আজকের শিরোনাম :

ইউক্রেন প্রসঙ্গে আমরা ভুল করছি

  ম্যাক্স আব্রামস; দ্য আটলান্টিক

১১ মার্চ ২০২৩, ১৩:০০ | অনলাইন সংস্করণ

ম্যাক্স আব্রামস
ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার যুক্তি ধ্রুপদী ডিটেরেন্স তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, তীব্রতার খেসারতের সংকেত দেখিয়ে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি সংঘর্ষ দমন করতে পারে। কিন্তু এ তত্ত্ব আবার স্পাইরাল মডেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ মডেলের মতে, শাস্তির ফলে কোনো শত্রর আচরণ আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে যা পারস্পরিক দিক থেকেই সংঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।

দিনের বেলা আমি নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদেরকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াই। আর রাতে ইউক্রেন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের লেখাগুলোয় চোখ বোলাই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোর মধ্যকার যে দূরত্ব; এ বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে। হয়তো অন্য পণ্ডিতেরা ভিন্নমত পোষণ করবেন — কিন্তু আমার বিশ্বাস — অনেকেই মনে করেন, রাশিয়াকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে আমেরিকাকে আরও সাবধানে এগোনো উচিত।

রাশিয়া কেন ইউক্রেন আক্রমণ করেছে?
পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষকই হয়তো ন্যাটোকে অমায়িক ও শুভাকাঙ্ক্ষী একটি সংগঠন হিসেবে দেখেন। এদের অনেকেই দাবি করেন, রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের উজ্জল নক্ষত্র ও বিতর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন মার্শেইমার জোর দিয়েই বলেছেন, ইউক্রেনকে গিলে ফেলার জন্য রাশিয়ার কোনো সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার 'প্রমাণ নেই'।

কিন্তু 'আক্রমণাত্মক বাস্তবাদ' নিয়ে তার কাজের মতবাদ অনুযায়ী, লৌহ যবনিকার পতনের পর থেকেই পূর্বমুখে ন্যাটোর অগ্রসরকে রাশিয়ার নেতারা হুমকি হিসেবেই দেখেছেন আর তা ইউক্রেন আক্রমণের ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পাওয়া শিক্ষা
১৯৩৮ সালে মিউনিখ কনফারেন্সে যুক্তরাজ্য নাৎসি জার্মানিকে সুডেটেনল্যান্ড অধিগ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত হিটলারের অঞ্চল দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাড়াতে প্রভাব ফেলেছিল।

ইউক্রেন যুদ্ধের আলোচকেরা এটিকে 'মিউনিখের শিক্ষা' হিসেবে বর্ণনা করছেন। তাদের মতে, ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে ভবিষ্যতে আরও ভূমি দখল করার উৎসাহ পাবে রাশিয়া। এ ধরনের আশঙ্কা করা ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাতেউশ মরাভিয়েসকি, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি বেন ওয়ালেস প্রমুখ।

এ তথাকথিত মিউনিখ থেকে শিক্ষা কেবল ইউক্রেন আলাপেই মুখ্য নয়। অতীতে কোরিয়া নিয়ে হ্যারি ট্রুমান, সুয়েজ প্রসঙ্গে অ্যান্থনি এডেন, কিউবান মিসাইল সংকট বিষয়ে জন কেনেডি, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লিন্ডন জনসন, ও পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে জর্জ বুশ 'মিউনিখের পাঠ' উপস্থাপন করেছিলেন।

তারপরও, ঐতিহাসিক উপমাসমূহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভিত্তি সরবরাহ করে। ২০১২ সালে এক পেপারে আমি দাবি করেছিলাম, এ ধরনের উপমা এর সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতার চেয়ে জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে সাধারণত ব্যবহারের জন্য নির্বাচন করা হয়। আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট জার্ভিসও দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে এ ধরনের ঐতিহাসিক উপমাগুলো অতীতের ঘটনাগুলোর চেয়ে ভিন্ন বর্তমান ঘটনার বিভিন্ন আঙ্গিককে ঝাপসা করে দেয়।

যে রাশিয়া নিজেদের সীমান্ত থেকে মাইল বিশেক দূরের খারকিভই দখল করতে পারেনি, তারা কী মনে করে ইউরোপ দখল করতে যাবে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিষয়ক উপমা ইউরোপের চেয়ে এশিয়া প্রসঙ্গে বেশি খাটে। অনেকে ঐতিহাসিক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র কেবল জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলেনি, এর পেছনে আরেকটি কারণ ছিল নিজেদের সামরিক ক্ষমতা দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জাপান থেকে বাইরে রাখা।

একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ভোগানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হতে পারে ভবিষ্যতে তাইওয়ান দখল করতে গেলে চীনকে কী কী মূল্য দিতে হবে তা নিয়ে ভয় দেখানো। সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা কাউন্সিলে এমন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যই করেছিলেন ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ।

