আজকের শিরোনাম :

আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস-২০২৩

জাদুঘরের প্রদর্শনী ও নিদর্শনকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা : পরিপ্রেক্ষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও সমৃদ্ধি

  আমিরুজ্জামান পলাশ

১৭ মে ২০২৩, ১৩:৩৯ | আপডেট : ১৭ মে ২০২৩, ১৩:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

আমিরুজ্জামান পলাশ
ভূমিকা:  জাদুঘরের সাধারণত একটি জাতি, গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগৃহীত, সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয় এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে ইতিহাসের শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। জাদুঘরে সাধারণত মানবনির্মিত, ব্যবহৃত ও প্রভাবিত বস্তুগত নিদর্শনাদি সংরক্ষিত থাকে এবং সেগুলো সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রদর্শিত হয়। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তিতে বিশ্ব পরিস্থিতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রভাবে পূর্ববর্তী যুগের সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার ধারণা-ই (concept) পরবর্তীতে আধুনিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে (হুদা, ২০০২: ২৯-৩৮)। গ্রিক শব্দ Mousein থেকে জাদুঘরের আক্ষরিক প্রতিশব্দ Museum শব্দটির উদ্ভব। কিন্তু কালক্রমে জাদুঘর সম্বন্ধে এই ধারণা আরও বিকশিত হতে থাকে। ঊনিশ শতক থেকেই জাদুঘরের সংগ্রহে সংস্কৃতি, শিক্ষা, গবেষণা ও বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে সমন্বিত গুরুত্ব উপলদ্ধি করা শুরু হয়। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এই উপলব্ধি লক্ষ করা যায় যে জাদুঘরসমূহ সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভিত্তিক অবদান রাখতে পারে। কোন জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরই আদর্শ প্রতিষ্ঠান, যেখানে গেলে মানুষ তার শেকড়ের টান অনুভব করে। অতি সম্প্রতি কালে জাদুঘর জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবেই শুধু পরিচিত নয়, ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র ও বিনোদনের স্থানও বটে। অতীতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে বর্তমান প্রজন্মের যোগাযোগ স্থাপনের সেতু হিসেবে জাদুঘর তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। জাদুঘর সম্বন্ধে এভাবে বলা যায়, যে প্রতিষ্ঠানে পূর্ব পুরুষদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শনাদি সংরক্ষিত হয়, যেখানে মানুষ তার অস্তিত্বের প্রাচীনত্ব, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শেকড়ের গভীরতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন ধারা সম্মন্ধে অবহিত হতে পারে তা-ই হল জাদুঘর (মোতাহার, ২০০১: ১১)। অন্যভাবে জাদুঘরকে সমাজের প্রতিবিম্বও বলা যেতে পারে। 

জাদুঘরের সংজ্ঞা ও ধারণা : সাধারণত জাদুঘর বলতে এমন একটি ভবনকে বুঝায় যেখানে ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক দ্রব্যাদি সংগ্রহ সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে জাদুঘর এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে দলিল দস্তাবেজ, মূল্যবান নিদর্শনাদি সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রদর্শন এবং প্রাপ্ত বস্তুর মূল্যবান ও আনুষাঙ্গিক তথ্য জনসাধারণের অবগতির জন্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে। পূর্বে জাদুঘর বলতে মূলত দুর্লভ বস্তুর সংগ্রহশালাকে বুঝাত। ধারণা করা হয় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরে সম্রাট টলেমি সোটের কর্তৃক খ্রি: পূ: তৃতীয় শতকে স্থাপিত সংগ্রহশালার মাধ্যমে জাদুঘরের যাত্রা শুরু (পাল, ২০০৭)। কিন্তু রেঁনেসা যুগের ফ্লোরেন্সে একটি সংগ্রহকে বোঝাতে মিউজিয়াম শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় (খান, ১৯৯৯: ০৪)। কারো কারো মতে ব্যাবিলনরাজ নেবুচাডরেজারের (খ্রি: পূ: ৬০৫-৫৬২ অব্দ) এক সময়ের দূত ও পরবর্তীকালের ব্যাবিলনরাজ নেবুনিডাস (খ্রি: পূ: ৫৫৫-৫৩৯ অব্দ)  খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে যে প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা স্থাপন করেছিলেন সেটিই পৃথিবীর প্রথম জাদুঘর (পাল, ২০০৭)। এর পরের কোন তথ্যের ধারাক্রমিক স্পষ্টতা লক্ষ করা যায় না পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন গির্জা এবং রাজকীয় ও ধনাঢ্য পরিবার শিল্পকর্ম ও মূল্যবান নিদর্শন সংগ্রহ শুরু করেন হয় (খান, ১৯৯৯: ০৪)। অদ্ভুদ, আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর, অবাক করা সব উপাদান নিয়ে সুদূর অতীতে মিউজিয়ামের যাত্রা শুরু। রেঁনেসা যুগে রাজা বাদশা বা মন্দির, গির্জায় অত্যাশ্চার্য নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা দান সম্পর্কে জানা যায়  (খান, ১৯৯৯: ০২)। পরবর্তীকালে পৃথিবীর বহু জাদুঘর আত্নপরিচয়জ্ঞাপন ও নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার যত্নকৃত প্রয়াস হিসেবে গড়ে ওঠে (আনিসুজ্জামান,১৯৯৯: ০৪)। অতি প্রাচীনকালের ধারাবাহিকতায় জাদুঘরের ধারণা নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্ধন, পরিবর্তন ও সময়োপযোগী করে উপস্থাপিত হয়েছে। আদিকালের মূল ধারণার সাথে তাই যুক্ত হয়েছে নব নব তত্ত্ব, কৌশল, জ্ঞান, প্রযুক্তি, উপাদান ও ভূমিকা। জাদুঘরের মৌলিক ধারণা বহাল রেখে তার সাথে যুগের অগ্রাধিকার ও চাহিদা অনবরত যুক্ত হচ্ছে বলেই বিশ্বব্যাপী জাদুঘর সংস্থাপন ও বিকাশের আয়োজন ক্রমবর্ধনশীল হয়েছে। আধুনিকোত্তর যুগের জাদুঘরসমূহ এখন কেবল বস্তগত জ্ঞান সরবরাহ কিম্বা নিস্ক্রিয় প্রদশর্নীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং দর্শক-জাদুঘর ফলপ্রসু সম্পর্ক, বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থায়, সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণে, জাতিসত্ত্বা গঠনে, জনগোষ্ঠীর নানাবিধ সমস্যা নিরসনের দিক নির্দেশনার সাথে সম্পৃক্ত। জাদুঘর একটি জটিল ও মিশ্র সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যা প্রধানত দৃষ্টি আকর্ষক স্থান, দুর্লভ জ্ঞান ও মনোমুগ্ধকর অনুপম নিদর্শনের সংগ্রহ ও নানা ধরণের মূল্যবোধ সমন্বেয়ে গঠিত (হুদা, ২০০২:২৯-৩৮)।  

