আজকের শিরোনাম :

বাবার হাতে পাচঁ আর মেয়ের হাতে পাঁচশ’র গল্প

  ডাঃ সামন্ত লাল সেন

২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৪১ | অনলাইন সংস্করণ

বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি এখন আমাদের দেশে অনেক আলোচিত একটা বিষয়। কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন এই প্লাস্টিক সার্জারির সেবাটিই বাংলাদেশে ছিলো না। স্বাধীনতাযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা যখন পঙ্গুত্ব বা অঙ্গহানীর কোনো সমাধান পাচ্ছিলেননা সে রকম এক সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাবেক পঙ্গু হাসপাতালে যান তাদের দেখতে। সেই সময়েই উনি অনুভব করেন দেশে প্লাস্টিক সার্জনের প্রয়োজনীয়তা। অতি অল্প সময়েই তিনি আমেরিকা থেকে ডাঃ আর যে গ্রাস্ট সাহেবকে নিয়ে আসেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। এভাবেই তাঁর হাত থেকে শুরু হয় এই দেশে প্লাস্টিক সার্জারির ইতিহাস। এখন যেই ইন্সটিটিউট এর নাম জাতীয় ট্রমা ও অর্থোপেডিক পুর্নবাসন ইন্সটিটিউট বা সংক্ষেপে নিটোর। মাত্র পাঁচ বেড দিয়ে শুরু বাংলাদেশের প্লাস্টিক সার্জারি। 

এরপরের গল্প আরও অভিনব। আর যে গ্রাস্ট সাহেব ইন্ডিয়ান একজন প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাঃ পারভেজ বেজলিল কে আনেন এই দেশে প্লাস্টিক সার্জারির সেবা সম্প্রসারণ করতে। তার সাথে আমি এবং ডাঃ মাজেদ মিলে কাজ শুরু করি। এরপর ১৯৮১ সালে ইংল্যান্ড থেকে অধ্যাপক ডাঃ শহীদুল্লাহ স্যার বাংলাদেশ ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিকেল এ কাজ শুরু করেন। আমি সেই সময়ে ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ শুরু করি এবং অধ্যাপক শহীদুল্লাহ তিনিই প্রথম বাংলাদেশে একটা স্বতন্ত্র বার্ন ইউনিট এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উনি তা দেখে যেতে পারেন নি। সেই সময় গুলোতে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির রোগীদের খুব দুরবস্থা ছিলো। কোনো আলাদা ওয়ার্ড না থাকায় দিনের পর দিন রোগীরা বিভিন্ন ওয়ার্ডের বারান্দায় থাকতো, নির্দিষ্ট কোনো প্রটোকল অনুসরণ করে তাদের কোনো সেবা দেওয়া যেতো না, অপারেশন এর শিডিউল ও পাওয়া যেতো না। এইরকম সময়গুলোতেই একদিন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই অগ্নিদগ্ধ রোগী দেখতে আসেন এবং তাদের দুর্দশা দেখে আমাকে বলেন, “ সামন্ত এদের জন্য আলাদা জায়গা খোঁজ”। 

অবশেষে ঢাকা মেডিকেল এর প্রাঙ্গণের সাথেই বস্তি ছিলো, সেটাকে অন্যত্র সরিয়ে একটা ৫০ বেডের হাসপাতাল শুরু করা হয় ২০০৩ সালে। পরবর্তীতে রোগীর চাপে খুব দ্রুতই সেটিকে ১০০ বেডে রূপান্তরিত করতে হয়। তবুও হিমসিম খেতে হয়, এতো পোড়া রোগীর দেশে। আর হবেই বা না কেন, সারা বাংলাদেশ থেকে এই সব রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। এরই মাঝে ২০০৯ সালে ঘটে নিমতলির ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা। সীমিত লোকবল আর সামর্থ্য দিয়ে আমরা যুদ্ধ করে গেলাম। অন্যদিকে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারির রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রোগীর জায়গা দেওয়ার বেড ফাঁকা থাকে না। একই বিল্ডিংয়ের আনাচে কানাচে রোগী রেখে এটাকেই আমরা তিনশ বেডে রূপান্তর করলাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ৫০০ এর নীচে রোগী কখনোই নামে না। এরই মাঝে আবার ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষী হয় বাংলাদেশ।

