আজকের শিরোনাম :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো সাহসী উচ্চারণ নাকি অবিমৃষ্যকারীতা

  আলাউদ্দিন মল্লিক

২০ মে ২০২৩, ১৯:২২ | আপডেট : ২০ মে ২০২৩, ১৯:২৫ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে
১০ এপ্রিল ২০২৩ জাতীয় সংসদে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আনা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাব ও অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন:
" আমেরিকা চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে। "  বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেছেন, "তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে যাচ্ছে।"  তিনি আরো যোগ করেন, ‘গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে—তার গণতান্ত্রিক কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। আর সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের করে। পদলেহন করে।’ - 

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বেশ কিছুদিন যাবত আমেরিকার সমালোনায় সরব হয়েছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে দৃঢ় কন্ঠে ক্রমাগত আমেরিকার সমালোচনা করছেন, তাতে অনেকে বেশ অবাক হচ্ছেন। গত এপ্রিল মাসে  সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবার সময় হতে সর্বশেষ লন্ডনে বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারেও তিনি আমেরিকার সমালোচনা করতে পিছ-পা হননি।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য এবং সরাসরি সমালোচনার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল যে দুই দেশের মধ্যে হয়তো কিছু 'অস্বস্তি' তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, যখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা। ঢাকার নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল আগেই। মি. হাস যখন নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল হক সুমনের ঢাকার শাহীনবাগের বাসায় যান তখন ক্ষোভ চেপে রাখেননি আওয়ামী লীগ নেতারা।

র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আর নির্বাচন ঘিরে চাপ- এই দুটা বিষয় মূলত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও নির্বাচন নিয়ে চাপ থাকার বিষয়টি সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের নেতারা কখনোই স্বীকার করেন না। র‍্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ থাকার বিষয়টি প্রতীয়মান হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’হঠাৎ করে আমরা দেখলাম, আমাদের প্রশাসনের ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। কেন? তারা নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।" "অথচ এই বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিদের, সর্বহারাদের অনেক তৎপরতা ছিল। এই র‍্যাবকে দিয়েই তাদের দমন করে বাংলাদেশে শান্তি আনা সম্ভব হয়েছে।‘’

ক্ষোভের আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন ইস্যু। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে আমেরিকা। এর বড় কারণ হচ্ছে, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো সমালোচনা আছে। গত কয়েকমাসে আমেরিকা এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে আমেরিকার তরফ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মধ্যে যখন বৈঠক হয়, সেখানে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়। মি. ব্লিঙ্কেন সে বৈঠকে বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে আমেরিকা এবং পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে।

গণতন্ত্র কি শুধু মার্কিনদের নিজেদের জন্য
যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে— গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সেদেশটি হচ্ছে গভর্নমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। বলেছিলাম, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিকটেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন? আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।’

প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নটি আসলে সমস্ত গণতন্ত্রকামী মানুষের। মার্কিন ক্ষমতা যেন বিশ্বময় সমস্ত স্বৈরাচারী এক একনায়ক ক্ষমতাসীনদের সহায়ক শক্তি হিসেবেই সবাই দেখেছে। গত শতকটার পুরোটাই একই চিত্র দেখা গেছে।  এই শতাব্দীতে এসে এর কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও পুরো বাস্তবতা একই।  আফ্রিকার আর ল্যাটিন আমেরিকার স্বৈরাচারী দেশগুলোর মূল সমর্থনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই বৈপরীত্য সত্যিই অবাক করার মত।

মার্কিন গণতন্ত্রের দুইটি শক্ত হাত 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি আর সমর্থন মূলত বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ এই  দুইটি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল- যারা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ করে।  এই পশ্চিমা অর্থনীতির বাস্তবতায় বিশ্ব এদের প্রেসক্রিপশনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। যদি আফ্রিকার উন্নয়নের রোল মডেল আলোচনায় আনতে গেলে গত শতকের ষাট এন্ড সত্তরের দশকের নাইজেরিয়ার নাম আসবেই। তেল আর গ্যাস উৎপাদনের জন্য মার্কিন কোম্পানিগুলোর কর্মকান্ড আর তার প্রচারণা এমন একটা মাত্রা পেয়েছিল যে, নাইজেরিয়া উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু মাত্র তিন দশকের মধ্যে দেশটি একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে যখন তেল কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা শেষ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়।  এই উন্নয়নের প্রচারনা কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্ক আর আইএমএফ এবং সাথে পশ্চিমা মিডিয়া পুরোপুরি যুক্ত। সময়ের সবচেয়ে বড় কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল- নাইজেরিয়ার প্রকৃত উন্নয়ন না হলেও পশ্চিমা দুনিয়া নিজেদের ব্যবসার আর ক্ষমতার স্বার্থে তাকে ক্রমাগত তোল্লা  দিয়ে গেছে। আফ্রিকান দেশটি দারিদ্রের অতলে ডুবে গেলেও বিশ্ব ব্যাঙ্ক আর আইএমএফ তার অর্থনীতির মোড়লের ভূমিকা বজায় রাখতে পেরেছে।

