আজকের শিরোনাম :

১ মণ ৪০ সের সমান ৩৭.৩২৪ কেজি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ১৩:৩৪

মণ এক প্রকার পরিমাপের একক, যা ওজন মাপের জন্য একসময় বাংলায় ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হতো। ৪০ সেরে ১ মণ হয়। ১ মণ প্রায় ৩৭.৩২৪ কিলোগ্রাম (কেজি)-এর সমান। ১ সের সমান ০.৯৩৩ কিলোগ্রাম (প্রায়) বা ১ কিলোগ্রাম সমান ১.০৭১ সের (প্রায়)। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জায়গায় সের-কে কিলোগ্রাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলনের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে মণ এককটি প্রায় লোপ পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইকারি ক্রেতারা কৃষকের থেকে ৪০/৪১ কেজিতে এক মণ হিসাবে ধান কিনেন। কিন্তু বাজারে ৪০ কেজিতে এক মণ হিসাবে চাল-ডালসহ কোনো রবিশস্যের প্যাকেট কিনতে পাওয়া যায় না।

রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী ‘চাষী’ কবিতায় লিখেছেন : “সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা/দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।” মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাংলাদেশের মাঠে স্বপ্নের সোনার ফসল ফলায় এদেশের কৃষকরা। কিন্তু ডিডিটাল বাংলাদেশেও শোষণের বেড়াজাল থেকে পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি চাষিদের। প্রান্তিক চাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া যেন নিয়তির নিয়মিত খেলা। ইতোপূর্বে গণমাধ্যমে ‘৪৮ কেজিতে মণ হিসাবে ধান কিনছেন ফড়িয়ারা, কৃষকের মাথায় হাত’, ‘গলাচিপায় ৪৮ কেজিতে ধানের মণ!’ ‘৪১ কেজিতে ১ মণ’ এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষকের দুর্ভোগের চিত্রই উঠে এসেছে এসব প্রতিবেদনে।

ড. আকবর আলী খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বই থেকে জানা যায়, “বিশ^খ্যাত মসলিন ব্যবসায়ে তাঁতিরা লাভবান হতো না। লাভ করত বিদেশি ফড়িয়ারা, তাদের দালালরা এবং সরকারি কর্মকর্তারা। মসলিনের দামের শতকরা ২০ ভাগ মুঘল কর্মকর্তাদের কমিশন হিসেবে দিতে হতো। নগণ্য মজুরির বিনিময়ে মসলিন উৎপাদনের জন্য শাসকরা তাঁতিদের বাধ্য করত। বাংলায় দক্ষ তাঁতি হওয়া ছিল দুর্ভাগ্যের লক্ষণ, কারণ তাদের স্বল্প মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে হতো।’ যুগ যুগ ধরে প্রান্তিক শ্রমজীবীদের দুর্দশার প্রায় সমচিত্র বহমান।
আশুলিয়ার মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের খুচরা বিক্রেতা সাইফুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘পাইকারি চাল বিক্রেতারা ৫ কেজি, ১৫ কেজি, ২৫ কেজি ও ৫০ কেজি ওজনের চালের বস্তা বিক্রি করে থাকেন। কিন্তু ৪০ কেজির কোনো চাল ডালের বস্তা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে নেই। ৩০ কেজি ওজনের ডালের বস্তা পাওয়া গেলেও ৪০ কেজি ওজনের বস্তার হদিস নাই।’

খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, ‘পাইকারি ব্যবসায়ীরা কৃষকের থেকে ৪০ কেজিতে মণ হিসাবে ধান বা রবিশস্য কিনলেও নিজেরা আমাদের কাছে ৪০ কেজি মণে কিছু বিক্রি করেন না।’

গত ২৭ মার্চ ধামরাইয়ে কুল্লা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে এক কৃষকের বাড়িতে পাইকারের লোকের ধান মাপের সময় বিষয়টির সত্যতা চাক্ষুষ করেছেন প্রতিবেদক। কৃষকদের থেকে ধান কেনার সময় ৪১ কেজিতে (৪১.৩২৪ কিলোগ্রাম) এক মণ ধরে হিসাব করা হয়। কিন্তু ৪০ কেজিতে এক মণ হিসাবে ঢাকা জেলার সাভার নামা বাজার ও ধামরাইয়ের কালামপুর বাজারে চাল বিক্রির নজির পাওয়া যায়নি। ধারাইয়ের প্রান্তিক কৃষক জাহাঙ্গীর আলম ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘ধানে না হয় বস্তার ওজন বাদ দিয়ে ওজন মাপা হয়; কিন্তু সরিষার ক্ষেত্রেও ৪১ কেজি এক মণ হিসাব ধরা হয় কোন যুক্তিতে। আমরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি।’

৪১ কেজিতে মণ ধরে কেন ধান কিনেন এমন প্রশ্নের জবাবে ধানের পাইকার মো. আওয়াল বলেন, ‘১ হাজার কিলোগ্রামে এক কেজি হলে ৪০ কেজিতে এক মণ তো ঠিকই আছে। আর বস্তার ওজন আছে না, সে-জন্য এক কেজি বেশি নেই। এছাড়া ৫০ কেজির চালের বস্তায় আমরা এমনিতেই ২০০ গ্রাম চাল বেশি দিয়ে থাকি।’

লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওজন এবং পরিমাপে কম-বেশি করা জঘন্যতম গুনাহ। কাউকে ঠকানোর মাধ্যমে উপার্জন করা মানবিক দিক থেকেও অপরাধ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ-ধরনের কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) একবার পরিমাপকারী ও দাঁড়িপাল্লা দ্বারা ওজনকারী ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘তোমাদের ওপর দুইটি জিনিসের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যে জিনিস দুইটির দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার কারণে তোমাদের আগের উম্মত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।’ (তিরমিজি) 

দেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর অন্যতম মূল দায়িত্ব হচ্ছে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতির প্রচলন, বাস্তবায়নসহ ওজন ও পরিমাপের সঠিকতা তদারকি এবং নিশ্চিতকরণ। মণ একক এর বিষয়ে বিএসটিআই উপ-পরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক ‘বাংলা বিচিত্রা’কে বলেন, ‘আইনত দেশে সের বা মণে ওজন পরিমাপের কোনো হিসাবের (একক) প্রচলন নেই। ৪০ কেজিতে এক মণ হিসাবে কোনো কিছু ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণ দেখাতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ক্রেতা-বিক্রেতারা কেজিতে কিনবে কেজিতে বিক্রি করবে, লিটারে কিনবে লিটারে বিক্রি করবে। বিএসটিআই’তে জনবলের সংকট নেই। দেশের যে কোনো প্রান্তে ওজনে কারচুপির তথ্যপ্রমাণ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’

প্রসংগত, ১৯৬০ সালে সিজিপিএম ৬টি মৌলিক একক মিটার, কিলোগ্রাম, সেকেন্ড, অ্যাম্পিয়ার, ডিগ্রি বা কেলভিন ও ক্যান্ডেলা-সহ এককের আন্তর্জাতিক সিস্টেম (এসআই) চালু করে।

লেখক : সনজিৎ সরকার উজ্জ্বল, নিজস্ব প্রতিবেদক

এবিএন/জসিম/গালিব

এই বিভাগের আরো সংবাদ