২০১৪-২০১৫ সালের স্মরণকালের সেই নিষ্ঠুরতার অগ্নিসন্ত্রাস। সাধারণ অসহায় মানুষ দগ্ধ হয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল বার্ন ইউনিটে। আবারও আমরা আমাদের সীমিত লোকবল দিয়ে এই বিশাল সংখ্যক রোগীকে সামাল দিলাম, চিকিৎসা দিলাম। এরই মাঝে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসলো যে এই ইউনিট টি যথেষ্ট নয় এতো পোড়ারোগীদের চিকিৎসার জন্য। 

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্লাস্টিক সার্জারির আন্তর্জাতিক কনফারেন্স উদ্ধোধন করতে আসেন। প্লাস্টিক সার্জারির কাজের পরিধির উপর একটা বৈজ্ঞানিক প্রেজেন্টেশন দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করেন যে বাংলাদেশে আসলে এখন একটা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের খুব প্রয়োজন। কারণ প্লাস্টিক সার্জারি মানে শুধু বার্নের রোগীই না বরং জন্মগত ত্রুটি , ক্যান্সার দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগীদের জীবন ও অঙ্গ ফিরিয়ে দিতে পারে, বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে। তারই আলোকে উনি দিকনির্দেশনা দেন যাতে বাংলাদেশ এ একটা বিশ্বমানের ইন্সটিটিউট স্থাপন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি আমরা। উনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মাত্র তিন বছরের মধ্যে আমরা সক্ষম হয়েছি বাংলাদেশের বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে। একমাত্র চায়না তে আছে ৪৫০ শয্যা বিশিষ্ট প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট। আর আমাদের শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক একটা হাসপাতাল যেখানে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি রোগীদের সমান ভাগে ভাগ করে সেবা দেওয়া হয়। এই ইন্সটিটিউট এ আছে পোড়া রোগীদের জন্য অত্যাধুনিক সব সুবিধা। 

-০২-
আন্তর্জাতিক মানের বার্ন ট্যাংক, ৪০ শয্যার আইসি ইউও, এইচ ডি ইও, আলাদা ওটি কমপ্লেক্স। এর পাশাপাশি আছে প্লাস্টিক সার্জারির আলাদা ওটি কমপ্লেক্স , উন্ড কেয়ার সেন্টার, লেজার সেন্টার, হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার। আছে ক্যাডাভারিক স্কিন ল্যাব, প্লাস্টিক সার্জনদের উৎকর্ষতা বাড়ানোর জন্য স্কিল ল্যাব, ট্রেনিং সেন্টার। এই আঠারো তলা ইন্সটিটিউটের শীর্ষে আছে হেলিপ্যাড সুবিধা যার মাধ্যমে জরুরি রোগীর দ্রুত পরিবহণ নিশ্চিত করা যাবে। আমি স্বপ্ন দেখি এই হেলিপ্যাড এ অদূর ভবিষ্যতে রোগী আসবে বহির্বিশ্ব থেকে আর আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র বিশ্বে। পরিপূর্ণ হবে প্রধানমন্ত্রীর সেই স্বপ্ন। 

আমরা বলতে পারবো আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি বিশ্বমানের ইন্সটিটিউট। আর পরিশেষে, যেই কথা না বললেই নয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে যেই পাঁচ বেডের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ আজ ২০১৮ সালে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ৫০০ বেডের ইন্সটিটিউট রূপান্তরিত হয়েছে। এই হচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারির “বাবার হাতে পাঁচ আর মেয়ের হাতে পাঁচশ’র গল্প” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এ এই গল্পটা সবার জানা থাকা প্রয়োজন।

লেখক:  জাতীয় সমন্বয়ক, বার্ন ইউনিট সমূহ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

এই বিভাগের আরো সংবাদ