আজকের শিরোনাম :

রক্তে ভেজা পনেরোই আগস্ট : ভিন্ন আঙ্গিকের বিশ্লেষণ

  আলাউদ্দিন মল্লিক

১৪ আগস্ট ২০২২, ০৯:৩৪ | আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২২, ০৯:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
 

দিনটির শুরু 

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দেয়াল উপন্যাসে  ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ভোররাতের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে ট্যাঙ্ক আসা হতে পুরো ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন,

পনেরোই আগস্ট শেষরাতে হরিদাস তার দোকানে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। মড়মড় শব্দ হচ্ছে—দোকান ভেঙে পড়ছে। হরিদাস ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে দৌড়ে দোকান থেকে বের হয়ে হতভম্ব। এটা আবার কী?

আলিশান এক ট্যাংক তার দোকানের সামনে ঘুরছে। ট্যাংকের ধাক্কায় তার দোকান ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ট্যাংকের ঢাকনা খোলা। দুজন কালো পোশাকের মানুষ দেখা যাচ্ছে। দোকান ভেঙে ফেলার জন্য কঠিন কিছু কথা হরিদাসের মাথায় এসেছিল। সে কোনো কথা বলার আগেই ট্যাংকের পেছনের ধাক্কায় পুরো দোকান তার মাথায় পড়ে গেল। পনেরোই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সূচনা করল হরিদাস।

ঢাকা মসজিদের শহর। সব মসজিদেই ফজরের আজান হয়। শহরের দিন শুরু হয় মধুর আজানের ধ্বনিতে। আজান হচ্ছে। আজানের ধ্বনির সঙ্গে নিতান্তই বেমানান কিছু কথা বঙ্গবন্ধুকে বলছে এক মেজর, তার নাম মহিউদ্দিন। এই মেজরের হাতে স্টেনগান। শেখ মুজিবের হাতে পাইপ। তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি এবং ধূসর চেক লুঙ্গি।

শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কী চাও? মেজর বিব্রত ভঙ্গিতে আমতা-আমতা করতে লাগল। শেখ মুজিবের কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব আবার বললেন, তোমরা চাও কী?

মেজর মহিউদ্দিন বলল, স্যার, একটু আসুন।

কোথায় আসব?

মেজর আবারও আমতা-আমতা করে বলল, স্যার, একটু আসুন।

শেখ মুজিব বললেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ তোমরা করবে?

এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে এল মেজর নূর। শেখ মুজিব তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশফায়ার করল। সময় ভোর পাঁচটা চল্লিশ। বঙ্গপিতা মহামানব শেখ মুজিব সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়লেন। তখনো বঙ্গবন্ধুর হাতে তাঁর প্রিয় পাইপ।

বত্রিশ নম্বর বাড়িটিতে কিছুক্ষণের জন্য নরকের দরজা খুলে গেল। একের পর এক রক্তভেজা মানুষ মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।

বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূ তাঁদের মাঝখানে রাসেলকে নিয়ে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ঘাতক বাহিনী দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট রাসেল দৌড়ে আশ্রয় নিল আলনার পেছনে। সেখান থেকে শিশু করুণ গলায় বলল, তোমরা আমাকে গুলি কোরো না।

শিশুটিকে তার লুকানো জায়গা থেকে ধরে এনে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হলো। এরপর শেখ জামাল ও শেখ কামালের মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে হওয়া দুই তরুণী বধূকে হত্যার পালা।

বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে শেখ মণির বাড়িও একই সঙ্গে আক্রান্ত হলো। সেখানেও রক্তগঙ্গা। শেখ মণি মারা গেলেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে। পিতামাতার মৃত্যুদৃশ্য শিশু তাপস দেখল খাটের নিচে বসে। এই শিশুটি তখন কী ভাবছিল? কেবিনেট মন্ত্রী সেরনিয়াবাত মারা গেলেন তাঁর দশ-পনেরো বছরের দুই কন্যা, এগারো বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সী এক নাতির সঙ্গে।

সকাল সাতটা।

বাংলাদেশ বেতার ঘন ঘন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছে। উল্লসিত গলায় একজন বলছে, ‘আমি ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে এক সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে। সারা দেশে মার্শাল ল জারি করা হলো।’


নিশ্চিন্ত প্রশাসন

১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) বৈঠককালে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন কাস্ট্রো।