অবশ্য ঐতিহাসিক উপমাগুলো কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবে সেনা মোতায়েন করেছিল। পরে, নয়-এগার'র হামলার পেছনে এ ঘটনাকেই মূল ওজর হিসেবে দেখিয়েছিল বিন লাদেন। একইভাবে নিজের সামরিক আগ্রাসনের জন্য পুতিনও ন্যাটোকে দায়ী করেছেন। এখানে অবশ্যই আমি নয়-এগার বা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের জন্য আমেরিকাকে দোষ দিচ্ছি না, বরং এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে ইতিহাস শব্দটি কত অর্থই না বহন করতে পারে।

ইউক্রেনে সামরিক সহায়তাবৃদ্ধি পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন কমাবে না বাড়িয়ে তুলবে?
আটলান্টিক কাউন্সিল-এর ডিস্টিংগুইশড ফেলো আলেকজান্ডার ভার্শবো বলেছেন, 'রাশিয়াকে সামরিকভাবে নিরস্ত করতে' আমেরিকা ও ইউরোপের উচিত ইউক্রনেকে 'ভারী অস্ত্র, দীর্ঘপাল্লায় হামলাযোগ্য অস্ত্র, আকাশ ও মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা' সরবরাহের গতি বাড়িয়ে তোলা। ম্যানহাটন ইন্সটিটিউট-এর ব্রায়ান রিডলও একই সুরে কথা বলেছেন। গেটস্টোন ইনস্টিটিউট-এর গর্ডন চ্যাং তো আরও এক কাঠি সরেস। এক টুইটে তিনি সতর্ক করেছেন, ইউক্রেনে আরও বড় সামরকি প্যাকেজ দিয়ে পুতিনকে নিরস্ত করা না গেলে শীঘ্রই মার্কিন উপকূলে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও বিমানের দেখা মিলবে।

এ যুক্তি ধ্রুপদী ডিটেরেন্স তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, তীব্রতার খেসারতের সংকেত দেখিয়ে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি সংঘর্ষ দমন করতে পারে। কিন্তু এ তত্ত্ব আবার স্পাইরাল মডেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ মডেলের মতে, শাস্তির ফলে কোনো শত্রর আচরণ আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে যা পারস্পরিক দিক থেকেই সংঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।

বেসামরিক ইউক্রেনীয়দের রক্ষায় সর্বোত্তম পথ কোনটি?
ইউক্রেনে আরও বেশি অস্ত্র সরবরাহের পক্ষে সাধারণ একটি যুক্তি হলো দেশটির নাগরিকদের কষ্ট কমানো। মার্কিন বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট বিল ব্রোডারের মতে, পুতিন পশ্চিমের ভয়কে আরও বেশি সাধারণ ইউক্রেনীয়কে হত্যার সুযোগ হিসেবে দেখছেন। রাশিয়ায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতও মনে করেন, পুতিন যদি ভয় পান যে তিনি ক্রিমিয়া হারাবেন, তাহলে তিনি আলোচনার টেবিলে বসবেন। তাই ক্রিয়েভকে আরও বেশি অস্ত্র দেওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের।

কিন্তু 'বেসামরিক নাগরিকদের ভুক্তভোগী হওয়া' বিষয়ে গবেষণালব্ধ আলোচনা এ যুদ্ধে রাশিয়ার বেপরোয়া মনোভাব ও ইউক্রেনীয় সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার মধ্যে বিপরীতধর্মী সম্পর্ককেই নির্দেশ করছে। ১৮১৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ১০০টি আন্তর্দেশিক যুদ্ধ নিয়ে গবষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক আলেকজান্ডার বি. ডাউনস দেখিয়েছেন, কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি ক্ষয়ক্ষতি, যুদ্ধের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হওয়া, যুদ্ধের গতি আগ্রাসনের দিকে মোড় নিলেই কোনো রাষ্ট্র প্রতিপক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর অত্যাচার চালানো বাড়িয়ে দেয়।

অন্যান্য গবেষকেরা দেখিয়েছেন, প্রতিপক্ষের কাছে কোনো দেশ দুর্বল হয়ে পড়লে এটি প্রতিপক্ষের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আগ্রাসন বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে যাতে এটি কৌশলগত পটভূমি আবারও নিজের পক্ষে আনতে পারে। সাধারণ ধারণার বিপরীতে গিয়ে অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বললে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নাগরিকদের কম সহায়তা করলে তাতে কূটাভাসপূর্ণভাবে ইউক্রেনীয়দেরই লাভ হবে।

সিলেবাসে নেই, তবে আমি আমার শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পেপারে একটি প্রশ্ন রেখেছি: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অ্যাকাডেমিক পাঠ কীভাবে ইউক্রেন বিষয়ে মার্কিন নীতিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে?

ম্যাক্স আব্রামস: যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রুলস ফর রেবেলস: দ্য সায়েন্স অভ ভিক্টরি ইন মিলিট্যান্ট হিস্টরি বইয়ের প্রণেতা।
সৌজন্যে : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

এই বিভাগের আরো সংবাদ