১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিল (ICOM)  এর ১০ম সাধারণ অধিবেশনে সর্বজন গ্রাহ্য নিম্নরূপ সংজ্ঞা গৃহীত হয়- A museum is a non profit making, permanent institution in the service of society and of its divelopment and open to the public, which acquires,conserves,researches communicates and exhibits for purpose of study, education and enjoyment, material evidence of man and his environment (Amborseand Paine 1993:8)| অর্থাৎ জাদুঘর হল এমন একটি অলাভজনক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান যা মানুষ এবং তার পরিবৈশিক প্রেক্ষিতের বস্তুগত উপাদান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, যোগাযোগ এবং প্রদর্শনের মাধ্যমে  সমাজের সেবা ও উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান। 

আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিলের ১৯৭৪ সালে গৃহীত সংজ্ঞায় শুধুমাত্র মানুষ এবং তার পরিবৈশিক প্রেক্ষিতের বস্তগত উপাদানের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, যোগাযোগ এবং প্রদর্শনের বিষয়বস্তু অর্ন্তভূক্ত ছিল। পরবর্তীতে সংজ্ঞাটি যুগের চাহিদা ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ২২ তম সাধারণ অধিবেশনে মানবতার সাথে সম্পৃক্ত বস্তগত ও অবস্তুগত উপাদানকে অর্ন্তভূক্ত করে পুনরায় নিম্নরূপভাবে সংজ্ঞা গৃহীত হয় - A museum is a non-profit, permanent institution in the service of society and its development, open to the public, which acquires, conserves, researches, communicates and exhibits the tangible and intangible heritage of humanity and its environment for the purposes of education, study and enjoyment (URL-1) .  

অতি সম্প্রতি ২৪ আগস্ট ২০২২ খ্রিস্টাব্দে প্যারাগুয়েতে অনুষ্ঠিত ICOM এর সাধারণ অধিবেশনে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণকরণে লক্ষ্যে  নিন্মোক্তভাবে  জাদুঘরের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে,  “A museum is a not-for-profit, permanent institution in the service of society that researches, collects, conserves, interprets and exhibits tangible and intangible heritage. Open to the public, accessible and inclusive, museums foster diversity and sustainability. They operate and communicate ethically, professionally and with the participation of communities, offering varied experiences for education, enjoyment, reflection and knowledge sharing (URL-2) .”

উর্পযুক্ত সংজ্ঞা ও ধারণার আলোকে বলা যায় জাদুঘর হল সমাজ, জাতি ও দেশের দর্পন। একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য,শিক্ষা,সংস্কৃতিকে দেশী-বিদেশী দর্শকের নিকট তুলে ধরতে জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ফলে জাদুঘরকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গণবিশ্ববিদ্যালয় রূপে গণ্য করা যায়। অতীতে জাদুঘরকে একটি একক, স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হত। কিন্তু বর্তমান কালের ধারণা অনুযায়ী জাদুঘরকে সমাজ সম্মিলন কেন্দ্র ও শিক্ষালয় হিসেবে গণ্য করা হয়।

বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এই উপলব্ধি লক্ষ্য করা যায় যে, জাদুঘরসমূহ জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভিত্তিক অবদান রাখতে পারে এবং জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত নিদর্শন কেন্দ্রিক প্রামাণ্য শিক্ষা প্রদানের জন্য জাদুঘরই আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত । জাদুঘরে  গেলে মানুষ তার শেকড়ের টান অনুভব করে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষিতে জাদুঘর একটি আধুনিক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে উৎকর্ষ লাভ করেছে (Amborse and Paine 1993);  যেখানে একটি জাতি, গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট ভূখন্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগৃহীত, সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ইতিহাসের শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ফলে জাদুঘরকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গণবিশ্ববিদ্যালয় রূপেও গণ্য করা যায়।

একুশ শতকের জাদুঘর হচ্ছে স্মৃতি, নান্দনিক, উত্তরাধিকারের দলিল, বুদ্ধিদীপ্ত নব্য চেতনার বাহক, সংস্কৃতি ও সমাজের জ্ঞান ভান্ডার। যেহেতু জাদুঘরে বস্তুগতভাবে যে সংস্কৃতি উপস্থাপিত তা অনেক বেশি মনন, প্রাসঙ্গিকতা, ব্যবহার, বিশ্বাস, যুক্তি, নন্দনতত্ত্ব এবং বিশ্বমানবের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যায়িত হওয়া উচিত এবং তখনই জাদুঘরের শিক্ষা সমাজের বহুমুখী সাংস্কৃতিক উন্নয়নে, জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধিতে, জনগোষ্ঠীর কল্যাণে, টেকসই সমাজ গঠনে বর্তমান যুগের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে (হুদা,২০০২:৩২)। জাদুঘরে শুধু গ্যালারি পরিদর্শনই নয়, প্রদর্শনীতে রয়েছে জনশিক্ষা বা শিক্ষামূলক কার্যক্রম । এছাড়াও নানাবিধ শিক্ষমূলক কার্যক্রম জাদুঘরে পরিচালিত হয়ে থাকে। এ সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বস্তরের দর্শক ও দেশি-বিদেশি গবেষকদের জাদুঘরে নিদর্শন কেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকে। এই শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে জাদুঘরের নিদর্শনের সাথে ওতপ্রোতভাবে দর্শক ও গবেষকদের অর্ন্তভূক্তির সুযোগ রয়েছে। 