এছাড়া নিতিন কে গুকলর বই ‘আর এন কাও: জেন্টলম্যান স্পাইমাস্টার’ পড়লে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। ১৯৮৯ সালে কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডের এপ্রিল ২৩-২৯ সংখ্যায় তিনি এক অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে লেখেন—“বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল অসন্তুষ্ট সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, এই তথ্য আমরা আগেই পাই। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে এও বলেছিলাম যে, খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কাছে খবরটা পৌঁছানো হয়েছে। যিনি এ খবর দিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়েই ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকায় যাই। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার শেষ বৈঠকের একপর্যায়ে তাঁকে বঙ্গভবনের বাগানে একান্তে কিছু সময় দেওয়ার অনুরোধ করি। সেখানেই তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রসঙ্গে আমাদের জানা তথ্য সম্পর্কে তাঁকে জানাই। তিনি হাত নেড়ে বলেন, ‘তারা আমার নিজের সন্তান, তারা আমার ক্ষতি করবে না।’ বঙ্গবন্ধু কাওয়ের কথায় গুরুত্ব দেননি। এরপর ৭৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি আনঅফিসিয়ালি ফোন করে দ্বিতীয়বারের মতো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেন।

১৯৭৩ সালের শেষ হতে ১৫ই আগস্টের আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে। তৎকালীন ডাকসুর সহ সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার একাধিক সাক্ষাৎকারে নিজের এবং সোভিয়েত দূতাবাসের এই সতর্কবাণী সম্পর্কে বলেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁকে হত্যার বিষয়টি একেবারেই আমলে নেননি। নিজের দলের নেতাদের উপর অতি বিশ্বাস তাঁকে দুর্নীতি আর অপরাধ দমনে বার বার কুন্ঠিত করেছে। ফলে আগস্টের প্রথম হতেই দেশে আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনমন ঘটে। এই বিষয়গুলির সাথে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ দমনে ব্যর্থতা যোগ হয়ে তাঁর জনপ্রিয়তাকে একবারে তলানিতে নামিয়ে নিয়ে আসে।

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি। অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ও চীন দু দেশই সাহায্য করা দূরের কথা, বরং তাদের মিত্রদেশগুলোকে সাহায্য না করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। যা গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ফিলিপ রড্রিকস ১৯৭৫ সালের ১৭ অক্টোবর সংখ্যায় লিখেছিলেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় চুক্তির ফলে দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে।

এতগুলো পরস্পর সম্পর্কিত নিরাপত্তা  হানিকর বিষয় প্রশাসনকে কোনো রকম উদ্যোগী  করতে  পারেনি।  পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের বঙ্গবন্ধুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে নিষ্ক্রিয় প্রশাসন নিশ্চিন্তে একটি সফল ষড়যন্ত্র মঞ্চায়নের ব্যবস্থার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।  এক্ষেত্রে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর জোটনিরপেক্ষ  আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে বলা কথাগুলিরই সত্য হিসেবে পরিগণিত হয়:

পাকিস্তানের এই সব আমলাদের নিয়ে স্বাধীন দেশের কোন কাজ হবে না। তারা পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে নাই। মনের মধ্যে হীনমন্নতা নিয়ে থাকা এই আমলারা ক্রমাগত বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এরা স্বাধীন দেশের সমস্ত কর্মসূচি ব্যর্থ করায় আত্মনিয়োগ করবে।

নেতার স্তুতি

৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর লন্ডন  হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিশ্বের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক ছিল। ১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা (যাতে প্রায় আড়াই লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়) কাটিয়ে না উঠতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দেশের অবকাঠামোসমূহের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া যুদ্ধের কারণে দেশটির কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবহন খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নতুন এই দেশের জনঘনত্ব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ ছিল এবং এর সিংহভাগ নাগরিকই ছিল নিরক্ষর, অপ্রশিক্ষিত ও বেকারত্বের শিকার। যুদ্ধের কারণে দেশের আবশ্যকীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছিল। নবপ্রতিষ্ঠিত দেশে কাজে লাগানোর মতো প্রাকৃতিক সম্পদও ছিল অপ্রতুল। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনও ছিল এক বিরাট সমস্যা। এর রকম একটি দেশটির পুনর্গঠন ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। এর জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কোনো রকম বাছবিচার না করে পাকিস্তানী আমলাতন্ত্রের এবং পুলিশ বাহিনীতে কার্যরত সমস্ত বাঙালিদের সবাইকে স্বপদে ফিরিয়ে এনে কার্যক্রম শুরু করেন।  কিন্তু দেশের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে গড়ে উঠা মুক্তিসেনাদের কাঠামোকে এক কথায় বাদ দেয়াটা ছিল অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। যেমনটি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন বাস্তবে তাই ঘটল।  স্বাধীন দেশের প্রতিটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং পদক্ষেপ বাঁধাগ্রস্ত হতে থাকল। সহজে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সবাই যেন প্রতিযোগিতা করে বঙ্গবন্ধুর স্তুতিতে মেতে উঠল। সংবর্ধনায় আর উপহারে নেতা ক্রমাগত বাস্তব থেকে সরে সীমিত চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লেন। উপমহাদেশের অন্যতম এবং অবিভক্ত বাংলার প্রগতিবাদী মুসলিম নেতা আবুল হাসিমের রাজনীতি বিষয়ক একটা চমৎকার কার্যকরী বক্তব্য আছে।  এটি তিনি পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক আইয়ুব খানের এক দশক পূর্তি উৎসবের ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের সামনে বলেছিলেন। কথাটি হল:

