জেলা পরিষদ নয়, জেলা সরকার প্রয়োজন

  মোশাররফ হোসেন মুসা

২২ অক্টোবর ২০২২, ১৭:০০ | অনলাইন সংস্করণ

মোশাররফ হোসেন মুসা
তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তন্মধ্যে ৫৭ টি জেলায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।  কিন্তু যারা নির্বাচিত কিংবা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত  হচ্ছেন তাদের কাছে প্রশ্ন- জেলা পরিষদ কি, এর কাজ কি, এর ইতিহাস কি কিংবা  জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের পার্থক্য কি ইত্যাদি তারা  বুঝেন কি না?

১৮৮৫ সালে বৃটিশ  শাসনামলে বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে প্রথম জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। জেলা বোর্ড নির্বাচিত কিংবা মনোনীত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হতো। লোকাল বোর্ডের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য নিজেদের মধ্য থেকে নতুবা বাইরে থেকে নির্বাচিত হতেন। অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ বিভাগীয় কমিশনার মনোনয়ন দিতেন। তারপর জেলা বোর্ডের সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন অথবা প্রাদেশিক সরকার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতেন। ১৯১৯ সালে বঙ্গীয় স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে  জেলা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে কিছুটা গণতন্ত্র আনয়ন করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে সদস্যরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান এবং এক বা একাধিক ব্যক্তিকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করতেন।  তখন জেলা বোর্ডের কাজ ছিল- শিক্ষা, গ্রামীণ এলাকার রাস্তাঘাট, পুল-সাকো নির্মাণ, জনস্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, ফেরিঘাট  ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। তখন জেলা বোর্ডের তিনটি আয়ের উপর নির্ভর থাকতে হতো- সেস বা ট্যাক্স, বিধান লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা ও সরকারি অনুদান। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে জেলা বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে জেলা কাউন্সিল রাখা হয়।  

পূর্বের তিনটি আয়ের উৎসের সাথে ফেরি পারাপারে ট্যাক্স আদায় ও মটর ভেহিক্যাল ট্যাক্স যুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পর জেলা কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে ' জেলা বোর্ড' রাখা হয়। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকার স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে ' জেলা পরিষদ' নাম রাখে এবং নির্বাচিত, অফিসিয়াল এবং মহিলা সদস্যদের সমন্বয়ে জেলা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করে। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার( জেলা পরিষদ) অাইনের মাধ্যমে ২২টি সাবেক জেলায় 'জেলা পরিষদ' বিদ্যমান রাখে। জেলা পরিষদের ১২ টি আবশ্যিক কাজ ও ৬৯ টি ঐচ্ছিক কাজ নির্দিষ্ট ছিল। তখন জেলা পরিষদের  যতটুকু কাজ ছিল সে তুলনায় বর্তমানে কিছুই নেই। যাকে স্থানীয় সরকারের আইকন বলা হয় সেই কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীও  একসময় জেলা বোর্ডে চাকরি করতেন। ২০০০ সালে ১৯৮৮ সালের জেলা পরিষদের আইন পরিবর্তন করে জেলা বোর্ড রাখা হয়। এ আইনে নির্বাচক মন্ডলীর ভোটে ( মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেম্বরদের ভোটে) একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য এবং ৫ জন সংরক্ষিত আসনে মহিলা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে জেলার জনসংখ্যা ও উপজেলার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচক মন্ডলী নির্ধারিত করা হয়েছে। জেলা পরিষদের পুরুষ সদস্যদের এক- তৃতীয়াংশ মহিলা সদস্য নির্বাচিত হবেন। যেমন- মেহেরপুর দুইটি উপজেলা থেকে দুইজন পুরুষ সদস্য নির্বাচিত হবেন এবং একজন নারী সদস্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হবেন। 

অাবার পাবনা জেলায় ৯ টি উপজেলা থেকে ৯ জন পুরুষ সদস্য ও ৩ জন মহিলা সদস্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হবেন।  অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে জেলা পরিষদের কাজ নয়, ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে জেলার এই স্তরটিকে বার বার ব্যবহার করেছে।  

তবে  ১৯৭৫ সালে বাকশাল ব্যবস্থা প্রচলন কালে বঙ্গবন্ধু  বলেছিলেন- সচিবালয়ে সচিবরা জেলাকে সামনে রেখে উন্নয়ন চিন্তা করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসকদের কাছে পত্র পাঠান। তারা জনগণ থেকে দুরে থাকেন। এখন থেকে সচিবালয়ে শুধু মন্ত্রী আর কয়েকজন সহকারী থাকবেন। সকল সচিবকে জেলায় চলে যেতে হবে   এবং ডিস্ট্রিক্ট গভর্ণমেন্টের অধীনে চাকরি করতে হবে৷ সেখানে গিয়ে  আপনারা জীবনমুখী অামলা হোন।" তাঁর পদ্ধতিটি সেসময় সময়োপযোগী ছিল। তখন বাংলাদেশ ছিল গ্রামীণ বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশটি নগরমুখী। বর্তমান গতিশীল সমাজকে সামনে করে শাসন ব্যবস্থার চিন্তা করতে হবে। এ অবস্থায় দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থাই সমাধান। জেলা পরিষদ নয়, জেলা সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। জেলা প্রশাসন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ দেখবে। আর জেলা সরকার জেলার যাবতীয় স্থানীয় কাজ( তথা নগরীয় ও গ্রামীণ কাজ)  তদারকি ও বাস্তবায়ন  করবে। তার আগে জেলা সরকারকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। 

জেলা প্রশাসন, জেলা সংসদ ও জেলা বিচার বিভাগ মিলে 'জেলা সরকার' গঠিত হবে। একই পদ্ধতিতে ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার ও উপজেলা সরকার( যদি এ স্তরটির প্রয়োজনীয়তা থাকে) গঠন করতে হবে। শাসন ব্যবস্থা হবে বটম-অাপ পদ্ধতির। মনে রাখা দরকার, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মুলে রয়েছে ত্রুটিপুর্ণ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আমরা যদি সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়ন চাই তথা জনগণের অংশগ্রহণমুলক শাসন চাই ; অর্থ্যাৎ আমরা যদি রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান চাই তাহলে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থার বিকল্প নাই( পুনশ্চঃ অাবুল মাল আবদুল মুহিত দীর্ঘদিন একাধিক সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি 'জেলায় জেলায় সরকার' নামে একটি বই লিখেছেন। যদিও তাঁর বইতে জেলা সরকারের কোনো রূপরেখা নেই। তাছাড়া তিনি জেলা সরকার বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগও নেন নি)। 

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