বিশ্বের জাদুঘরসমূহে দর্শকদের ওপর বহুমাত্রিক গবেষণা, প্রদর্শন উন্নয়নের ওপর কাজ করা শিক্ষামূলক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত (হুদা,২০০২:৩২)। ফলে জাদুঘরে শিক্ষাবিদদের  কর্মক্ষেত্রও বেড়ে গেছে। একুশ শতকে জাদুঘরের শিক্ষা কেবলমাত্র সাধারণ শিক্ষা কর্মসূচি নয় বরং দুটো নতুন বিষয়ে সংযোজন ঘটেছে। তা হলো কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ এবং ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা প্রদান (হুদা,২০০২:৩২)।  এক্ষেত্রে নিদর্শন প্রর্দশনীর ক্ষেত্রে নান্দনিকতা, বৈচিত্র্যময়তা ও শিক্ষার পাশাপাশি দর্শক, গবেষক বা শিক্ষার্থীর ব্যাখ্যার আদান- প্রদানের এবং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান  করে অর্ন্তভূক্তিমূলক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হয়।  নিদর্শনের ব্যাখ্যা প্রদান বাস্তবে একটি জটিল ও দুরূহ বিষয়। 

সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান ও তা নানা ধরনের দর্শক, জনগোষ্ঠীকে তাদের জ্ঞান ও মননের পরিসীমার মধ্যে ব্যাখ্যা ও তথ্যের পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটানোর মধ্যে একুশ শতকের জাদুঘর শিক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়নের চাবিকাটি নিহিত (হুদা,২০০২:৩২)।  ফলে জাদুঘর নিদর্শন সম্বলিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রদর্শন কেন্দ্র হিসেবে অনেক বেশী সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। জাদুঘর ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও জাতিগত সামগ্রিক পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্মৃতি ও ইতিহাসের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী করে । জাদুঘর অর্থবহ সাংস্কৃতিক বিনিময়, সাংস্কৃতিক সম্মৃদ্ধি, গবেষণা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, যোগাযোগ এবং শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।

আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিল: বিশ্বব্যাপী জাদুঘর এবং জাদুঘর পেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মান স্থাপন (establish standards of excellence)  কূটনৈতিক ফোরামে নেতৃত্ব প্রদান, থিংক ট্যাংক হিসেবে কাজ করা ও আন্তর্জাতিক মিশন পরিচালনাসহ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে ১৯৪৬-৪৭ খ্রি:  International Council of Museums ( ICOM) গড়ে ওঠে।  প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংস্থাটি বিশ্ব জাদুঘর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং বিশ্বব্যাপী জাদুঘর পেশায় নিয়োজিত পেশাদারদের প্রয়োজন অনুসারে বিকশিত হয়েছে (URL-3) । International Council of Museums ( ICOM) ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর সুনির্দিষ্ট  বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে ১৮ই মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস পালন করছে । সমাজ ও  গোষ্ঠীর উন্নয়নে জাদুঘরের ভূমিকা ও গুরুত্বের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জনসচেনতা বৃদ্ধির লক্ষেই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয় (URL-3) ।

আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস - ২০২৩ : ২০২৩ সালের ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উদযাপনের জন্য আর্ন্তজাতিক জাদুঘর কাউন্সিল (ICOM)  প্রতিপাদ্য নির্ধারন করেছে, "জাদুঘর, স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধি (Museums, Sustainability and Wellbeing)”। এই প্রতিপাদ্যকে গুরুত্ব প্রদান ও ফোকাস করে জাদুঘরসমূহকে বছর ব্যাপী  কার্যক্রমে  বিশেষ ইভেন্ট যুক্ত করে উদযাপন করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। সমাজ এবং জাদুঘরগুলির মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে এসকল কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।  টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, মঙ্গল ও সুষ্স্থতাকে ফোকাস করে কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জাদুঘরগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আর্ন্তজাতিক জাদুঘর কাউন্সিল প্রচার করতে চায় (URL-3) । আমরা যেসকল বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ক্ষতি এবং সামাজিক অসমতার মুখোমুখি , সেসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাদুঘর জনসাধারণকে শিক্ষিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের পদক্ষেপকে উৎসাহিত করতে পারে । টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাদুঘর বেশকিছু ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে সুরক্ষার কার্যক্রমকে সমর্থন ও অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাজ করা । আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন ইভেন্ট, প্রদর্শনী এবং কার্যক্রম আয়োজনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের জাদুঘরসমূহ টেকসই অনুশীলনের প্রচার এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। 


                                   
জাদুঘর, স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধি: আর্ন্তজাতিক জাদুঘর কাউন্সিল ২০১৯ সালের কিয়োটো রেজু্লেশন “On sustainability and the implementation of Agenda 2030” এর ভিত্তিতে মনে করে যে, জাদুঘরসমূহ শিক্ষামূলক কার্যক্রম, প্রদর্শনীর আয়োজন, আউটরিচ , রিচআউট কার্যক্রম ও গবেষণার  মাধ্যমে  টেকসই ভবিষ্যত গঠন এবং সৃজনে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে । জাদুঘরসমূহের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ভূমিকা রয়েছে  । ২০২০  সাল থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির মধ্য থেকে নির্বাচিত লক্ষ্যমাত্রাকে ফোকাস করে উদযাপন করা হয়। । ২০২৩ সালে আর্ন্তজাতিক জাদুঘর কাউন্সিল কর্তৃক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য ৩, ১৩ ও ১৫ কে  ফোকাস করা হয়েছে (URL-3)। 

লক্ষ্য ৩ এর মাধ্যমে  বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার মাধ্যমে কল্যান ও সমৃদ্ধিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করণ এবং সব বয়সের  সকলের জন্য কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য জাদুঘরের কর্মসূচি নির্বাচন করা। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে জনগোষ্ঠীকে অর্ন্তভূক্তির জন্য জাদুঘরসমূহের বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে।