জিন্দাবাদ শব্দটি একজন রাজনীতিবিদকে ধ্বংস করে।  কারণ জিন্দাবাদে খুশি হলে তার কাছে স্বার্থবাদী চাটুকাররা আর কোন শব্দ আসতে দেয় না।  ফলে জনরোষের কোনো তথ্য না পেয়ে ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে একসময় ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়।"

আর এটাই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে।  তাইতো পুরো মুক্তিযুদ্ধ যার তত্ত্বাবধানে ঘটল, তাকে ক্ষমতার একেবারে বাইরে ছুড়ে ফেলা হল। আর চারপাশে ভিড় জমালেন স্বাধীনতা বিরোধী খন্দকার মোস্তাক গং।  দেশ নেতার স্তুতিতে আর সব কিছু ভুলে গেল।  ফলাফল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ; আর তারই হাত ধরে জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে যাওয়া।  এরকম একটা পরিস্থিতিতে সামরিক-বেসামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যা।

সক্রিয় ষড়যন্ত্রীরা

বিপ্লবীরা একটি স্বার্থক বিপ্লবের পর একটি প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেন।  একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি দেশের জন্ম নয়; বরং একটি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ পাওয়ার অদম্য আকাঙ্খা বাস্তবায়নের শুরু মাত্র।  এর প্রতিবন্ধক শুধুমাত্র পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী নয়- তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর চীনের নেতৃত্বে ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশ।  বিশ্ব রাজনীতিতে এই ঘটনার ভারত-পাকিস্তানের সমস্যার একটি ছোট অংশ যাতে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় জয় পেয়েছে। তাই সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের মিত্র ছিল হাতে গোনা - যার মধ্যে কোনো মুসলিম দেশ ছিল না।  আর মধ্যপ্রাচ্য ছিল সরাসরি বিরোধী। তাই আন্তর্জাতিক এই সমর্থন দেশের ভিতরে বহুবিধ ষড়যন্ত্রের পরিবেশ বস্তুতঃ তৈরী ছিল।  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খন্দকার মোস্তাক গংরা পাকিস্তানের সাথে একটি কনফেডারেশন গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিল। আওয়ামী লীগের গোড়া ইসলামপন্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের প্ররোচনায় যুদ্ধ বন্ধ করে মোস্তাক গংদের সাথে মিলে কাজ করছিল।

এর বাইরে ছিল পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকান্ড।  আজ স্বাধীনতার অর্ধ যুগ পার হলেও এটা নির্ধারিত হয়নি জিয়াউর রহমান, ফারুক-রশিদ-ডালিম-হুদা  এরা কি সত্যিই পাকিস্তানের কোনো সংস্থার পক্ষে কাজ করছিল কিনা। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়কার একটি চিঠি যা পাকিস্তানের সামরিক এক কর্মকর্তার প্রেরিত এবং যার প্রাপক জিয়াউর রহমান।  জিয়াউর রহমানকে উদ্দেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই সময়ের কর্নেল আসলাম বেগের মূল চিঠি:

Dacca

Major Zia Ur Rahman, Pak Army

We all happy with your job. We must say, good job. You will get new job soon.

Don’t worry about your family. Your wife and kids are fine.

You have to be more careful about Major Jalil.

