আজকের শিরোনাম :

দরকার দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালী করা

  আলাউদ্দিন মল্লিক

১৮ মার্চ ২০২৩, ১০:১৬ | আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩, ১০:১৯ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
বিশ্বে অর্থনৈতিক কূটনীতির শুরু 
১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই একটি ভিন্ন মিশন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু। পৃথিবী শাসনের আকাংখা নিয়ে যে নতুন এক ব্যবস্থা এই দেশটি নিয়ে আসে তাইই অর্থনৈতিক কূটনীতি। মূল ভাবটি হল -অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল করার জন্য দেশের কূটনৈতিকদেরকেও উদ্যোগী ভূমিকা রাখা। তার মানে হল, ব্যবসায়ীদের সাথে বিদেশে দেশের কূটনৈতিকদেরও বড় ভূমিকা রাখতে হবে। আর এভাবেই অর্থনৈতিক কূটনীতির শুরু।

ব্যতিক্রমী কার্যক্রম 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে বিদেশে কূটনৈতিকদের জন্যও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নেয়া হতে থাকে।  তাই বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে- বিশেষতঃ শুরু হতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে - যেমন মেক্সিকো, কানাডা, কিউবা ইত্যাদি।  ক্রমান্বয়ে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে ইউরোপ এবং সমগ্র পৃথিবী।

অর্থনীতিই শেষ কথা
স্বাভাবিক অর্থনীতি আর কখনোই ফিরবে না: অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত বিশ্লেষক অ্যাডাম টুজ ২০২০ এর করোনার লকডাউন শুরু হলে দুনিয়াজুড়ে সবাই এর তুলনা খোঁজা শুরু করেন ১৯১৪, ১৯২৯, ১৯৪১ ইত্যাদি। তখন হলো কি, এই পরিস্থিতি যে ঐতিহাসিকভাবে মহত্ত্বপূর্ণ, সেই ব্যাপারটা প্রতিভাত হয়। পৃথিবীতে নতুন কিছু হচ্ছে, ব্যাপারটা ভয়াবহ। অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স সম্পর্কে অতীতের সমস্ত প্রক্রিয়ার খোলনলচে বদলে গেছে -প্রথাগত পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই পেন্ডামিক অনলাইন কেনাবেচা আর সামাজিক দুরুত্বকে আমাদের জীবনের অপৰিহাৰ্য উপাদানে পরিণত করেছে। প্রযুক্তির উপর মানুষের এতটাই নির্ভরশীলতা বেড়েছে যে প্রযুক্তি ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে যে বিশ্ব প্রধান বিলিওনারদের বেশির ভাগ প্রযুক্তি ব্যবসায়ী। 

ইউক্রেন যুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রভাব: ২০২২ এর ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বিশ্বকে আরেকটি নতুন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।  জ্বালানি তেল আর গ্যাসের দ্রুত মূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি পরিবহনের নিত্য নতুন অস্বাভাবিক ব্যয় যুক্ত হওয়া, ইউরোপে ইউক্রেন হতে খাদ্য দ্রব্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা - আর এর ফলে বাকী বিশ্ব হতে তার যোগান - যার ফলে তৃতীয় বিশ্ব খাদ্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা কমে যাওয়া, পশ্চিমা বিশ্ব হতে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আর তার সাথে চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক যুদ্ধ একেবারেই নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।  দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পড়েছে নতুন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে - যার ফলে দেশগুলোর ভঙ্গুর অর্থনীতি আরো নাজুক পরিস্থিতিতে।  -নেপালে এর আংশিক দেখা গেছে, শ্রীলংকা দেউলিয়া, পাকিস্তান দেউলিয়ার প্রান্তে; বাংলাদেশও বিপদের মধ্যে। 

পশ্চিমা বিশ্বের ব্যয় সংকোচন: করোনা পেন্ডামিক, ইউক্রেন যুদ্ধ আর চীন-মার্কিন অথনৈতিক যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বকে ব্যাপক ব্যয় সংকোচন নীতি ব্যস্তবায়ন করতে হচ্ছে।  কারণ- প্রযুক্তি পণ্য প্রাপ্তির চীন নির্ভরশীলতা, খাদ্য সরবরাহদাতা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত, জ্বালানি উৎস রাশিয়ার উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফল হিসেবে রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করা।  আর এই ব্যয় সংকোচন সারা বিশ্বকে এমন ভাবে নাড়া দিয়েছে যে সবাই নিজেদের ভঙ্গুর  অর্থনীতি সামলাতে ব্যস্ত।