আছে দেশে দেশে সামরিক ঘাঁটি 
সারা বিশ্বে আমেরিকার প্রায় ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ইরাকে যেসব ঘাঁটি এখনো চালু রয়েছে সেসব ঘাঁটিকে বিবেচনায় নিলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এসব ঘাঁটি পরিচালনার জন্য প্রতি বছর প্রায় ১৫৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।  অবাক করা তথ্য হচ্ছে- ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের কাজ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তবে সারা বিশ্বে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বেশিরভাগ আবির্ভূত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সে সময় আমেরিকা বিশ্বনেতায় পরিণত হয় এবং জাপান ও জার্মানিতে শান্তিরক্ষীর দায়িত্ব পালন করে। কোরিয় উপদ্বীপের যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধও বিভিন্ন দেশে মার্কিন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার কাজ জোরদার করে।    
জাপান, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো যেখানে গণতন্ত্র সুসংহত রয়েছে। তারপরও এসব দেশে বহুসংখ্যক মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে এবং এসব দেশে আমেরিকার হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও আমেরিকা তার ঘাঁটি অক্ষত রেখেছে এবং সেসব ঘাঁটিতে সামরিক কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। 

মার্কিন এসব ঘাঁটি আমেরিকার সরকারকে বিনা চ্যালেঞ্জে তার কৌশল বাস্তবায়নের পথ করে দিয়েছে। এ কারণে সহজে সে কৌশলে পরিবর্তন আসবে- তা ভাবার সুযোগ নেই। বরং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় কথিত সন্ত্রাসী হামলার পর এ পর্যন্ত সাতটি দেশে নতুন করে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে মার্কিন সরকার। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৮০টি দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ঘাঁটির জন্য ৮,৪৫,৪১১টি ভবন ও সরঞ্জামাদি রয়েছে আর জায়গা নিয়েছে তিন কোটি একর। সে হিসাবে পেন্টাগন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভূমি-মালিক। বলার অপেক্ষা রাখে না- বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব খনিজ সম্পদ রয়েছে তার ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আমেরিকার বড় লক্ষ্য। এছাড়া বিশ্ব অর্থনীতি ও তার আর্থিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করাও আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এসব লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে সামরিক দিক দিয়ে একক অধিপতি হয়ে বসা ছাড়া আমেরিকার কথা গুরুত্ব পাবে না মার্কিন সরকারের সামনে সে বিষয়টি পরিষ্কার।

শীতল যুদ্ধ 
স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War)  হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপোড়েনের নাম। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০'র দশকের শেষ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী সময়কালে এই দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা নিয়ন্ত্রণ করত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে; আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রপন্থী। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান মিত্র ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডা। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র, যেমন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া। স্নায়ুযুদ্ধের কিছুকাল যাবৎ কিউবা এবং চীন সোভিয়েতদের সমর্থন দেয়। যেসমস্ত দেশ দুই পক্ষের কাউকেই সরকারিভাবে সমর্থন করত না, তাদেরকে নিরপেক্ষ দেশ বলা হত। তৃতীয় বিশ্বের নিরপেক্ষ দেশগুলি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। অবশেষে  গত শতকের নব্বইর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাটকীয়  পতনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। এর মাধ্যেম বিশ্ব মোড়ল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থান তৈরী হয়।

অনন্ত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ
২০০১ সালের  ১১ ই সেপ্টেম্বর চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে সেগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবন ও মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে। কার্যত এই সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়েই খুলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে অন্য দেশে আগ্রাসন চালানোর দরজা। আর ওই আগ্রাসনকে নাম দেওয়া হয় ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হল যুক্তরাষ্ট্র ও এর অন্যান্য মিত্র দেশের দ্বারা সূচিত একটি যুদ্ধাভিযান যার উদ্দেশ্য হল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অপসারণ করা ও যে সকল দেশ সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া। ২০০১ সালের  ১১ ই সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময় কালে পার্ল হারবারে জাপানি তথাকথিত হামলার মত আরেকটি বানোয়াট কাহিনি। 

এটি বর্তমানে শীতল যুদ্ধের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাক্তন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের দাবি ছিল যে, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ইরান, ইরাক, সিরিয়া আর লিবিয়া (যা এক্সিস অব এভিল বা দুষ্টের কেন্দ্র বলেও পরিচিত) ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ। পরিভাষাটি মূলত জঙ্গি ইসলামপন্থী ও আল-কায়েদাকে বিশেষভাবে কেন্দ্র করে ব্যবহৃত হত। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার প্রশাসন এই পরিভাষাটির পরিবর্তে Overseas Contingency Operation (ওভারসিজ কন্টিঞ্জেন্সি অপারেশন) বা সম্ভাব্য অনিশ্চিত বৈদেশিক সশস্ত্র অভিযান পরিভাষাটি ব্যবহারের পক্ষপাতি।

দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ
বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে এশিয়ার দেশ চীন। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে দেশটি। ওই সব দেশকে সমস্যা থেকে উত্তোলনে দিয়েছে মোটা অংকের ঋণ সহায়তা। এরই ধারাবাহিকতায় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভভুক্ত (বিআরআই) ২২টি উন্নয়নশীল দেশকে ২৪০ বিলিয়ন (২৪ হাজার কোটি) ডলারের জরুরি ঋণ (বেইল আউট) দিয়েছে চীন। ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ প্রদানের পরিমাণ আরও বেড়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন কয়েকজন গবেষক।

বিংশ শতক ছিল আমেরিকার, একবিংশ শতক হবে কার? তা নির্ভর করছে যে প্রকল্পের সম্ভাবনার ওপর, তার অনেক নাম। একে প্রথমে ডাকা হচ্ছিল নয়া রেশমপথ (সিল্ক রোড) নামে। পরে বলা হলো ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর)। কিন্তু ‘ওয়ান’ বা ‘একক’ কথাটার মধ্যে একাধিপত্যের লণ থাকায় এর সর্বশেষ নাম দেয়া হয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, সংেেপ বিআরআই। একুশ শতাব্দী চীনা শতাব্দী হবে কি না, তা নির্ভর করছে এই বৈশ্বিক বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণে সফলতার ওপর।

তিনটি বৃহৎ উপাদান এখানে এক হয়েছে : সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন ও সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। বলা হচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প। ৬৮টি দেশ, ৬০ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে এই নয়া রেশমপথ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন।

পুরোদমে বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হলে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) হয়ে উঠবে বিশ্বায়ন ২.০। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৯০ দশকের গোড়ার বিশ্বায়নকে বলা হচ্ছে বিশ্বায়ন ১.০। আর এটা ঘটছে এমন সময়ে, যখন পশ্চিমা বিশ্বায়ন নিজের ভেতর থেকেই বাধার মুখে পড়েছে। এ রকম সময়ে চীনা বিশ্বায়ন বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে নাটকীয় সম্ভাবনার চ্যালেঞ্জ। চীনের নেতৃত্ব কতটা উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে, এই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প তার প্রধান উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনে ‘মার্শাল প্লান’ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিল পৃথিবীর শীর্ষ শক্তির স্বীকৃতি। সে সুবাদেই আমেরিকা বলতে ভালোবাসে, বিশ শতক হলো আমেরিকান শতক। কিন্তু মার্শাল প্লান ছিল কেবল ইউরোপের বিষয়, আর বেল্ট অ্যান্ড রোড এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে ধারণ করলেও এর আওতায় আসবে সারা পৃথিবীর বাণিজ্যই।

অসহায় সাধারণ মানুষ 
বিশ্ব জুড়ে আধিপত্য বিস্তারকারী  ক্ষমতার এই খেলায় গত শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই ক্রমান্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ শক্তিকে ক্রমাগত হীনবল করে দেয়। তখন নতুন মোড়ল হিসেবে দেশটির আবির্ভাব। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে কূটনীতির খেলা আর আর্থিক ব্যবস্থাপনার উপর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে দেশটি মাত্র পঞ্চাশ বৎসরে বিশ্ব মোড়ল হয়ে উঠে। 

নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা যার মধ্যে মানবিকতা আর গণতন্ত্রের চর্চা একটি আবশ্যিক বিষয় আর তার সাথে ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকার কারণে সাধারণ মানুষ নিজেদের অধিকার প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখতে পায়।  কিন্তু পাশ্চাত্য ব্যবসায়ীদের (বিশেষত নব্য মার্কিন ধনকুবেরদের) মুনাফার তীব্র আকাংখার বাস্তবায়ন প্রবণতা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ মানুষ তার অবস্থানটা ধরে ফেলে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়া শুরু করে। এর জন্য নানা ধরণের কার্যক্রমে তারা জড়িয়ে পরে - যার মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের স্বার্থের লোকজনকে বসিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। এর অবসম্ভাবী ফল হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি আর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সর্বনাশ।

সাহসী উচ্চারণ নাকি অবিমৃষ্যকারীতা
প্রধানমন্ত্রীর সত্য কথন তার প্রচন্ড সাহসকে ইঙ্গিত করে।  কিন্তু রাজনীতির মাঠে এই সত্যবাদিতা শেষ বিচারে একটি অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপ বলেই প্রতীয়মান। যখন দেশের ভিতর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষেরজীবনে নাভিশ্বাস তখন বিশ্ব মোড়লকে খেপিয়ে তোলাটাকি রাজনৈতিক বিজ্ঞতার পরিচয় নয়। যদি কোন কারণে সত্যি পশ্চিমা বিশ্ব এই সরকারের প্রতি বিরূপ থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই একটি জটিল সমীকরণে পরিণত হবে।  আর তা হবে বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রতিকূল - দেশের মানুষের জন্যও তা হবে অশুভ।

আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