আজকের শিরোনাম :

একটি পুলিশি হামলা ও রণেশ মৈত্রের ভূমিকা

  মোশারফ হোসেন মুসা

০৩ অক্টোবর ২০২২, ১৫:৪০ | অনলাইন সংস্করণ

মনীষীরা বলেছেন, প্রতিটি মানুষ জীবনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একবার বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ পায়। তেমনিভাবে তাকে একবারের জন্য হলেও কঠিনতম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমার জীবনে দুটি কঠিনতম বিপদের ঘটনা রয়েছে। একটি হলো গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা; অন্যটি হলো নৌকাডুবির ঘটনা। এখানে শুধু গ্রেফতারের ঘটনাটি উল্লেখ করব।
 
পাবনা জেলার পাকশীর নিকট পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত ‘লালন শাহ’ নামের সেতুটি উদ্বোধন করা হয় গত ১৮ মে ২০০৪ তারিখে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে চায়নার ‘মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোং’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করে এবং বিএনপির আমলে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। সেতুটি দুই মাস পূর্বেই চলাচলের উপযোগী হয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন সরকারের নির্বাহী বিভাগের এ রকম সিদ্ধান্ত থাকায় উদ্বোধন করার তারিখ দুবার পরিবর্তন করতে হয়। উল্লেখ্য ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য প্রায় এক হাজার চায়না শ্রমিক নিযুক্ত করে। তারা দ্রুত এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। তারা বুঝে ফেলে নিজ দেশে কাজে ফাঁকি দেওয়া কঠিন হলেও এদেশে কঠিন নয়। শোনা যায়, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে তারা নাকি এক সময় আপোষ করতে বাধ্য হয় এবং লোহা চুরির কাজে সহযোগিতা করতে থাকে। যা হোক, তিনজন চায়না শ্রমিক একটি চায়ের দোকানে উপস্থিত হলে দোকানে বসা কয়েকজন সাধারণ মানুষ জানতে চায় -কবে নাগাদ ব্রিজটি উদ্বোধন হবে। চায়না শ্রমিকরা ‘কিচির মিচির’ শব্দ করে যেসব কথা বলে সেগুলো দুর্বোধ্য মনে হলেও ‘বিউটি কুইন’ শব্দটির অর্থ সকলেই বুঝতে পারেন। সঙ্গে থাকা বাঙালি ড্রাইভার অনুবাদ করে আমাদের জানায়, তাদের দেশে এ জাতীয় ব্রিজ কাউন্টি মেয়র উদ্বোধন করেন। ব্রিজটি দুই মাস পূর্বে উদ্বোধন হলে প্রায় ২ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। গরীব দেশের এ জাতীয় বিলাসিতা ও আলসেমি তাদেরকে অবাক করেছে। তারা প্রায় নৃত্যের ভঙ্গিতে বলতে থাকে- ‘কবে নাগাদ তোমাদের বিউটি কুইন আসবে. কবেই বা আমরা ছাড়া পাব। এদিকে ‘আলি বাবারা’ লোহাÑলক্করগুলো সব চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা সব আলী বাবা (All are Ali baba)।’