Col. Baig Pak Army

May 29. 1971

বাংলায় যা দাঁড়ায়:

ঢাকা

মেজর জিয়াউর রহমান, পাক আর্মি

তোমার কাজে আমরা সবাই খুশি। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, তুমি ভালো কাজ করছ। খুব তাড়াতাড়ি তুমি নতুন কাজ পাবে।

তোমার পরিবার নিয়ে চিন্তা কোরো না। তোমার স্ত্রী ও সন্তানরা ভালো আছে।

মেজর জলিল সম্পর্কে তোমাকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।


কর্নেল বেগ, পাক আর্মি

মে ২৯, ১৯৭১

জিয়াউর রহমান, কর্নেল বেগ আর বেগের সেই চিঠি

মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম : মেজর ডালিম নামে বেশি পরিচিত।  মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তানে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) ছিলেন। ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারত আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।  তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এখানে একটা বিষয় উল্ল্যেখ না করলে ডালিমের পদক প্রাপ্তির ভ্রান্তি থেকে যাবে - বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রথম দিককার একটি সিদ্ধান্ত ছিল, 'শুধুমাত্র রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের পদক দেওয়া হবে।  কিন্তু পদক দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তরা এর ব্যত্যয় করে নিজেদের পদক প্রদান করেন।  ফলে এপ্রিল মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে (নাকি গোয়েন্দা সংস্থা হরে প্রেরিত হয়ে) মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ডালিম কেন্দ্রীয় সেনা কমান্ডের সাথেই থাকতেন। তাই একসময় নিজেরাই নিজেদের পদক গুলো প্রদান করেন।

লেফট্যানেন্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান: তৎকালীন মেজর  পদধারী  করে ফারুক একদল জুনিয়র অফিসারদের সংগঠন করেন যারা বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনে ক্ষুব্ধ ছিল। চক্রান্তকারীরা শেখ মুজিবকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, একনায়ক হিসেবে শাসন এবং তার ভারতপন্থী ও সোভিয়েতপন্থী শাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত করে সমালোচনা করে।সিনিয়র কেবিনেট মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের গোপন সমর্থনে ফারুক একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ও অবশেষে পরিচালনা করেন।যার ফলস্বরূপ, মুজিবের দুই কন্যা, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া মুজিব ও তার পরিবারের সকলে নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পরে তাৎক্ষণিকভাবে অফিসাররা খন্দকার মোশতাক আহমেদ কে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করে।

কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ: খন্দকার আবদুর রশিদ একজন সাবেক বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা এবং দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক গুপ্তঘাতক।  মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহন সময় অক্টোবর।  তাই তাকেও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা হরে প্রেরিত বলেই মনে হয়।

কর্নেল বজলুল  হুদা: মোহাম্মদ বজলুল হুদা একজন বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা।  মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহন সময় অক্টোবর।  তাই তাকেও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা হরে প্রেরিত বলেই মনে হয়।  হুদা অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বৈঠক করেছিলেন। হুদা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় আক্রমণকারী বিদ্রোহী সেনাদের একজন ছিলেন। শেখ মুজিব সিঁড়ি দিয়ে নিচের নামার সময় মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও হুদা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন।

মহানায়ক বধ

১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন। বাঙালি জাতি এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে এবং সাথে সাথে স্মরণ করে বিশাল হৃদয়ের সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তাঁর সাহস, শৌর্য, আদর্শের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালি জাতির অন্তরে।

 ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে। পরে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো সামরিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটে। হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের আদর্শিক পটপরিবর্তন বলে বিবেচিত। বর্তমানে ১৫ ই আগস্ট বাংলাদেশের ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।

শক্তিশালী তিনটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিবর্তনে সচেষ্ট ছিল:

১. সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ যাদের সাথে খন্দকার মোস্তাক গংরা জড়িত।

২. জাসদের সাধারণ সৈনিক সংস্থা যারা তাদের গণবাহিনীর সাথে মিলে ক্ষমতা দখলে সচেষ্ট।

৩. বিদেশী দেশগুলোর গুপ্তচররা যারা দেশীয় গ্রুপগুলো দিয়ে তাদের শত্রু বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিতে মরিয়া।  এদের মধ্যে পাকিস্তানের আইএসআই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ আর চীনের গোয়েন্দা সংস্থা গুওজিয়া আনকুয়ান বু (স্টেট  নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় )। এরসাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সুবিধাভোগীরা।

এদের ধারাবাহিক কর্মকান্ড শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহানায়ক বোধে সফল হয়।

