আজকের শিরোনাম :

আমেরিকাই এ সর্বগ্রাসী যুদ্ধের নেপথ্যে

  মোনায়েম সরকার

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

মোনায়েম সরকার
ইউক্রেনে রাশিয়া যে ‘বিশেষ অভিযান’ পরিচালনা করেছিল, তা দ্রুত পরিসমাপ্তির দিকে যাবে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। পরাক্রমশালী রাশিয়ার কাছে দুর্বল ইউক্রেন সপ্তাহখানেকের বেশি টিকে থাকতে পারবে না বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ঘটেনি এজন্য যে, ইউক্রেন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠেছে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট বনাম রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র। ভ্লাদিমির জেলেনেস্কির নেতৃত্বাধীন ইউক্রেন সেনাবাহিনী আসলে একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে ন্যাটো জোটের পক্ষে। তাদের সামরিক সহায়তায় পুষ্ট হয়ে ইউক্রেন বাহিনী এ অসম যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোটের কৌশলগত সহায়তাও পাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

রাশিয়া অন্যায় ও রীতিবিরুদ্ধভাবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে- এমন সোরগোল তুলে দেশটির বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ যেসব পণ্য বিক্রি করে রাশিয়া তার অর্থনীতি পরিচালনা করে আসছে, সেগুলো যেন সে বিক্রি করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো যারা কিনবে, তারা দেশটির ‘যুদ্ধ অর্থনীতি’কে মদদ জোগাচ্ছে বলে অভিহিত করা হচ্ছে। যেমন, ভারতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কারণ ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছিল কম দামে। নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়াও তেল-গ্যাস বিক্রি শুরু করেছে বাজারের চেয়ে কম দামে। তার সুযোগ ভারতের মতো দেশ কেন নেবে না, যাদের অনেক জ্বালানি প্রয়োজন? বিশাল অর্থনীতির দেশ চীনেরও প্রচুর জ্বালানি তেল প্রয়োজন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর চীনের সঙ্গেও রাশিয়ার সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। রুশ-চীন বিরোধ চলেছে দীর্ঘদিন- যদিও দুটিই সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল। এ বিরোধের সূত্র ধরে সারা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও দ্বিধাবিভক্ত ছিল। যাহোক, বর্তমানে দুটি দেশই পুঁজিবাদী ধারায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল। রাশিয়া খনিজসম্পদে পরিপূর্ণ একটি বিশাল দেশ। সামরিক শক্তিতেও তার অবস্থান ধরে রেখেছে রাশিয়া। অপরদিকে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন পরাশক্তি। আগামীতে চীনা অর্থনীতি বিভিন্ন দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়ছে। চীনের তুলনামূলক কম দামের পণ্যসামগ্রী ছাড়া আমেরিকার সাধারণ মানুষেরও চলে না। আর রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর ইউরোপের অনেক দেশই নির্ভরশীল। এ কারণে ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও ভুগছে। তাদেরকে বেশি দামে ওইসব জরুরি পণ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে দূরের বাজার থেকে, যেটা হয়তো তাদের জন্য অসুবিধাজনক উৎস।

এমন পরিস্থিতিতে খোদ আমেরিকাতেও সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে বৃটেনসহ বিভিন্ন দেশে। কারণ জ্বালানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলে এর দাম বেড়ে যায় এবং এর প্রভাব পড়ে সব ক্ষেত্রেই। রাশিয়া হলো জ্বালানির এক বড় সরবরাহকারী। এদিকে রাশিয়া যে উইক্রেনে অভিযান পরিচালনা করছে, সে অঞ্চলকে বলা হয় পৃথিবীর একটি বড় শস্যভা-ার। গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আসে ওই অঞ্চল থেকে। ভয়ানক যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের মতো দেশেও। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আমরাও মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়তে শুরু করেছি, যা নিয়ে এখানে হীন রাজনীতিও শুরু হয়েছে। আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতি যেসব দেশের, তারা এ যুদ্ধে যে পক্ষেই অবস্থান নিক- অর্থনৈতিক সংকট থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এ অবস্থায় ইউক্রেনে ‘হামলাকারী দেশ’ বলে অভিহিত করে রাশিয়াকে দায়ী করা যেতে পারে। সেটা করা হচ্ছেও। কিন্তু সত্যি বলতে, রাশিয়াকে এ যুদ্ধে আসতে প্ররোচিত করা হয়েছে এবং দেশটি বাধ্য হয়েছে ইউক্রেনে অভিযানে চালাতে।

ইউক্রেন দীর্ঘদিন রাশিয়া তথা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এ দুই দেশের জনসাধারণের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং ঐতিহাসিক। কিন্তু ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ কিছু ঘটনা, বিশেষত দেশটিতে রুশভাষী জনগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও নির্যাতনের সংস্কৃতির বিস্তার, এর ডনবাস নামক অঞ্চলে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন মোকাবেলায় ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা এ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে অনেকটাই। হঠাৎ করে রাশিয়া ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করেছে, এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিস্তার ঘটেছে বলে যারা অভিযোগ করেন, তারা এটা গোপন করতে চান যে, ইউক্রেনে উত্থান ঘটেছে নব্য নাৎসীবাদের এবং এরা রুশবিরোধী দক্ষিণপন্থী শক্তি। জেলেনেস্কির পেছনে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছে এ অপশক্তি এবং এদেরকেই জোর সমর্থন দিয়ে চলেছে আমেরিকার নেতৃত্বে তথাকথিক উদারবাদী পশ্চিমা জোট। সম্প্রতি তারা একাধিক দেশ থেকে অত্যাধুনিক ট্যাংক ইউক্রেন বাহিনীকে সরবরাহ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অত্যাধুনিক মিগও নাকি দেওয়া হবে। এসব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণও তারা ইউক্রেন সরকারকে দেবে। তাতে এ সর্বগ্রাসী যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হবে বলেই মনে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষে রক্তক্ষয়ও কম হচ্ছে না। নিরপেক্ষ উৎস থেকে তথ্য যদিও পাওয়া যাচ্ছে না, তবে উভয় পক্ষের দাবি বিচার করে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট ইউক্রেনের পক্ষে যোগ না দিয়ে যুদ্ধটা একতরফা হয়ে পড়তো এবং ক্ষতিও হতো এখনকার চেয়ে অনেক কম। সেটা না হয়ে পাল্টাপাল্টি হওয়ায় উভয় পক্ষই পরস্পরের যতটা সম্ভব ক্ষতি সাধনে উঠেপড়ে লেগেছে।