তাদের কথাগুলো গুছিয়ে আমার বাল্যকালের একটি ঘটনার উল্লেখ করে রম্য রচনা টাইপের একটি ক্ষুদ্র লেখা লেখি (যা পশ্চিমা দেশে কুইক রাইটিং বলে)। আমার বাল্যকালের ঘটনাটি হলোÑবাড়ির পাশে একজন বিধবা মহিলা একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরুর আগে মিলাদের আয়োজন করেন। আমরা ছোটরা শিন্নি খাওয়ার লোভে মিলাদে উপস্থিত হই। মিলাদ শেষে মাওলানা সাহেব এক লম্বা মোনাজাত ধরেন। মোনাজাত যেন কিছুতেই শেষ হয় না। তিনি একের পর এক সকলের মঙ্গল ও মৃত আত্মীয-স্বজনের মাগফেরাত কামনা করে চলেছেন। অবশেষে আমি ধৈর্য্য হারিয়ে বলে উঠি‘হুজুর তাড়াতাড়ি করেন’ শিন্নি ঠান্ডা হয়ে গেলো।’ ক্ষুদ্রাকার লেখাটির শিরোনাম দেওয়া হয় ‘প্রধানমন্ত্রী তাড়াতাড়ি করেন, শিন্নি ঠান্ডা হয়ে গেলো’। লেখাটির ফটোকপি করে কয়েকটি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রেরণ করি (উল্লেখ্য, ফটোকপি করার সময় কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কৌতুহল বশতঃ কয়েকটি কপি নিয়ে যান। সম্ভবতঃ তাদের নিকট থেকে অথবা স্থানীয় পত্রিকা থেকে দু একটি কপি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নিকট যেতে পারে)। ১৬ মে ‘০৪ তারিখ সন্ধ্যা ৭টার সময় ঈশ্বরদী থানার তৎকালীন ওসি ইলিয়াস ফকির আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর লেখার কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করেন এবং নাশকতামূলক কাজে জড়িত আছি কি না জিজ্ঞাসাবাদের নামে লাঠি দিয়ে প্রহার করেন। তাছাড়া ওই ওসি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টেলিফোনে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের থানায় আসতে বলেন। (এখানে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, সে সময় ঈশ্বরদী থেকে ইমেল যোগে পত্রিকায় লেখা পাঠানো সুযোগ না থাকায় ডাকযোগে লেখা পাঠাতাম। আমি সাধারণত রেলওয়ে ডাক বিভাগের মাধমে চিঠি পাঠাতাম। সেখানে প্রতিদিনকার ডাক ধরতে গেলে রাত ৯.০০ টার মধ্যে চিঠি দিতে হয়। সেদিন ৯.০০ টার পরে সেখানে উপস্থিত হলে চিঠি প্রেরণ করতে ব্যর্থ হই। ফলে চিঠিগুলো আনোয়ার হোসেন নামে একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ির দোকানে রেখে দেই, যাতে পরদিন রাতে চিঠিগুলো সহজে প্রেরণ করা যায়। আমার চিঠিগুলো রাখার দায়ে উক্ত ব্যবসাযী আনোয়ার হোসেনকেও গ্রেফতার করা হয়)।  আমি সেসময়  ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবে পত্রিকা পড়ছিলাম। ওসি আমাকে মোবাইলে থানায় জরুরি কাজে আসতে বললে পাশে বসা প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণকে ঘটনাটি খুলে বলি। মোস্তাক আহমেদ কিরণ আমাকে আশ্বস্ত করে বলেন- ‘তুমি যাও, আমিও আসছি।’ মোস্তাক আহমেদ কিরণ আমাকে গ্রেফতার করার ঘটনাটি জানতে পেরে রণেশ মৈত্রকে জানান। রণেশদা বুঝতে পারেন, আমি একটি গভীর চক্রান্তের জালে আটকা পড়তে যাচ্ছি। তিনি তৎক্ষণাত পাবনার পুলিশ সুপারকে (তখন পুলিশ সুপার পদে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দায়িত্বে ছিলেন) টেলিফোনে বলেন, সে কোনো নাশকতামূলক কাজে জড়িত নয়। সে একজন রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি কর্মী। তাছাড়া তিনি পাবনা প্রেসক্লাবের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের কয়েকজন সদস্যকে আমার গ্রেফতারের ঘটনাটি অবহিত করেন। রণেশদার টেলিফোনে যে কাজ হচ্ছে তা থানা হাজত থেকে আমি বুঝতে পারি। ওসি প্রথমে ক্রুদ্ধস্বরে গালাগাল করলেও টেলিফোন পেয়ে তার মেজাজ নামতে থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলতে শুনি- ‘না, তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। থানা হাজতে শুধু আটক রাখা হয়েছে’। পরদিন আমাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে কোর্টে প্রেরণ করা হয় যার (মামলা নং-৬৭৩, তাং-১৭/০৫/০৪)। মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী পড়ে জানতে পেরেছিলাম, বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং পাবনা পুলিশ সুপারের নির্দেশে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর আগমন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আমি নাকি ব্যাঙ্গাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করেছি, আমি না কি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানকে বানচাল করার জন্য আত্মর্ঘাতমূলক কর্মকা- পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রয়েছি, সেজন্য জেসিআই ((Joint Interrogation Cell) এ আরও (!) জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়।