লক্ষ্য ১৩ এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মানুষের সচেতনা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি নির্বাচনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাবগুলি মোকাবেলা করার জন্য জরুরী পদক্ষেপ  গ্রহণে সমাজ ও গোষ্ঠীর করনীয় সম্পর্কে জাদুঘরসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।  

এছাড়াও জাদুঘরে প্রদর্শিত নিদর্শন ও প্রত্নস্থানের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ অধ্যায়নের মাধ্যমে  সাংস্কৃতিক সম্পদের পাশাপাশি অভিক্ষিপ্ত জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রভাব অনুভব করা যায়। জাদুঘরের প্রাচীন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও  স্থানগুলির ল্যান্ডস্কেপ অধ্যয়নের মাধ্যমে জলবায়ুর প্রভাবগুলি বোঝার এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সুরক্ষার ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলার একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার প্রচেষ্টায়  ভূমিকা রাখা সম্ভব। 

লক্ষ্য ১৫ এর মাধ্যমে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহারের সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং প্রচার, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রশস্ত করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।  টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাদুঘরসমূহ অবদান রাখতে পারে এমন অনেক উপায় রয়েছে। তাই ১৮ মে সকলকে একত্রিত হয়ে টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির জন্য জাদুঘরগুলির রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা উপলব্ধি ও উদযাপন  করতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।   

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০১১ সালের ৪ মে মুক্তযিুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন (সংগৃহীত))

জাদুঘরসমুহে প্রদর্শনী ও নিদর্শন কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রস্তাবনা : আর্ন্তজাতিক জাদুঘর কাউন্সিল (ICOM) কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিপাদ্যকে সমানে রেখে বাংলাদেশের জাদুঘরসমূহের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে কতিপয় আধুনিকায়নের বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত কর্মকান্ডে জাদুঘর ব্যবস্থাপনায় অর্ন্তভূক্তি, বৈচিত্র্য ও সমতাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত কার্যক্রম পর্যালোচনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। প্রজন্মান্তরে ও সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে একুশ শতকের যুগোপযোগী প্রর্দশনী ব্যবস্থাপনা ও নিদর্শন কেন্দ্রিক শিক্ষা প্রদানের জন্য জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আউটরিচ বা বহির্বিভাগীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্বে সাথে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। সঙ্গত কারনেই জাদুঘরের প্রর্দশনী উন্নয়ন ও  নিদর্শন কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কতিপয় প্রস্তাবনা নিম্নে আলোচনার অবকাশ রয়েছে: 
 স্থাপত্য কাঠামোতে মিউজোগ্রাফিক ধারণাকে প্রাধান্য: জাদুঘর তথা প্রদর্শনী কক্ষের স্থাপত্য পরিকল্পনা অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাদুঘরের সংগ্রহের ধরণ ও বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে মিউজোগ্রাফিক ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে  স্থাপত্য কাঠামো তৈরি করা বা রূপান্তর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্থাপত্য কাঠামোতে প্রদর্শনী কক্ষ, দর্শক সুবিধাদি, আলোক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পরিবৈশিক নিয়ামকসমূহের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ ল্যাবরেটরী, গুদাম ব্যবস্থাপনা, নিদর্শনের প্রকৃতি, প্রদর্শনী পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাদুঘরের স্থাপত্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

প্রদর্শনী পরিকল্পনা: নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য কোন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া বা কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন তা নির্ধারনের পূর্বে সর্বাগ্রে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা অবশ্যই জাদুঘরের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, বিষয়বস্তু, সংগৃহীত নিদর্শনের ধরন ও বিষয়বস্তু দর্শকের চাহিদা প্রভৃতি বিষয়াদির সাথে সঙ্গতি পূর্ণ হতে হবে।

প্রথমত, ষ্টোরিলাইন (story line) তৈরি করা। নিদর্শনকে বিশ্লেষন করে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু (them) অনুযায়ী উপস্থাপন করা অতঃপর একে কতগুলো উপ বিভাগে বিভক্ত করা। প্রদর্শনীর জন্য story line তৈরী করতে প্রথমেই নির্দশনকে পুংখানুপুঙ্খরূপে যত্ন সহকারে গবেষণা করা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি গবেষক থাকবেন তার প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু সম্পর্কে খুব ভাল দক্ষতা থাকতে হবে, প্রয়োজনে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেও কাজে লাগাতে হবে এবং প্রথামিক উৎসকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

দ্বিতীয়ত,ষ্টোরি লাইন তৈরী হয়ে গেলে উপস্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন ও নক্শা তৈরী করতে হবে। স্ক্রীপ্ট তৈরীর পর সাধারণত কতটুকু জায়গায় নিদর্শন উপস্থাপিত হবে, দর্শক সার্কুলেশনের স্থান, শোকেস, আলোক প্রভৃতির জন্য স্থান বিন্যাস এবং সে অনুযায়ী কালানুক্রমিক উপস্থাপনের জন্য নকশা প্রদর্শনী ডিজাইনারকে প্রস্তুত করতে হবে।

শোকেস: প্রদর্শনী কক্ষে নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য শোকেস নির্মান করা হয় এবং উপস্থাপনার এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধুমাত্র নিদর্শনকে স্থাপন বা ধারণ করাই নয় এসব শোকেস এর সঠিক পরিকল্পনা এমন হওয়া উচিত যাতে নিদর্শনের অন্তর্নিহিত তথ্যের সাথে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় ও সেটির বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্টভাবে ঘটে। আবার নন্দন গত দিকটিও বিবেচ্য। প্রধানতঃ চার ধরনের শোকেস ব্যবহৃত হয়ঃ(১) দেওয়াল শোকেস(২) পার্শ্ব দেওয়াল শোকেস  (৩) মেঝে শোকেস  (৪) টেবিল শোকেস । 

