আজকের শিরোনাম :

হুলহুলিয়া আর্দশ গ্রামের বিচার ব্যবস্থা আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

  মোশাররফ হোসেন মুসা

১২ মার্চ ২০২৩, ১৩:০১ | আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৩, ১৩:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

মোশাররফ হোসেন মুসা 
গণতান্ত্রিক শাসন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, স্বশাসিত স্থানীয় সরকার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দূরীকরণ ইত্যাদি নিয়ে প্রতিদিন কত কথাই না বলা হয়। বড় বড় ডিগ্রি ধারীরা বিদেশের উদাহরণ দেন, সরকার দেশের উন্নয়নে বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট নিয়ে আসেন, এনজিও’রা টেকসই প্রকল্প বাছাইয়ের জন্য পাইলটিং করার পরামর্শ দেন, রাজনীতি করা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেন; অথচ তাদের জানা থাকার কথা, এদেশে এগুলো আবিস্কার হয়েই আছে, এখন বাস্তবায়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। সম্প্রতি আমরা কয়েকজন নাটোর সিংড়া উপজেলার অধীন হুলহুলিয়া আদর্শ গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে সেটারই চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। এ যেন দেশের মধ্যে আরেকটি দেশ, স্থানীয় সরকারের মাঝে আরেকটি স্থানীয় সরকার। ইতিহাসবিদরা বলেন- এদেশ বারবার বিদেশের শাসনে থাকায় এদেশের নাগরিকদের মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা রয়ে গেছে। কিন্তু হুলহুলিয়া গ্রামবাসী শতপ্রতিকুল পরিবেশের মধ্যেও ১৯৪২ সাল থেকে নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। গত ৫০ বছরে গ্রামের কোন মানুষ থানায় মামলা করেনি। ঝগড়া-বিবাদ হলে গ্রামে বসে নিজেরাই মিমাংসা করে নেয়। 

হুলহুলিয়া গ্রামটি সিংড়া উপজেলার ১০নং চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে হলেও আলাদাভাবে সেখানে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। নিজস্ব সংবিধান দ্বারা সংগঠনটি পরিচালিত হয়। গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। ১ জন চেয়ারম্যান, ১ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৫ জন উপদেষ্টা ও ২১ জন সাধারণ সদস্য মিলে গঠিত হয়েছে গ্রাম উন্নয়ন পরিষদ। তাছাড়া পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে আলাদা আলাদা কমিটি। কোনো বাড়িতে ঝগড়াঝাটি হলে প্রথমে পাড়া কমিটি মিমাংসার চেষ্টা করে। তারা ব্যর্থ হলে উচ্চ আদালত তথা গ্রামপরিষদ সেটা মিমাংসা করে দেয়। গ্রামে শতভাগ লোক শিক্ষিত। এসএসসি পাশ বাধ্যতামূলক। কোনো বাল্যবিবাহের ঘটনা নেই। মাদকসেবীর সংখ্যা শূন্য। প্রকাশ্যে ধূমপান দেখা যায়না। ওই গ্রাম থেকে ১ জন বিচারপতি, ১০ জন জজ, শতাধিক চিকিৎসক ও প্রকৌশলী দেশে-বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। তারা এই গ্রামের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। বর্তমানে মো. আল তৌফিক পরশ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, পরিষদের নিজস্ব ফান্ডে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা রয়েছে। গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার খরচ, গরীব রোগীর চিকিৎসা, বিবাহযোগ্য কন্যার বিবাহ খরচ এই ফান্ড থেকে বহন করা হয়। 

ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের মতো তাদের একটি নিজস্ব ভবন রয়েছে। ভবনটিতে একদিকে সালিশিকক্ষ ও আরেকদিকে কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। দোতালায় অতিথিদের রাত্রী যাপনের ব্যবস্থা আছে। সংবিধান অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ভোটে পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নির্বাচিত হন (সঙ্গে থাকা জিএস রানা বলেন- মেয়েদের ভোটাধিকার থাকলে একশতে একশ নম্বর দেয়া যেতো)। সালিশিকক্ষে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সদস্য, অতিথি ও দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার রাখা আছে। বিচারপ্রার্থীর লিখিত অভিযোগ প্রকাশ্যে পাঠ করে শোনানো হয় এবং জুরিবোর্ডের পরামর্শমতে বিচারক রায় প্রদান করে থাকেন। বাদী-বিবাদী বিনা বাক্যে বিচারকের রায় মেনে নেন। রায়ের বিরুদ্ধে থানায় কিংবা কোর্টে গিয়ে নালিশ করার কোনো ঘটনা শোনা যায়নি। চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত থাকা সত্ত্বেও তারা কেন ইউনিয়ন পরিষদে না গিয়ে নিজেরা বিচার করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে সাধারণ সদস্যরা বলেন- গ্রাম আদালতে সালিশি ব্যবস্থা চালুর বহুআগে থেকেই এ গ্রামে সালিশি ব্যবস্থা চালু হয়। গ্রামের ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থেই তারা ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন না। পূর্বে এদেশে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। 