অপ্রস্তুত দেশ

 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী অংশ খন্দকার মোস্তাকের নিয়ন্ত্রণে ছিল।  তারই ফলশ্রুতিতে পনেরোই আগস্টের রক্তাক্ত পট-পরিবর্তনের পর পর তাই নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা আর তাতে বেশির ভাগ নেতার অংশগ্রহন (জাতীয় চার নেতা - তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং কামরুজ্জামান সহ অতি ক্ষুদ্র অংশ যারা এতে দ্বিমত হয়েছেন তাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে ) বিষিয়টি এক অর্থে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবেও বর্ণনা করা যায়।

কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ নয়।  কারন এর মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল বিষয়কে পুরোপুরি উল্টে ফেলা হয়েছে।  একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক দেশ গঠনের সম্ভাবনা হতে সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধর্মাশ্রয়ী দেশের দিকে চলে যায়। ফলে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মধ্যে দেশের গতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। গণমানুষের প্রতি যে সাধারণ অঙ্গীকার হতে রাষ্ট্রের বিচ্যুতি ঘটে।  দেশটি ক্রমান্বয়ে একটি ব্যবসায়ী আর ধনিদের সম্পদ আহরণের সহযোগী সরকার ব্যবস্থাপনা প্রাপ্ত হয় যাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আরো একবার রাজনীতিবিদদের কর্তৃক প্রতারণার শিকার হল। 

পনেরোই আগস্টের ঘটনা বর্ণনায় দৈনিক সংবাদপত্র


ক্ষমতার মোহ

আজ প্রায় ৪৭ বৎসরের মাথায় এসে একটা কথা খুবই পরিষ্কার যে ক্ষমতার মোহ  এতটাই নির্মম যে মানুষের জীবনের মূল্য এখানে একেবারেই নেই। বিদেশী সংবাদ-সংস্থা আর সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে এই অভ্যুত্থানের নায়ক ফারুক-রশিদ-ডালিম গংরা বার বার একটি কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন যে বঙ্গবন্ধুর মতো এতবড় একজন নেতাকে প্রচলিত নিয়মে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলেন যে তার দ্বারা মুসলিম প্রধান এই দেশটিকে পরিচালনা অসম্ভব। খুনিচক্র তাদের ভাষায় ধর্ম আর স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাদের মিশন সম্পূর্ণ করেছে।

তাদের এই ব্যাখ্যা অগ্রহনযোগ্য হয়ে পরে সপরিবারে শিশু-মহিলা সহ হত্যার ঘটনায়।  এ যেন প্রাচীন বা মধ্যযুগের কোনো রাজ পরিবারকে সমূলে হত্যার মাধ্যমে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়া।  এর সাথে জাতীয় চার নেতার জেলখানায় হত্যা এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে যে ক্ষমতার নিরংকুশ করার সাথে কোনো বিরোধ অগ্রিম দমনই এর মূল লক্ষ্য ছিল। ক্ষমতার প্রতি এই মোহ আধুনিক পৃথিবীতে একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ; এমনটি প্রাচীন আর মধ্যযুগেও এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই।  

মাৎস্যন্যায়

রক্তাক্ত ক্ষমতার পালা বদলের  পরবর্তী তেপান্ন দিন অর্থাৎ সাতই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলতে থাকে।  জাসদের গণবাহিনীর সমর্থনে যে সৈনিক সংস্থা সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে (মূলত সৈনিক রাঙ্ক) কাজ করতো তাদের প্রতক্ষ্য সমর্থন নিয়ে জিয়া ক্ষমতা পুরোপুরি সংহত করে।  কিন্তু সামরিক বাহিনীর মধ্যকার এই সমস্যা শেষ হতে হতে আটাত্তর সাল অতিক্রান্ত হয়।

ফারুক-রশিদ-ডালিম-হুদা গংদের সাথে খন্দকার মোস্তাক যুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয় পনেরোই আগস্ট।  কিন্তু তার এই সুখ-স্বপ্ন ছয় নভেম্বর পর্যন্ত টিকে থাকে।  এর মধ্যে তেসরা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি সামরিক অভুথ্যান করে ক্ষমতা গ্রহণ করে  ফারুক-রশিদ-ডালিম-হুদা গংদের বিতাড়িত করেন দেশ থেকে। এই গ্রুপকে নানান দেশে কূটনৈতিক মিশনে চাকুরী দিয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গ্রুপটি দেশ ত্যাগের পূর্বে  তেসরা নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়। সাতই নভেম্বর জিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করে খালেদ মোশাররফের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।  বাংলাদেশের ইতিহাসে জিয়া সামরিক প্রশাসক হয়ে সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীতে তার সম্ভাব্য বিরোধীদের নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে দমন করেন।  এজন্য তাকে বেশ কয়েকটি মিথ্যা অভ্যুত্থান চেষ্টার গল্প রচনা করতে হয়। তিনি বিমান বাহিনীকে একবারে কানা করে দিয়ে নিজে পছন্দের লোককে প্রধান করেন যিনি তখন বাংলাদেশে তো ছিলেন না বরং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে পাসপোর্টধারী ছিলেন। জিয়া কর্নেল তাহেরকে ব্যবহার করে নিজের জীবন বাঁচান এবং ক্ষমতাকে সংহত করেন।  কিন্তু সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে পঙ্গু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীরকে ফাঁসির মাধ্যমে হত্যা করেন।