আলোক: যেকোন নিদর্শনকে উপস্থাপনের জন্য আলোক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রাকৃতিক আলোর পাশাপাশি কৃত্রিম আলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ কৃত্রিম আলো সবসময়ই একই রকম আলো দেয় এবং একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যা দর্শকদের বেশ স্বস্তি দেয়। আলো একটি নিদর্শনের প্রকৃত অবস্থাকে প্রদর্শন করে। যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোন প্রদর্শনী তৈরীতে আলোক প্রক্ষেপন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। নিদর্শনের আকৃতি, ভূপৃষ্ঠীয় গুনাগুণ, ভঙ্গুরতা, বিশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বের সাথে উপস্থাপনের জন্য সাধারন ও স্পষ্ট লাইট ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

লেবেল ও মানচিত্র: কোন নিদর্শন উপস্থাপনার অন্যতম প্রধান ও উপাদান হল লেবেল যা শিরোনাম এবং মানচিত্র। সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করতে গেলেই প্রয়োজন হয় সুষ্ঠু লেবেলিং পদ্ধতির (হোসেন, ১৯৯৫: ৭৯)। প্রদর্শনী কক্ষে লেবেলিং ও মানচিত্রায়ন প্রযুক্ত করার ক্ষেত্রে সর্ব প্রথম সংশ্লিষ্ট দেশের সামাজিক পটভূমি বিবেচনা অত্যন্ত জরুরী। দেশের শিক্ষিতের হার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির উপর লক্ষ্য রেখে শিরোনাম প্রদান করা উচিত। জাদুঘরে সাধারণত দর্শক আসে একটি নিদর্শনকে জানতে বা উপভোগ করতে। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নয়। তাই নান্দনিক অর্থে নিদর্শন যাতে সুন্দরভাবে সাজানো থাকে বা তার লেবেল ডিজাইন করা হয় এটাই কাম্য। প্রখ্যাত মনিষী ডান কান ক্যামেরুন মনে করেন, ‘একটি সুন্দর সাবলীল ভাষায় লিখিত তথ্য বহুল লেবেলই কেবল একটি নিদর্শনকে একজন দর্শকের মনে দাগ কাটতে বা জিজ্ঞাসাবোধের সৃষ্টি করতে পারে। দর্শক চাহিদা ও মনের খোরাকের সাথে কেবল এই লেবেলিং সিস্টেমই সুন্দর যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম। অন্য কোন প্রক্রিয়ায় তা সম্ভব নয়। বস্তুত লেবেলিং পদ্ধতি জাদুঘর বিদ্যার একটি শিল্পমূলক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, লেবেলিং সিস্টেম তথ্য দিয়ে প্রদর্শনী সমাগ্রী ও দর্শকের সঙ্গে একটি নিবড়ি সম্পর্ক তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা লেবেলের দৃষ্টিকোন অবশ্যই লক্ষনীয়, যেমন-গঠনযোগ্যতা, নিয়মসিদ্ধতা, আকার বা প্রকারভেদ, ফরমেট, রঙ বা বর্ণ, সাইজ বা ধরন ইত্যাদি (হোসেন, ১৯৯৫: ৭৯)। ’ প্রধানত নিদর্শন উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তিন ধরনের লেবেল ব্যবহৃত হয়ঃ (১) নিদর্শন লেবেল (২) মাস্টার লেবেল (৩) কি লেবেল । 

জাদুঘরের প্রদর্শনী গ্যালারি ও স্টোর ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ: জাদুঘর কর্তৃক সংগৃহীত নিদর্শন পরিচর্যার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর তারা স্থান পায় গুদামে অথবা প্রদর্শন গ্যালারিতে। তবে পরিচর্যাকৃত নিদর্শনের অবক্ষয় ক্রিয়া একেবারে থেমে থাকে এমনটি নয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের অবক্ষয় ক্রিয়া কম-বেশি চলতে থাকে। জাদুঘরে সংরক্ষিত নিদর্শনসমূহ নিরাপদ পরিবেশ না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। নিদর্শন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিবেশ গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি, অপরিমিত অথবা অসহনীয় আলো, দূষিত বায়ু প্রভৃতি নিয়ামকের ক্রিয়ায় জাদুঘরের পরিবেশ বিঘ্নিত এবং নিদর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সকল পরিবৈশিক নিয়ামকের ক্রিয়া হতে নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। 

ভার্চুয়াল জাদুঘর প্রদর্শনী: আধুনিক তথ্য কমিউনিকেশনের যুগে জাদুঘর শিক্ষা কার্যক্রমে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জাদুঘর প্রর্দশনীর ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। ভার্চুয়াল জাদুঘর প্রর্দশনীর মাধ্যমে জাদুঘরের গ্যালারি ও গ্যালারিতে প্রদর্শিত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের তথ্য ও আলোকচিত্রের সমন্বয়ে বিশ্বগ্রামে প্রবেশ করা যায়। থ্রি ডি প্রিন্ট, ৩৬০ ডিগ্রী প্রেজেন্টেশনসহ বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নান্দনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রদর্শনীর মাধ্যমে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বৈশ্বিকগ্রামে অর্ন্তভূক্তিমূলক প্রদর্শনী ব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন।  এ ব্যবস্থাটিতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমতা প্রতিষ্ঠার অবারিত সুযোগ  সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। 

ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা: জাদুঘরের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা অর্ন্তভূক্ত করা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে গ্রাম কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ও শিক্ষার্থী শহরে এসে জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারে না। এক্ষেত্রে জাদুঘরের নির্বাচিত কিছু নিদর্শন, গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের রেপ্লিকা বা রিপ্রডাকশন ও আলোকচিত্রের সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর স্থাপন করে প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের কাছে নিদর্শন-প্রদর্শনের মাধ্যমে নিদর্শন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।  এভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে অর্ন্তভূক্তির মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে পরস্পারিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক ও প্রামাণ্য শিক্ষা প্রদান ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে এটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মতোই কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। 