যথারীতি কোর্টে রিমান্ডের আবেদনের উপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে কোর্টে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। দেখি, রণেশদার নেতৃত্বে প্রায় বিশজন আইনজীবী রিমান্ড নামঞ্জুরের দাবি জানিয়ে একযোগে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। তাঁদের যুক্তি এক পর্যায়ে হৈচৈতে পরিণত হয়। ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ মোমেনা মনি রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে আমকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। আমাকে রিমান্ডে আনার জন্য থানা থেকে পুলিশ ভ্যান পাঠানো হয়েছিল। একজন আইনজীবী আমাকে বলেন- তিনি এই প্রথম দেখলেন যে, পুলিশের গাড়ী আসামী না নিয়ে থানায় ফেরত গেল। জেলখানা থেকে শুনতে পেলাম, পত্রিকায় আমাকে নিয়ে বহু লেখালেখি শুরু হয়েছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা বড়ই প্রয়োজন, আমার রম্য লেখাটির মর্মার্থ স্থানীয় লেখক ও সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই বুঝতে সক্ষম হননি। আমি বুঝাতে চেয়েছি, শিশুকালে আমরা যেভাবে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার কারণে বন্দি হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক একই ভাবে সরকারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের কারণে জনসাধারণ দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখে সরকারের গুণকীর্তন শুনতে বাধ্য হয়। রণেশদা লেখাটির ম্যাসেজ বুঝতে পেরে যুগান্তর, জনকণ্ঠ, সংবাদ, করতোয়া সহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক পত্রিকায় ‘পুলিশ ক্ষমতা দেখালো বটে’, ‘আঁধার ঘরে সাপ-সকল ঘরেই সাপ’ ইত্যাদি শিরোনাম দিয়ে একাধিক কলাম লেখেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় এডভোকেট শফিকুল ইসলাম শিবলী দৈনিক সংবাদে ‘শিন্নি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! প্রাসঙ্গিক তৎপরতা’  শিরোনামে পৃথক কলামে আমার উপর অবিচারের ঘটনাটি তুলে ধরেন। ফলে জেলা আইন-শৃংখলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয় এবং কল্পিত বিদ্রোহ মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন, জনৈক সাংবাদিক জেলখানায় আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন- আমি যেন জেলখানা থেকে জামিন নিয়ে বের না হই। কারণ প্রচারের যে সুযোগ পাওয়া গেছে সেটা নাকি জীবনে আর পাওয়া যাবে না। আমি সেদিকে না গিয়ে জামিনের সুযোগ গ্রহণ করি।

২৩ মে,‘০৪ তারিখে জেলখানা থেকে বেরিয়ে দেখি রণেশদা তাঁর দলবল সহ একগুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে তাঁর পা ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাছাড়া আলাউদ্দিন আহমেদ (ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও যুগান্তর প্রতিনিধি) এবং হাবিবুর রহমান স্বপন (সংবাদ প্রতিনিধি) বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পত্রিকায় রির্পোট করেন। গণফোরাম, জাসদ ও মুক্তিযুদ্ধের শহিদ স্মৃতি পাঠাগার আমার মুক্তি চেয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে। ফলে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপিত হয় এবং কল্পিত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । রণেশ মৈত্র পাবনায় বসবাস করলেও জাতীয় সমস্যা নিয়ে বেশি লিখতেন। তিনি ছিলেন বর্ণবহুল ও সফল জীবনের অধিকারী। একুশে পদকপ্রাপ্ত মহান হৃদয়ের মানুষটি গত ২৬ সেপ্টেম্বর’ ২২ খ্রি. তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে যেন আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি সে কামনাই করি। 

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক
[email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