প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের এই মাৎস্যন্যায় সময়টি ১৯৮২ সালে আরেক সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় বসার আগে  পর্যন্ত চলতে থাকে। জিয়া এক অর্থে মাৎস্যন্যায় চালু করেন এবং তার মৃত্যুর মাধ্যমে এর সমাপ্তি হয়।

যোগ্যই টিকে থাকে

পনেরোই আগস্ট পরবর্তী এই টালমাটাল সময়টাতে প্রথমে ফারুক-রশিদ-ডালিম-হুদা গংদের প্রাধান্য বিস্তার করে।  খন্দকার মোস্তাক গংরা এদের তোয়াজ করে চলেছেন।  কিন্তু খালেদ মোশাররফ এর অবসান করেন। কিন্তু অত্যন্ত নরম মনের মানুষ খালেদ সময়মত কিছু দুষ্ট আর বিপজ্জনক ব্যক্তিকে হত্যা করতে না পারার ভুল নিজ জীবন দিয়ে শোধ করেন।

জিয়া ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। পাকিস্তানের সামরিক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এর চৌকষ অফিসার। তাই নবীন বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলার অবনতি আর বিভিন্ন গ্রুপের ক্ষমতার খেলায় তিনি শুরু থেকেই সবাইকে তাল দিয়ে চলেছেন।  ফলে অতি উগ্র সমাজতন্ত্রী জাসদ হতে ইসলাম পন্থী ডালিম সবার তিনি বিশ্বাসভাজন।  আর শেষ খেলাটায়  তাই যোগ্য হিসেবে তিনিই টিকে থাকলেন।

শেষ হাসি কার

বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় জিয়া বিজয়ী- কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে তাকে রক্তঋণ শোধ করতে হয়েছে।  তাই সঠিক বিচারে শেষ হাসিটা তার নয়।  বরং আরেকজন সামরিক শাসক এরশাদ এর দাবিদার।  এর প্রধানতম কারণ তিনি একটানা প্রায় নয় বৎসর শাসন করেন।  এমনকি শাসন ছেড়ে দেওয়ার পরও তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় কুড়ি বৎসর ক্ষমতার একটি বড় অংশ ছিলেন।

জাতি চায় মৃত বীর

মৃত বীরের কোনো চাহিদা নেই। নেই নিজস্ব কোনো মতামত।  ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইচ্ছা মতো তাদের ব্যবহার করতে পারে।  কিন্তু জীবিত বীর নিজের মত ব্যক্ত করে।  সমর্থন করে কোনো গ্রুপকে।  ফলে সে একটা জীবন্ত উপদ্রব হিসেবে আবির্ভুত হয়। তাই জাতি চায় মৃত বীর।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সাত বীর শ্রেষ্ঠকে নিয়ে জীবিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।  এমনকি বিরোধ নেই সমগ্র জনগণের মধ্যে।  কিন্তু জীবিত বীর নিয়ে প্রচুর মতবিরোধ।  যেমন - আমাদের যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী।  তিনি পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার পর ক্রমাগত হত্যাকারী আর সামরিক শাসকদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়েছেন।  ফলে তাঁর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ইমেজটি আর বজায় থাকেনি।  আরেকজনের নাম না বললেই নয় - বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী - যিনি যুদ্ধকালীন সময় বাঘা কাদের হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।  তাঁর বীরত্ব প্রবাদপ্রতিম।  কিন্তু এখন তাঁকে ব্যঙ্গ করে বীরউত্তম না বলে ব্রিজ উত্তম বলে ডাকা  হচ্ছে।  কারণ - কিছু ব্রিজের কাজ নিয়েও তিনি তা শেষ করেননি।

মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক

পনেরোই আগস্ট ঘটানোর কুশীলবরা এবং এর পরবর্তী শাসকরা একটানা বাইশ বৎসর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাজারো কুৎসা রচনা আর প্রচার করেছে।  এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির এই মহানায়ককে অপশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। তাঁর স্বজনপ্রীতি, সম্পদ লোভ, ক্ষমতার লোভ, উপহারের লোভ নিয়ে কত গল্প যে রচিত হয়েছে।  তাঁর ছেলেরাও রেহাই পায়নি - শেখ কামালের নামে ব্যাংক ডাকাতি আর অন্যের বউকে (মেজর ডালিমের বউ) জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কাল্পনিক কুৎসা রটানো হয়েছে।  ছোট ছেলে শেখ জামাল সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে সামরিক মহলে এই প্রচার ব্যাপক হয় যে, তার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এমনকি যিনি বাটা ভর্তি পান নিয়ে সারা জীবন একটি বড় পরিবারকে পালন করে এসেছেন নেপথ্য থেকে সেই বেগম মুজিবকেও ক্ষমতা আর স্বার্থলোভী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

মানুষ হয়ত কিছুটা সময় প্রচারণায় ভুলে থাকে।  তারপর নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে সত্যিটা ঠিকই বুঝে নেয়।  তাই জীবিতের চাইতে মৃত  বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো মৃত বঙ্গবন্ধু আবার বাঙালির কাছে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন।

জনতার শক্তিই শেষ কথা

১৯৭৫  সালের পনেরই আগস্ট ঘটে যাওয়া ইতিহাসের এই মর্মান্তিক ঘটনার মাত্র কয়েক মাসের ভিতর জনতার প্রতিবাদ শুরু হয়। আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলেন ও স্বাধীনতার উপর ধারাবাহিক গবেষণাধর্মী লেখক ড. মোহাম্মদ হান্নান এর ভাষায়:

২০ শে অক্টোবর ১৯৭৫ সালে ছাত্রদের উদ্যোগে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় হতে বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সিনেট প্রথম আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব প্রস্তাব পাশ করে। নভেম্বরের ৩ তারিখে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।  পূর্বে থেকে নেয়া প্রস্তুতি হিসেবে নভেম্বরের ৪ তারিখে রাজপথে প্রথম পনেরই আগস্ট এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়।  এতে খালেদ মোশাররফের মা অংশ নেন। এরপর  কুলখানি, কাঙালি ভোজ (প্রধানত খিচুড়ি), দোয়া আর প্রতিবাদ মিছিল ইত্যাদি নানা ভাবে প্রতিবাদ চলতে থাকে।  লেখা, প্রকাশনার আর প্রতিবাদী গানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রতিবাদী হয়ে উঠে।

এভাবে নানা প্রক্রিয়ায় বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব সত্ত্বেও দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করতে থাকে। পঁচাত্তর পরবর্তী সকল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জন আন্দোলন যেন বাঙালির মহান নেতার হত্যার প্রতিবাদ হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে জেনারেল জিয়া আর যিনারাল এরশাদ এই দুই সামরিক শাসক বেশি দিন তাদের শাসন পরিচালনা করতে পারেননি।  জিয়া একটি সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হন।  আর এরশাদের বিরুদ্ধে জনতা ১৯৯০ এর ৬ ই ডিসেম্বরে বিজয় হন।

খুনের ইতিহাসের পুনঃ মঞ্চায়ন প্রচেষ্টা

রাজনৈতিক সগ্রামের ধারায় ১৯৯৬ সালের জুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২২ বৎসর পর আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে  ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।  এরপর ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট এর ট্রাজেডি:

২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা, যে হামলায় ২৪ জন নিহত হয় এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।

এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় হতে শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা।  যেন আরেকটি পনেরোই আগস্ট, তবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। আহত হলেও শেখ হাসিনা বেঁচে যান। তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন (বিশেষত যুবরাজ খ্যাত তারেক রহমান )  বিশ্বাস করতেন, শেখ হাসিনা  ছাড়া তাদের শাসন  নিশ্চিন্ত হবে।