জাদুঘরের স্কুল কর্মসূচি : স্কুল কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিদর্শন সম্পর্কীয় শিক্ষা প্রদান প্রসঙ্গে ১৯৭৩ সালে  Lawson and Silver  বলেন, ‘স্কুল কর্মসূচির প্রধান বৈশিষ্ট হলো নির্দশন পাঠ। সকল শ্রেণীর শিশুর মধ্যে নিদর্শন সংক্রান্ত জ্ঞান জন্মানো নিদর্শন শিক্ষার উদ্দেশ্য। নিদর্শন থেকে শিক্ষা গ্রহণে তাদের অস্তিত্ববোধ সম্পর্কে জ্ঞান জন্মাতে সহায়ক হবে, যা তাদের প্রকাশভঙ্গি ও বিচারবুদ্ধি জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা এবং দক্ষতায় জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। জাদুঘর শিক্ষর প্রধান গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো স্কুল শিক্ষা ( আলী; ২০০৫: ০৫-০৭ ) । ’ সাধারণত স্কুল কর্মসূচি দুই ভাবে পরিচালিত হতে পারে: ক. জাদুঘরের পরিবহনে আসা শিক্ষার্থী এবং  খ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহনে আসা শিক্ষার্থী। সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সমন্বয় এই স্কুল প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীগণ জাদুঘরে আসার পর জাদুঘরের একজন শিক্ষা কর্মকর্তা সূচনা বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে প্রদর্শক প্রভাষক সকল গ্যালারিতে নিয়ে নিদর্শন সম্পর্কে শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী তথ্য প্রদান করে। গ্যালারি পরিদর্শন শেষে জাদুঘরের মিলনায়তনে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে। জাদুঘরের শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক ডাকযোগে অথবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি স্কুলের সাথে এই প্রোগ্রামের বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন এবং তদানুযায়ী সিডিউল তৈরি করে স্কুল প্রোগ্রামের আয়োজন করা যেতে পারে । বাংলাদেশের জাদুঘরসমূহে এধরণের স্কুল কর্মসূচি চালু থাকলেও অধিকাংশ জাদুঘরের স্থায়ী কাঠামো নাই। জনবল সংকট, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ও গবেষণার সীমাবদ্ধতার কারণে এ  কর্মসূচিটি গতিশীল নয়। ফলে জাদুঘর ব্যবস্থাপনার সাংগঠনিক কাঠামোতে স্কুল কর্মসূচি অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে। 

কথ্য ইতিহাস ও স্মৃতিচারণ লিখন : বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ,ইতিহাস, কিংবদন্তি, জনশ্রুতি, মিথলজি ও অগ্রজ প্রজন্মের স্মৃতিচারণ নতুন প্রজন্মের মধ্যে উপস্থাপনের জন্য অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে কথ্য ইতিহাস ও স্মৃতি চারণ ধারণ করা যেতে পারে। এ সম্পর্কিত যে কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি  স্মৃতিচারণমূলক লিখনের আয়োজনও করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রবীণ প্রজন্মের নিকট থেকে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গৌরবোজ্জ্বল কথ্য ইতিহাস বা স্মৃতিচারণ সংগ্রহ করে তা জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে।  কর্তৃপক্ষ প্রাপ্ত স্মৃতিচারণগুলো আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যথাযথ সংরক্ষণ এবং নিজস্ব প্রকাশনায় প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারে। এধরণের উদ্যোগের ফলে অগ্রজ প্রজন্ম তাঁদের গৌরবগাথা নতুন প্রজন্মের মধ্যে উপস্থাপন করে গর্ব অনুভব করবে। অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম সরাসরি নিজের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য সম্পর্কে জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবে। সামাজিক ও পারিবারিক এ সম্মিলনের আয়োজনের মাধ্যমে জাদুঘরও কালের স্বাক্ষী হয়ে পরম্পরা সুরক্ষা করতে পারে। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক এ এফ সালাহ্উদ্দিন আহমদ আশির দশকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কথ্য ইতিহাস নামে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন। দেশ ও কালের পটভূমিতে মানুষ রাষ্ট্রসাধনা,মননশীলতার অনুশীলন, বিচিত্র উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে নিরন্তর যে ইতিহাস সৃষ্টি করে চলে তা সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। সমকালীন ইতিহাসের উপাদানসমূহ যথোপযুক্তভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্বরূপ এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা উত্তরকালের মানুষের কাছে পৌছাতে পারে না। সমকালীন ইতিহাসের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থানুকুল্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ‘কথ্য ইতিহাস প্রকল্প’ চালু হয় (আহমদ;১৯৯১:৫) । অধিকন্তু সমাজ ও গোষ্ঠির মধ্যে জাদুঘরকে জনপ্রিয় করে তুলতে, গোষ্ঠিগত অর্ন্তভূক্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এবং সাংস্কৃতিক পরম্পরা বহন করে চলতে এ ধরণের কার্যক্রম খুবই ফলপ্রসু হতে পারে। বাংলাদেশের জাদুঘরগুলিতে তাদের ভিশন–মিশনের সাথে সম্পৃক্ত করে এধরণের প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। 

সৃজনশীল চিঠি লিখন প্রতিযোগিতা: পোস্ট কার্ড চালু করে অথবা সোশ্যাল মিডিয়াতে সৃজনশীল চিঠি লিখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে । জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং/ অথবা সংশ্লিষ্ট জাদুঘরের সাথে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে নির্বাচন করে জাদুঘরের দর্শকের নিকট সৃজনশীল চিঠি লিখে প্রেরণের জন্য আহবান করা যেতে পারে। সেরা চিঠি লেখকদেরকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং নির্বাচিত  কিছু চিঠি জাদুঘরের কোন প্রকাশনায় প্রকাশ করতে পারে। এধরণের সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে জাদুঘরমূখী করা গেলে সামাজিক বিভিন্ন অবক্ষয় থেকে শিশু- কিশোরদেরকে দুরে রাখার চেষ্টা করা যায়।

চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী: আধুনিক শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি বহুল ব্যবহৃত উপকরণ। বিভিন্ন জাদুঘরের  নির্বাচিত ঘটনা ও প্রেক্ষাপটের উপর ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রামাণ্য শিক্ষার পাশাপাশি জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য  শিক্ষা ও বিনোদন প্রদান করা সম্ভব

