযথ টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে আসলেই যাদের সহায়তা দরকার তাদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছানোই বেশি কার্যকর।

করোনাকালীন অভিজ্ঞতাও তাই বলে। আর ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কল্যাণে ‘টার্গেটেড ক্যাশ ট্রান্সফার’ তো এখন অনেকখানিই সহজ হয়ে গেছে। তবে কয়েক বছর ধরে আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী ও সম্ভাব্য উপকারভোগীদের যে ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির কথা বলে আসছি সেটি এজন্য খুবই দরকারি। এছাড়া প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর পাশাপাশি নতুন বাস্তবতার নিরিখে কিছু উদ্ভাবনী কর্মসূচি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগও বাজেটে রাখা যায়।

কৃষি খাতের দিকে যে নীতি মনোযোগ আমরা বিগত বেশ কয়েক বছর থেকে দেখছি তার ধারাবাহিকতা আসছে অর্থবছরেও রক্ষা করতে হবে। এই খাত যে আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ করোনাকালেও তার প্রমাণ দেখেছি। চলতি অর্থবছরে আগের (২০২১-২২) বছরের চেয়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি বরাদ্দ রেখে মোট ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি ভর্তুকি বাবদ।

সোলার ইরিগেশন পাম্প ব্যবহার করে সেচ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ানোর জন্য কিছু বাজেটারি প্রণোদনার কথা ভাবা যায়। এই কাজ করা গেলে সেচের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে কম রাখা সম্ভব হবে। ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির চাপ থেকে কৃষি তথা গোটা অর্থনীতিকেই আরেকটু সুরক্ষিত করা যাবে। অর্থনীতির চাকাকে প্রত্যাশিত মাত্রায় গতিশীল রাখতে কৃষির পাশাপাশি মনোযোগ দিতে হবে এমএসএমইগুলোর দিকেও।

করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির গতি ঠিক রাখার জন্য অন্যতম প্রধান সহায়কের ভূমিকায় আছে। তাই এসএমই ফাউন্ডেশনে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে সামনের দু-তিন অর্থবছরের জন্য কর ছাড়ের কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

তাদের জন্য পুনঃঅর্থায়নের যে সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে দিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন এবং তার কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল মনিটরিং চালু করে তার ‘এন্ডইউজ’ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থনীতির পাটাতন আরও জোরদার করা সম্ভব।

আসন্ন বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লাগাম তো টেনে ধরতেই হবে। তবে তা হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষদের সুরক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিয়েই।

চলমান বিশ্ব আর্থিক সংকটের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন পর্যন্ত যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার ভিত্তিতে তা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নিশ্চয় রয়েছে।
 

ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

এই বিভাগের আরো সংবাদ