সামলে উঠছে অর্থনীতি 
করোনা মহামারীর ক্ষত কাটিয়ে ওঠার মধ্যে যুদ্ধের কারণে তেঁতে ওঠা বিশ্ববাজার গত তিনটি বছরের বড় অংশ জুড়েই ভুগিয়েছে; সময়ে সময়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কাও প্রকাশ পেয়েছে অর্থনীতিবিদসহ সরকারি নীতি নির্ধারকদের মুখেও। ‘দুর্ভিক্ষের’ অশনির কথাও উঠেছে কখনও কখনও।  অর্থনীতিতে ঝঞ্ঝার বছরগোলোর শেষ দিকে আশা জাগাচ্ছে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও সারের দাম কমার খবর; খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী ধারাও পড়তির পথ ধরেছে। দেশে অস্থিরতা কাটিয়ে ডলারের বাজারও এখন একটা পর্যায়ে এসে স্থিতিশীল।  বিপর্যয় কাটিয়ে আমনের ভালো ফলনের সুখবর অর্থনীতিতে একটা সুবাতাস বইছে। বৈদেশিক মুদ্রার টালমাটাল পরিস্থিতিও এখন অনেকটা সামলে উঠেছে অর্থনীতি।

অর্থনীতির সঞ্জীবনী বিদেশি ঋণ 
বিশ্ব ব্যাংকের কম সুদের ঋণ কর্মসূচির তহবিল আইডিএ থেকে বাংলাদেশ সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে; যার পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশকে ঋণদানকারী বিভিন্ন সংস্থা বা দেশের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক রয়েছে তালিকার শীর্ষে। উন্নয়ন কার্যক্রম বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অর্থায়নে ক্রমে অংশগ্রহণ বাড়ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) কিংবা চীনের নেতৃত্বাধীন নতুন এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) মত উন্নয়ন সহযোগীদের। বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে ঋণ দিতে পিছিয়ে নেই চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পশ্চিমা দেশ এবং সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও। শুধু সরকারি প্রকল্পে নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন সহযোগীদের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যিক অর্থায়ন বা বিনিয়োগও পাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক কোম্পানি।

গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি ঋণ: বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থায়ন দেখভালকারী সংস্থা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগ দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে গত ১০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। এখন এক লাখ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নেও হাত দিয়েছে সরকার; যেটির অর্থায়নের প্রায় সিংহভাগই আসবে বিদেশ থেকে।

ঋণ দিতে আগ্রহ বাড়ছে: বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সব উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা দেশেরই আগ্রহ রয়েছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার কোনও প্রকল্প নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণের আবেদন জানালে তারা খুবই ইতিবাচকভাবে দেখে। শুধু পদ্মা সেতুর ওই ঝামেলা ছাড়া এপর্যন্ত কোনও প্রকল্প নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। যত প্রকল্পে ঋণ চাওয়া হয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই তা পাওয়া গেছে। 

বাংলাদেশকে আইএমএফ -এর ঋণ সম্মতি: বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সে বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সমঝোতা হয়েছে। এর জন্য যে পাঁচটি শর্ত রয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সরকার সম্মত হয়েছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, অনেক চেষ্টা করেও যেখানে পাকিস্তান  আইএমএফ -কে কোনভাবেই রাজি করাতে পারছে না সেখানে বাংলাদেশের এই সাফল্য দেশটির অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থা কাটিয়ে একটি নতুন মাত্রা দেবে।

অর্থনৈতিক কূটনীতিই আসল 
অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদারে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণিজ্য ও রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দেশের স্নাতক বজায় রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ০৬ মার্চ ২০২৩  সন্ধ্যায় কাতারে আঞ্চলিক দূত সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার পাশাপাশি আপনাদের (কূটনীতিকদের) অর্থনৈতিক কূটনীতিকে শক্তিশালী করতে সক্রিয় হতে হবে।’ 

যে অর্থনৈতিক কূটনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ১৭৭৬ হতে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় শক্তি হতে বিশ্ব মোড়লে পরিণত করেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্ব-উত্তর পৃথিবীকে  প্রায় আট দশক ধরে শাসন করে চলেছে - বাংলাদেশও সেই পথেই অগ্রসর হয়েছে। এর ফলে করোনা উত্তর বিশ্বে শুধু টিকে থাকেনি বরং বিশ্বে একটি উন্নয়ন মডেলে পরিণত হয়েছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি অনন্য অবস্থান তৈরী করতে পেরেছে।  

দেশের অর্থনীতি যে প্রধান বিবেচ্য তার বহিঃপ্রকাশ নিকট অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সফল কূটনৈতিক সমাধান - যার ফলে আইএমএফ দেশটির অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য সহযোগী হিসেবে অবদান রাখতে শুরু করেছে।  দেশের ১৮ কোটি মানুষকে বেঁচে থাকা আর টিকে থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করাই যে রাষ্ট্র পরিচালকদের প্রধান দায়িত্ব - আর এটাই হল অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল বক্তব্য। কারণ দেশের মানুষ ভাল থাকলেই দেশ ভাল থাকে। আর এটি একটি সফল অর্থনীতির মূল বিষয়।

 

আলাউদ্দিন মল্লিক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