অগ্রজ জাদুঘরকর্মীদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়: অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে অবসরে যাওয়া অগ্রজ জাদুঘরকর্মীদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যেতে পারে। এ ধরণের অর্ন্তভূক্তিমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অগ্রজ প্রজন্ম অবসারকালিন গুণগত সময় পার করার সুযোগ পাবেন, অন্যদিকে অগ্রজ প্রজন্মের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জাদুঘর কর্মীগণ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবেন।  

নিদর্শন কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা: নিদর্শন কেন্দ্রিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিত্রাঙ্কন, রচনা ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অয়োজন করা যেতে পারে।  এ ধরনের প্রতিযোগিতা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত চলতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগীদের গ্যালারি পরিদর্শন শেষে নির্বাচিত  নিদর্শকে  বিষয় নির্ধারণের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে জাদুঘরমুখী করে নিদর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ তৈরি করে। অনলাইনেও এধরণের প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে । সে ক্ষেত্রে নিদর্শনের তথ্য চিত্র অনলাইনে প্রদর্শন ও বিষয় নির্ধারণ করে প্রতিযোগিতার আহবান করা যায়। 
অনলাইন প্রকাশনা: জাদুঘরের শিক্ষা কার্যক্রমকে অর্থবহ করে তুলতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে প্রকাশনা। প্রকাশনার মাধ্যমে জাদুঘরের কর্মকান্ড দেশবাসীকে জানানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের সাময়িকী, জার্নাল ও গবেষণাগ্রস্থ প্রকাশ করা যেতে পারে। বিশেষ প্রদর্শনী, স্বল্পকালীন প্রদর্শনীর ওপর ক্যাটালগ বা গাইড, নিয়মিত কর্মকান্ড প্রচারের জন্য নিউজ বুলেটিন বা বার্তা এবং গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য গবেষণা পত্রিকা এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। প্রকাশনার ব্যবস্থা জাদুঘরের শিক্ষা কার্যক্রমকে অর্ন্তভূক্তিমূলক ও গতিশীল করে। করোনা মহামারি কালীন দু:সময়ে নিয়মিত মূদ্রিত প্রকাশনা বের করার ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংকটের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে  অনলাইন জার্নাল, বার্তা ও ক্যাটালগ প্রকাশের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী।

অনলাইন লাইব্রেরি চালুকরণ: অনলাইন লাইব্রেরি চালুকরণ সময়ের দাবি । অনেক জাদুঘরে অনেক দূর্লভ বই রয়েছে । সে সব বই গবেষক ও সেবা গ্রহীতাদের ঘরে বসে পড়ার সুবিধার্থে এবং অর্ন্তভূক্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় অনলাইন লাইব্রেরি সেবা চালুকরা যেতে পারে।  অনলাইন প্লাটফর্মে সেমিনার, আলোচনা সভা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা: ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাদি গ্রহণ করে সেমিনার, আলোচনা সভা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন চালানো প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে জাদুঘর কর্মীদের আভ্যন্তরীন সেমিনার, সভা ও কর্মশালার আয়োজন চালু করে সাংস্কৃতিক সম্পদের বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন ও সুরক্ষায় পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন করা সম্ভব। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক  ২০১১ সালের ৪ মে মুক্তযিুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে জাদুঘর পরিদর্শন করছেন  (সংগৃহীত)


বিশেষজ্ঞ বক্তৃতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জাদুঘর পরিদর্শন কর্মসূচির আয়োজন : মাঝে মধ্যেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বক্তৃতা বা স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা যেতে পারে। এই বক্তৃতায় সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে গবেষকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। এছাড়াও দেশীয় এবং আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জাদুঘর পরিদর্শন ও মোটিভেশনাল কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে।  এমনকি ঐতিহ্য সংরক্ষণবিদ, জাদুঘরবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকসহ সংশ্লিষ্ট গবেষকগণের সমন্বয়ে অনলাইনেও আর্ন্তজাতিক সম্মেলন বা সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। 

বঙ্গবন্ধুর নাতনি, জাতিসংঘের অটিজম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুল- এর সাথে ইউনিসেপের মোটিভেশোনাল স্পিকার Janis McDavid  কর্তৃক  বঙ্গবন্ধু ভবন  স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন,  ৭ জুলাই ২০১৭ (সংগৃহীত)

গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ: জাদুঘরকে মূলত গণবিশ্ববিদ্যালয় বা গণশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সঙ্গত কারণেই জাদুঘরকেও গণবিশ্ববিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশ করা এবং গবেষণার ক্ষেত্রগুলিকে সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বাংলাদেশে জাদুঘরগুলির গ্যালারিতে প্রদর্শিত নিদর্শনের আলোকচিত্র ও তথ্য ব্যবহরের জন্য অনুমতি গ্রহণে একজন গবেষককে যে জটিল পথ অতিক্রম করতে হয়, সেকল সেবাগুলিকে সহজ করে গবেষণার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। জাদুঘরের নিদর্শনসমূহের ডিজিটাল ডকুমেন্টেশনের মাধ্যমে অনলাইনে ক্যাটালগ প্রকাশের ব্যবস্থা করা যায়। তবেই গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে পারে। স্থানিক পরিসরের স্বল্পতার কারণে একটি জাদুঘরের সংগৃহিত সকল নিদর্শনই গ্যালারিতে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়না। অধিকাংশ নিদর্শন স্টোরে সংরক্ষিত থাকে। এসকল নিদর্শনের ক্যাটালগ প্রকাশের ব্যবস্থা গবেষক মহলে চাহিদা রয়েছে। কিন্তু জনবলের স্বল্পতা,  অগ্রাধিকার তালিকায় কম গুরুত্ব ও বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে এ কাজটি জাদুঘরগুলিতে বাস্তবায়নের ধীরগতি রয়েছে। জাদুঘররগুলির  গবেষণায় সমতার জন্য অর্ন্তভূক্তি ও বৈচিত্র্য আনায়ন করতে হলে ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন ও ক্যাটালগ প্রকাশের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করার এখনই সময়। 

গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ: সাংস্কৃতিক সম্পদ  সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী সম্পর্কিত কাজে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে দক্ষ পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। সংরক্ষণের প্রকৌশলগত কাজে সরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া ব্যক্তি বা বেসরকারী পর্যায়ে দক্ষ জনবল ও প্রতিষ্ঠান পেশাদারিত্বভাবে গড়ে উঠছে না। সরকারী প্রতিষ্ঠানের জনবলের কর্মজীবন শেষে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ বা কাঠামোও গড়ে উঠছে না। অন্যদিকে নতুন নিয়োগের মাধ্যমে জনবলকে সংরক্ষণ কাজে দক্ষ করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় উদ্যোগও লক্ষ করা যায় না। বেসরকারী পর্যায়ে ২/১ টি কাজের উদাহরণ পাওয়া গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে এ কাজগুলোর কোন স্থায়ী কাঠামো গড়ে উঠেনি। এজন্য একটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। জাতীয় সংস্কৃতি নীতি-২০০৬ তে প্রশিক্ষণ ইনিষ্টিটিউট গড়ে তোলার ঘোষণা রয়েছে। এ নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ভারত, জাপান, ফ্রান্স, কোরিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এধরণের গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট রয়েছে। এধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে জাপান বা কোরিয়ার কৌশলগত সহায়তার মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঐতিহ্য তহবিল গঠন: ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারী অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যক্তি, বেসরকারী ও দাতা সংস্থাগুলোর নিকট থেকে দান বা চাঁদা বা স্পন্সর গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের  প্রত্নসম্পদের সুরক্ষা এবং জাদুঘর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ঐতিহ্য তহবিল গঠন করা যেতে পারে। শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে এধরণের ঐতিহ্য তহবিল গঠনের দৃষ্টান্ত লক্ষ করা গেছে। প্রস্তাবিত এ তহবিল থেকে বেসরকারী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জাদুঘরসমূহ পরিচালনায় প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। 

জনবল বৃদ্ধি: বাংলদেশে পুরাকীর্তি ও জাদুঘর পরিচালনা, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হলো সীমিত জনবল। ফলে জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরী

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, জাদুঘর হলো সমাজ, জাতি ও দেশের দর্পণ। একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে দেশি-বিদেশিদের কাছে তুলে ধরতে জাদুঘরের প্রয়োজন। ছবি যেমন কথা বলে, তেমনি জাদুঘরের জড় নিদর্শনগুলো শিক্ষা প্রদান করে। সুতরাং জাদুঘরকে জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে নিদর্শন শিক্ষার বিকল্প নেই (আলী,২০০৫:০৫-০৭)। জাদুঘরের বিনোদন ও  শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই বৈচিত্র্যময় এবং অর্ন্তভূক্তিমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সাম্যাবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে জাদুঘরকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলা প্রয়োজন। তবেই অর্ন্তভূক্তির মাধ্যমে সমতা পথে অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম হবে।  সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রূখে স্বজাতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রকাশ জাদুঘররে বৈত্র্যিময় প্রদর্শনীতে ও  বৈশ্বিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই সম্ভব। বৈষম্য, বিস্মৃতি আর বিকৃতির বিরুদ্ধে  বৈচিত্র্যময় প্রদর্শনী ও  অর্ন্তভূক্তিমূলক জাদুঘর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তবেই  টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে  জাদুঘর   অবদান এবং স্থায়ীত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য জাদুঘরগুলির রূপান্তরমূলক উপলব্ধি ও  সম্ভাবনা প্রতিভাত হবে।  এভাবেই প্রজান্মান্তরে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের কথা বলবে জাদুঘর। এবারের আর্ন্তজাতিক জাদুঘর দিবসে এই হোক আমাদের প্রত্যাশা ।

তথ্যসূত্র: 
Amborse T & C.Paine 1993, Museum Basics, Routledge, NY

আহমদ, অধ্যাপক এ এফ সালাহ্উদ্দিন ; কথ্য ইতিহাসের রূপরেখা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর,ঢাকা-১৯৯১।

আনিসুজ্জামান,১৯৯৯;জাদুঘরে কেন যাবো;জাদুঘর সমাচার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৯৯৯।

আলী, মোঃ ছাবরে; জাদুঘররে শক্ষিা র্কাযক্রম, নউিজ লটোর, বাংলাদশে জাতীয় জাদুঘর, ২০০৫ । 
 
খান, শামসুজ্জামান, ১৯৯৯;  জাদুঘর, সেকাল ও একাল: একটি চকিত অবলোকন; জাদুঘর সমাচার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন-১৯৯৯।

খান, শামসুজ্জামান, ১৯৯৯;  মিউজিয়াম কেন জাদুঘর; জাদুঘর সমাচার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ১ম বর্ষ, ১ ম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ-১৯৯৯।

হুদা, মোঃ খতিবুল; একুশ শতকের জাদুঘর ও শিক্ষা, প্রত্নতত্ত্ব, ভলিউম-৮, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০২ ।

পাল, সমর,২০০৭,  জাদুঘর ও বিশ্বজনীন ঐতিহ্য,২০০৭ সালে  আর্ন্তজাতিক জাদুঘর দিবস  উপলক্ষ্যে পঠিত প্রবন্ধ। 
 
মোতাহার, হোসনেয়ারা, ২০০১, প্রত্নতত্ত্ব জার্নাল, ভলিউম-৭, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

URL-1: EU-LAC-MUSEUMS and the ICOM Definition of a Museum , Available from: https://eulacmuseums.net/index.php/project-en/museums-pt-2   Accssed: 14 February 2023 ) 

URL-2:  ICOM (International Council of Museums ),  Museum Definition.2022, Available from:  https://icom.museum/en/resources/standards-guidelines/museum-definition/  (Accssed: 14 February 2023 ) 

URL-3: https://icom.museum/en/international-museum-day/

  
আমিরুজ্জামান পলাশ : জাদুঘর কর্মী; প্রাক্তন সদস্য, জাতির জনক  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর কমিটি ( ২০০৯-২০১০)
email:  [email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