ইউক্রেন বিরাট দেশ হলেও এটা ছিল ইউরোপের সবচেয়ে গরিব দেশ। এরই মধ্যে দেশটির বিরাট অঞ্চলে সড়ক, সেতুসহ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অনেকটাই বিধ্বস্ত। খাদ্য, পানি, ওষুধ সরবরাহ সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বহু মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে, যারা হারিয়েছে কষ্টার্জিত সহায়সম্পদ ও তাদের স্বাভাবিক জীবন। রাশিয়াও কম ক্ষতিগ্রস্ত নয়। তাদের সেনাবাহিনীর বহু সদস্য হতাহত হয়েছেন, যুদ্ধে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন জেনারেল। নিষেধাজ্ঞায় যতটা কাবু করা যাবে বলে মনে করা হয়েছিল, ততটা কাবু না হলেও রাশিয়ার অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সন্দেহ নেই। অনেকে মনে করছেন, জেলেনেস্কি সরকারকে দিয়ে কিছু অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে রাশিয়াকে বাধ্য করা হয়েছে এ যুদ্ধে নামতে- যাতে দেশ হিসেবে তার নতুন অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া যায়। ইউক্রেন সরকার শুধু ডনবাসের স্বাধিকারের দাবি মেনে নেবে বলে কথা দেয়নি; তারা এ অঙ্গীকারও করেছিল, দেশটি কোনো সামরিক জোটে যোগ দেবে না। সামরিক জোট বলতে এখন রয়েছে ন্যাটো। সোভিয়েত কেবল নয়, তার নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোট বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর ন্যাটো জোট রয়েছেই বা কেন- এরও কোনো সদুত্তর নেই। কিন্তু এটা রয়েছে এবং এর সদস্য সংখ্যা ৩০ আর ইউক্রেন এতে যোগ দিতে পারলে সদস্য বেড়ে দাঁড়াতো ৩১। সদস্য সংখ্যায় কিছু যায় আসে না; কিন্তু রাশিয়ার নাকের কাছে একটি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক জোটে যোগ দিলে তার নিরাপত্তা যে বিপন্ন হয়, সেটা বুঝতে বেশি বুদ্ধিমান হতে হয় না। ইউক্রেন এ বিষয়ে সাংবিধানিকভাবেও অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেখানে রুশবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটার পর তারা সংবিধানে পরিবর্তন আনে এবং ন্যাটোতে যোগদানের পথ প্রশস্ত করে। আমেরিকার প্রশ্রয়ে এটা ছিল স্পষ্টতই যুদ্ধের উস্কানি এবং সে যুদ্ধই এখন চলছে- যার শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধ বন্ধে শান্তি আলোচনাও মাঝে শুরু হয়েছিল এবং ওখানকার সমুদ্র বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে কিছু সমঝোতাও হয়। কিন্তু পশ্চিমা উস্কানিতেই মূলত সে প্রক্রিয়া আর অগ্রসর হয়নি, বরং যুদ্ধের আগুন আরও বেশি করে জ্বলে উঠেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা যদি ‘আগ্রাসন’ই হয় এবং এজন্য যদি সবাই মিলে তাকে কাবু করতে হয়, তবে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়াসহ যেসব দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে হামলা চালিয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে, সেজন্য তার কী সাজা হওয়া উচিত? ভুল তথ্যের ওপর ভর করেও সে হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন দেশে। রেজিম চেইঞ্জ বা জঙ্গিবাদ দমনের নাম করেও ভয়ানক হামলা চালিয়ে সমৃদ্ধ দেশ ও জনজীবন ধ্বংস করেছে আমেরিকা। এর নেপথ্যে ছিল তাদের হীন বাণিজ্যিক স্বার্থ। আর ন্যাটো জোট হয়েছে তার এসব অপরাধের সমর্থক বা সঙ্গী। তারাই আজ ইউক্রেনে রাশিয়ার অপরাধ বিচার করতে নেমেছে। তাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল আনাও ব্যাহত হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে পণ্য আমদানি বাবদ লেনদেনও ব্যাহত হচ্ছে এবং বিকল্প উপায়ে সম্পন্ন করতে হচ্ছে সেটা।

এ সর্বগ্রাসী যুদ্ধ তাই যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা প্রয়োজন। আমেরিকা তার একাধিপত্য আরও জোরদার করতে হোক বা তার সমরাস্ত্র শিল্পকে চাঙ্গা করতেই হোক- যে কারণেই এ যুদ্ধের আয়োজন করে থাকুক, তার অবসানে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বের শান্তিকামীদের। ইউক্রেন যুদ্ধের আশু সমাধান না হয়ে এটা প্রলম্বিত হলে পারমাণবিক হামলার সম্ভাবনাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটা পর্যায়ে এ যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার শংকাও ব্যক্ত করছেন অনেকে, যা কার্যত ডেকে আনবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

 

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এই বিভাগের আরো সংবাদ