পদ্মা সেতু : ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিরাপদ খেয়া
অজয় দাশগুপ্ত
৩০ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪৪ | আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৭:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ
পদ্মা সেতু : ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিরাপদ খেয়া
পদ্মা সেতু কত কিছুই না বদলে দিল। মহাকালের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়া এ সেতু যেন ঝড়ের খেয়া। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কু-বার্তা নিয়ে ধেয়ে আসছিল ‘সিত্রাং’। সময় নির্ধারিত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত কেনো সময়ে। অতীতে এ ধরনের বিপদ-সংকেত বার বার দেওয়া হয়েছে। বরিশাল-খুলনা-পটুয়াখালী-বরগুনা-পিরোজপুর-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট-ভোলা-কক্সবাজার-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম, এ সব উপকুলীয় জেলার বাসিন্দারা এ ধরনের সংকেত নিয়মিতই পেয়ে থাকে। বরিশাল-পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের যে জেলাকে নৌ পথের ওপর এতদিন নির্ভর করতে হতো, তারা প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায়, এমনকি জিম্মি তা বিশেষভাবে স্পষ্ট হতো ঝড়-জলোচ্ছাসের পূর্বাভাস আসার পর। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা শুরু হতো- লঞ্চ বন্ধ, ফেরি বন্ধ, বিমান বন্ধ। সিত্রাংয়ের সংকেত আসার পরও ব্যতিক্রম হয়নি। ঝড়-জলোচ্ছাসে সবচেয়ে বেশি বিপদ থাকে নৌপথে। কিন্তু শুরুতেই যে বললাম পদ্মা সেতুর কথা। ২৪ অক্টোবর সকালে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ঢাকা থেকে রওনা হই বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামের পথে। পদ্মা সেতু চালুর আগে সড়ক পথে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে মহাকালের অলঙ্ঘনীয় বাধা পদ্মা নদী। ঝড়ের সামান্য পূর্বাভাস এলেই বন্ধ করে দেওয়া হতো ফেরি। কিন্তু ২৪ অক্টোবর নির্ভয়ে এগিয়ে চলি সিত্রাংয়ে সবচেয়ে ঝৃুঁকির মধ্যে থাকা জেলা বরিশালের পথে। আগের রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে বিরামহীনভাবে। গাড়ির কাচ ঝাপসা। চলতে হচ্ছে সতর্কভাবে। রাস্তার দুই পাশেই গাছ। এ পথে শত শত বার চলেছি। গাছের ডালপালা রাজপথের ওপর এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সবুজ-সুড়ঙ্গ পথ ধরে এগিয়ে চলছি। সিত্রাংয়ের কারণে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস বইছে। রাস্তার পাশের গাছ ভেঙে গাড়িতে পড়ার ভয়, পথের ওপর পড়ে রাস্তা বন্ধ হওয়ার ভয়। গোপালগঞ্জের টেকেরহাটের কাছে একটি গাছ পড়ায় কিছু সময় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের গাড়িটি ওই এলাকা অতিক্রমের সময় দেখি, বড় করাত কল দিয়ে গাছটি কেটে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা আশপাশের এলাকার বাসিন্দা, যারাই এ মহৎ কাজ করায় উদ্যোগী হয়ে থাকুক, ধন্যবাদ দিতে পারিনি। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। কারণ মাথার ওপর ঝুলছে বিপদ-সংকেত।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ২৪ অক্টোবর পৌঁছে যাই বরিশালের গৈলা গ্রামে। বরিশাল-খুলনা-যশোর অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা খুব ভাল। ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অন্তত অর্ধেক এলাকা যখন অন্ধকারে, তখনও আমি বরিশাল ছিলাম। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের খবর পাই ফেসবুক ও সংবাদপত্র-টেলিভিশনের অনলাইন সংবাদ থেকে। ওই ‘জাতীয় বিপর্যয়ের সময়’ বরিশাল অঞ্চলে এক মুহূর্তের জন্যও বিদ্যুৎ যায়নি। রাজধানী ঢাকা যখন ঘোর-কৃষ্ণ দুঃসময় কাটাচ্ছে, আমি তখন আগৈলঝাড়ার বকশীর বিল অঞ্চলের প্রত্যন্ত একটি এলাকায় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই-খাতা-কলম ও বৃত্তির অর্থ বিতরণের একটি অনুষ্ঠানে কথা বলছি। অগ্রজ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও খ্যাতিমান শিক্ষক আশীষ দাশগুপ্ত এ অনুষ্ঠান ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগিয়ে ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন। একান্ন বছর আগে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যদের জন্য ভয়ঙ্কর এক জনপদ। ২৫ এপ্রিল (১৯৭১) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন চার বীর মুক্তিযোদ্ধা- আলাউদ্দিন বক্স, আবুল হাসেম, মোখতার হোসেন ও পরিমল মণ্ডল। মোখতার হোসেনের বাড়ি বাটাজোর এলাকায়। কিন্তু তাকে সহযোদ্ধারা সমাহিত করেন ধানডোবা এলাকায়। কারণ ছিল একটিই- এ বিল এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আসতে সাহস করবে না। কাছেই দোনারকান্দি এলাকা। ১৪ মে সেখানে অনিল মল্লিকের নেতৃত্বে একদল গ্রামবাসী ল্যাজা, বল্লম, বাঁশের লাঠির আঘাতে চার জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র দখলে নিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা বিপদে পড়েছিল জলাভূমির কারণে। অথচ পাঁচ দশক পর সেই জলাভূমিতেই আমাদের স্বাগত জানান হয় আলো ঝলমল পরিবেশে, যেখানে সচল ছিল ইন্টারনেট সুবিধা।
এটাই যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ! স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস, বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি- এ ধরনের বদনাম দিচ্ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কু-মন্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সফরের সময়। তিনি বলেছিলেন, আমরা বাস্কেট কেস নই। আমাদের সম্পদ লুট করে ম্যানচেষ্টার, করাচি, পিন্ডি গড়ে উঠেছে। একদিন আমরা ঘুরে দাঁড়াবোই।
বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষতায় থাকাকালে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সচিব ছিলেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ওই সময়ে দেশ পরিচালনা করছিল অনির্বাচিত একটি গোষ্ঠী। রাজনৈতিক নেতা-ব্যবসায়ী-পেশাজীবী, শিক্ষক- অনেককে তখন প্রহসনের বিচারে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট ছিল চরমে। দ্রব্যমূল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। সরকারের তরফে ভাতের বদলে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল নাজুক। ‘ভুল নীতির কারণে এ সংকট অনিবার্য ছিল’- বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে এ মন্তব্য করেছেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান (প্রথম আলো, ২৩ অক্টোবর, ২০২২)। তাকে অনুরোধ করব, তিনি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় কী ধরনের বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি ছিল, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করার জন্য। বর্তমানে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা অসহনীয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিস্থিতি কি ২০০৭-২০০৮ মতো অসহনীয়? সে সময়ের তুলনায় অর্থনীতির আকার কয়কগুণ বেড়েছে। ২০০৮ সালের ৩০ জুন জিডিপি ছিল ৭৮ বিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক বলছে- ২০২১ সালে তা দাঁড়ায় ৪১৬ বিলিয়ন ডলারে। তিনি দায়িত্ব পালনকালে নতুন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি। এমনকি এ খাতে কোনো বড় উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছিল- তত্ত্বাবধায়ক সরকার অস্থায়ী, মৌলিক কাজে হাত দেওয়া যাবে না। সে সময়ে আর্মি ইলেকট্রিক-ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের এক প্রাক্তন বড় অফিসার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের উপদেষ্টা মনোনীত হয়েছিলেন। তাকে যেন বিদ্যুৎ দফতর না দেওয়া হয় সেজন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলেন- কারণ এ খাতের পরিস্থিতি ছিল শোচনীয়।
পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে নদীতেই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থার কারণে পায়রা, রামপালের বিদ্যুৎ সহজে আসবে ঢাকায়। ঈশ্বরদীর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারমাণবিক বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত হবে ভিন্ন পথে। তবে বিদ্যুতের প্রধান সমস্যা জ্বালানি। ডিজেল, গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়াম- কোনো কাঁচামালেই আমরা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। সেলশক্তি রয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা ব্যয়বহুল। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনিয়ম-অদক্ষতা-দুর্নীতি এবং এমনকি ষড়যন্ত্র, তাহলে দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি। এর মোকাবিলা সহজ নয়।
গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভাল থাকায় নতুন কারখানা স্থাপনে গতি এসেছে। পদ্মা সেতুর চালুর পর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ছে। মংলা বন্দর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। এমনকি ঢাকা ও আশপাশের এলাকার আমদানি-রফতানির জন্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি মংলা বন্দর ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে রাজধানী ঢাকার পড়শীতে পরিণত করেছে। এ সব নিশ্চয়ই ভুল নীতির ফল নয়। মাত্র চার মাস হয়েছে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। একদল ‘অথনীতিবিদ’ ও ‘বিশেষজ্ঞ’ বলছিলেন নিজের অর্থে এ সেতু নির্মাণ হবে মারাত্মক ভুল। এখন বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে তারা বলতে পারেন- এ জন্যও দায়ী পদ্মা সেতু। কারণ সেতুতে প্রচুল ডলার-পাউন্ড-ইউরো ব্যয় হয়েছে। কিন্তু নিশ্চিত বলতে পারি- অচিরে তারাই ভুল প্রমাণিত হবেন। গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ অনেকবার আমাকে বলেছেন- গ্রীষ্ম-বর্ষা ও হেমন্তে ঝড়-জলোচ্ছাস, শীতে কুয়াশা- প্রকৃতির হাতে বরিশালবাসী জিম্মি। সড়ক, নৌ ও বিমান যখন তখন বন্ধ করা হয়। আর রেলপথবিহীন জেলার বদনাম কেবল বরিশাল নয়, আরও কয়েকটি জেলা। পদ্মা সেতু এ জিম্মিদশা থেকে মুক্তির পথে বড় এক পদক্ষেপ। রেলগাড়ি চলার বিষয়টিও আর স্বপ্ন নয়। কেবল যাতায়াত সহজ করেনি এ প্রকল্প, অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এর সুফল মিলতে শুরু করেছে। দিন যত গড়াবে নতুন নতুন সুফল মিলবে। ঝড়ের পর ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো অনেক সহজ হবে এ সেতুর কারণে। দশ বছর আগে ২০১২ সালের ১ জুলাই লিখেছিলাম- ‘পদ্মা সেতু: প্রতিদিন বরিশাল থেকেই ঢাকায় অফিস করতে চাই’। এখন তা বাস্তব। বরিশাল, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকায় কাজ শেষ করে দিনের মধ্যেই ফিরে যাওয়া যাচ্ছে। দয়া করে কেউ এ অর্জনকে ভুল নীতির পরিণতি বলবেন না।
লেখক : ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রয়ি কমিটির সদস্য, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা।
এই বিভাগের আরো সংবাদ