আজকের শিরোনাম :

ভালো থেকো কলকাতা

  সৌমিত্র দস্তিদার

১৬ মে ২০২৩, ১০:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

রাত গভীর হতে না হতেই কলকাতা শহর কেমন বদলে যায়। শুধু কলকাতা শহর নয়, সব শহরের চেহারাই রাতে অন্য রকম হয়ে যায়। দিনের আলোর জনপদ তখন কী রকম যেন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে। আর পুরোনো শহরগুলোর রাত বড় মোহময়। কলকাতার প্রাচীন প্রাসাদোপম অট্টালিকার কার্নিশে শব্দ করে আচমকা পেঁচা ডেকে ওঠে। সাবেক গলি দিয়ে ঠুনঠুন করতে করতে বুড়ো রিকশাওয়ালা বাসায় ফেরে। জড়ানো বেসুরো গলায় সুর ভাঁজতে ভাঁজতে টলমলো পায়ে এক মাতাল সংসার খুঁজতে থাকে। কবরের গভীরে অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। শ্মশানের নৈঃশব্দ্য খানখান করে কে যেন স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় ডুকরে কেঁদে ওঠে। এই শহরের কত আখ্যান, কত গল্প, ইতিহাস।

শুনশান বিবাদীবাগ চত্বরে গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যান ১৭৫৬ সালে। ওই যে কয়লাঘাট, জেনারেল পোস্ট অফিস ওখানেই তো ছিল ইংরেজ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দুর্গ। কেল্লা থেকে অপভ্রংশ হতে হতে কয়লাঘাট। ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না নবাব সিরাজউদ্দৌলার। কম বয়সে নবাব, তার ওপর আলীবর্দী খাঁর প্রিয় নাতি, সে কেন ইংরেজ বণিকদের সব দাবি বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে! তা ছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতলব কর ঠিকঠাক না দিয়ে মুনাফা করা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এক কথায় সব মেনে নেয়ার বান্দা নন। শোনা যায় দাদু আলীবর্দী খাঁও নাকি মৃত্যুশয্যায় নাতিকে পৈপৈ করে ইংরেজ বণিকদের ধূর্তামি সম্বন্ধে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। সিরাজ কম বয়সেও এটুকু বুঝেছিলেন যে সাহেবদের মতলব সুবিধের নয়। এও আঁচ করেছিলেন যে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে তার অন্দরমহলেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ফলে পাল্টা আক্রমণের পথে সিরাজদ্দৌলা পলাশী যুদ্ধের ঠিক আগের বছর অতর্কিত কলকাতা আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করলেন ইংরেজ বাহিনীকে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন এমন এমন কোম্পানির সাধের দুর্গকে। রাতের অন্ধকারে কারা যেন ফিসফিসিয়ে ইতিহাসের গল্প বলে।