পঞ্চায়েত সদস্যরা স্থানীয় ঝগড়া-বিবাদের বিচার ও মিমাংসা করতেন। বৃটিশ সরকার ১৯১৯ সালে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার মামলার বিচারকরার ক্ষমতা বঙ্গীয় পল্লী স্বায়ত্বশাসন আইনের মাধ্যমে ইউনিয়ন বোর্ডকে প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের আমলে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ- ১৯৭৬’ এর অধীনে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা চালু হয়। তখন গ্রাম আদালতকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ প্রণয়ন করে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। বর্তমানে গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩) অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। আদালতকে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য বিষয়ে বিচার প্রার্থী নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করেন। একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন করে মোট পাঁচজন সদস্য মিলে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। তবে প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হবে। গ্রাম আদালতে যারা অভিযোগ দায়ের করেন, তারা অধিকাংশই এলাকায় মিলেমিশে বসবাস করতে চান। কিন্তু বাস্তবে কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়ায় সরকার ইউএনডিপি ও ইইউ-এর সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ ৩য় পর্যায়ে চালু রয়েছে। 

গ্রামআদালত সক্রিয়করণ- ২য় পর্যায়ে ১০৮০টি ইউনিয়নে ২,৩৬,৮৬৮টি মামলা আমলে নেয় এবং ২ লক্ষ মামলার নিষ্পত্তি করা হয়। দাতা গোষ্ঠী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য অস্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিযুক্ত করে। কোনো কোনো জায়গায় এনজিওদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। ইইউ রাষ্ট্রদুত চার্লস হুইটলি বলেন- কোনআইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা ছাড়াই ন্যূনতম খরচে ছোটখাট বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গ্রাম আদালত উত্তম ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের এসব বক্তব্যে কোন নতুনত্ব নেই। কারণ দীর্ঘকাল আগে থেকেই এদেশে সালিশী বৈঠকের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ঐতিহ্য রয়েছে। তারা যেসব ইউনিয়নে পাইলট প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেছেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেগুলো পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। দাতাসংস্থাগুলোকে যদি প্রশ্ন করা যায়, বিদেশের টাকায় কোনো দেশে গণতন্ত্র কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে কিনা, তাহলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবেনা। তবে চেয়ারম্যান- মেম্বররা বিচারের নামে কখনো কখনো পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন। তাদের হাতে নিষ্ঠুর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। সেজন্য স্থানীয় সরকারগুলোকে গণতান্ত্রিক করতে হবে। সিডিএলজি’র রূপরেখা মতে, ইউনিয়ন পরিষদে ক্ষমতার পৃথকীকরণতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তথা ইউনিয়ন প্রশাসন, ইউনিয়ন সংসদ ও ইউনিয়ন বিচারবিভাগ মিলে ‘ইউনিয়ন সরকার’ গঠিত হবে। ইউনিয়নের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ইউনিয়ন বিচারবিভাগের বিচারকের দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখা দরকার বাদী-বিবাদীর দোষ স্বীকারুক্তি ছাড়া সম্প্রীতি রক্ষা হয়না, সত্য প্রতিষ্ঠাও হয়না।  কিন্তু গ্রামের সালিশি বৈঠকে দোষ স্বীকার করলেওগ্রামের সালিশি বৈঠকে দোষ স্বীকার করলেও  একই ব্যক্তি উচ্চ আদালতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। হুলহুলিয়া আদর্শ গ্রামেরি বচারব্যবস্থা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে সেটাই দেখিয়ে দেয়। 

 

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক
E-mail: [email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