পলাশীর পরাজয় নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক বড় বাঁক বদল। এ দেশের সমাজকাঠামো তার পর থেকে নানাভাবে বদলে যেতে লাগল। ঢাকার রমরমা আগেই গেয়েছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবি বোলবোলাও ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। কলকাতা হয়ে উঠতে লাগল সারা দেশের মুখ্য আকর্ষণ। অবিভক্ত বাংলার গ্রাম থেকেও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ ছুটে আসতে লাগলেন ইংরেজ বণিকদের সাধের শহরে। এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অজস্র ব্রিটিশ যুগের উপাদান রয়ে গেছে এ শহরের আনাচে-কানাচে। পুরোনো গির্জা, প্রাসাদ, হঠাৎ করে চোখে পড়া গ্যাসবাতির স্তম্ভ বা কবরের বিষণ্ণতা। লোকে বলে, চাঁদের আলোয় বা অমাবস্যার অন্ধকারে আলীপুরের হেস্টিংস হাউসে শোনা যায় ঘোড়ার পায়ের শব্দ। ওয়ারেন হেস্টিংস নাকি দ্বিতীয় স্ত্রী মারিয়ানাকে নিয়ে রাত গভীর হলে হাওয়া খেতে বের হন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এলিজা ইম্পের হরিণ বাগান থেকেই তো আজকের পার্ক স্ট্রিট। ওই তো সেই বাড়ি, যেখানে প্রেমের কারণে খোলা তলোয়ার হাতে ডুয়েল লড়াইয়ে মেতে উঠেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস ফিলিপ ও ওয়ারেন হেস্টিংস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম দিকের সাহেবদের অধিকাংশই ছিলেন এক্কেবারে বাপে খ্যাদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে। কোথাও কিছু ভদ্রসমাজে হওয়ার নেই, তাই ভাগ্য ফেরানোর আশা নিয়ে নতুন কলোনি কলকাতার বাসিন্দা হতে জাহাজে চড়ে বসা। তবে তাদের প্রাণশক্তি ছিল দুর্দান্ত। তখন কলকাতায় কলেরা, ম্যালেরিয়া আরও কতশত রোগ। চিকিৎসার অভাবে রোজ মৃত্যু লেগেই আছে। কিন্তু ইংরেজদের ডোন্ট কেয়ার ভাব। আজ যে মদের সঙ্গী, ভোর হতে না হতেই তার মৃত্যুর খবর এল। কবর দিয়ে ফের অন্য কাউকে নিয়ে উদ্দাম পার্টি। থেমে যাওয়ার বালাই নেই। এমন প্রাণশক্তি না থাকলে কি আর কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদকে বছরের পর বছর শাসন করা যায়!

কলকাতা দেখতে হলে হেঁটে ঘুরতে থাকুন। কলকাতা মানেই তো আর নিউ মার্কেট, কফি হাউস, চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম বা সায়েন্স সিটি নয়, কলকাতার পথেঘাটে এখনো পাবেন অজস্র দ্রষ্টব্য। আমরা বলি গাড়িঘোড়া। একদা এই শহরে ঘোড়ার কদর ছিল। ঘোড়ায় টানা ট্রাম যেদিন পথে নেমেছিল, সেদিন অবাক চোখে শয়ে শয়ে লোক তা দেখতে ভিড় জমিয়ে ছিলেন ট্রাম রাস্তার দুধারে। সে রাম নেই। অযোধ্যাও অতীত। কিন্তু বাংলা শব্দভাণ্ডারে রয়ে গেছে গাড়িঘোড়া। যেমন রয়ে গেছে পথঘাট। নদীবাহিত পথ ছিল একসময় যাতায়াতের বড় মাধ্যম। নানা মাপের জলাশয় এই সেদিনও এ শহরের সৌন্দর্য ছিল। ঘাট ছিল যাপনের অঙ্গ। তাই তো পথের সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পথঘাট। আপাত অচেনা এই শহরকে দেখতে নয়, আবিষ্কার করতে হয়। তাহলেই তার অন্তরকে আপনি স্পর্শ করতে পারবেন। এক কলকাতার মধ্যে আছে অনেক শহর। ভোরে, দুপুরে, রাতে তার আলাদা আলাদা মেজাজ, আলাদা চেহারা। রাত না চিনলে ভোরের সৌন্দর্য অধরা থেকে যাবে।

রাত নিছক অন্ধকার নয়। গভীর রাতে শহরের বুকে আলো ঠিকরোয়। আবহ সংগীত তৈরি করে নৈঃশব্দ্যের অন্ধকার। কলকাতা বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তবু আজও মায়ের মমতায় সে আমাদের জড়িয়ে রাখে। ঝড়-জল-দাবদাহ তার ওপর দিয়ে বয়ে চলে। তবু সে কখনো অভিমান করে না। এভাবেই কলকাতা আমাদের। আমরা কলকাতার। ভালো থেকো আমার শহর। ভালো থেকো কলকাতা।

লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