দেশের নতুন কান্ডারী

স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বৎসর সময় পেয়েছিলেন যুদ্ধ বিধস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার জন্য। কার্যকরী বিশ্ব সমর্থনহীন সরকার পরিচলানা করতে গিয়ে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত তাকে একটি মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে বাধ্য করে।  নিজ দল আর দেশের লোভী মানুষগুলোর জন্য এতে তিনি ব্যর্থ হন।  আর তাঁর সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় নিজ আর পরিবারের রক্ত দিয়ে শোধ করতে হয়। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী দেশটি গড়ে তোলার কোনো সঠিক উদ্যোগ এর পরবর্তী কোনো সরকার প্রধান নেননি।  তাদের সময় গিয়েছে শুধু নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে আর কিছু লোভী মানুষের সম্পদ অর্জনের জন্য।  বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ'হাসিনা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত দেশ কোন ভিশনারি নেতৃত্ব পায়নি। প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও জন বিরোধী আমলাতন্ত্র আর বিদেশী শক্তির প্রভাবে ২০০১ সালের নতুন সরকার তার সবকুটুই বাতিল'করে দেয়।  এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু  হলেও তা থমকে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা সেই দূরদৃষ্টি অর্জন করেন যাতে সবধরণের প্রতিকূলতা বিশেষত আমলাতন্ত্রের (সামরিক ও বেসামরিক) আর লোভী মানুষদের ষড়যন্ত্র যাদের সাথে নিজ স্বার্থ থাকার কারণে বিদেশী শক্তি হাত মেলায় - তাকে মোকাবেলা করার।  ফলে আজ সাড়ে তের বৎসর একটানা ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে একটি অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।  তিনি বাঙালি জাতির নতুন একটি আত্মপরিচয় নির্মাণ করে দিয়েছেন।  আজ স্বাধীনতা উত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের "তলাহীন ঝুড়ি" হতে সম্ভাবনার দেশ। আর এর মাধ্যমে তিনি বিশ্বে একজন প্রভাবশালী নেতার স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।

পিতার ঋণ শোধ

১৯৯৬ সালে জুনের নির্বাচনে জন রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কুখ্যাত ইনডেমটিনি বাতিল করে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের হত্যার বিচার শুরু করেন। এটি একটি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া। বহু ঘটনা প্রবাহের পর ২০০১ এর ক্ষমতায় বিএনপি আসার আগ পর্যন্ত এটি ভালোভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তন এই প্রক্রিয়াকে পুরো বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় পুনরায় আসার পর বিচারটি সম্পন্ন হতে পারে।  সারাবাংলা (https://sarabangla.net/ য় রা'আদ রহমান তার "বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার: ৩৫ বছরের অপেক্ষার অবসান"   নিবন্ধে লেখেন:

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বাঙালি জাতির কলঙ্কমুক্তির দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী ৫ খুনি ফাঁসিতে ঝুলেছিল এদিন। পিতার বুকে ব্রাশফায়ার করবার দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অবশেষে আত্মস্বীকৃত খুনি নরপিশাচদের বিচার সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম আমরা। একটা দেশের স্থপতি, জাতির জনক, স্বাধীনতা ও মুক্তির মহানায়ক, যে তার পুরো জীবনটাই স্বজাতিকে ভালোবেসে উৎসর্গ করে গেছে জেলে আর রাজপথে, তাকে পুরো পরিবারসহ ব্রাশফায়ারে মেরে ফেলার মত পৈশাচিক অচিন্তনীয় অপরাধের জন্য আসলে কোন শাস্তিই যথেষ্ট না, শতবার ফাঁসিতে ঝোলালেও খুনিদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত হয় না, তবুও ফাঁসিতে ঝোলাবার মত এইটুকু শাস্তি নিশ্চিত করতেও তো যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেল। খুনিদের আস্ফালন আর তাদের পুরষ্কৃত করা পৃষ্ঠপোষকদের ক্ষমতার দাপটে একসময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার এই দেশে হবে সেটাই অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সেই বিচারের রায় পাওয়া এবং সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার পুরো ঘটনাটাই এতটা অনিশ্চয়তায় মোড়ানো ছিল যে সেটা ঘটে যাওয়ার আজ ১১ বছর হলো তা ভাবতেও অবিশ্বাস্য লাগে।

বিজ্ঞজনেরা একমত যে শেখ হাসিনার মতো এমন একজন একরোখা সরকার প্রধান ছাড়া এই বিচার একটি অসম্ভব বিষয়ে ছিল।  অনেকের মতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে, হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে, কারো কারো শাস্তি হয়েছে।  কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিচার হয়নি।  এটাকে সত্য ধরে নিয়েও বলা যায় শেখ হাসিনা যেমন নিজ পিতৃঋণের সাথে জাতিকেও ঋণমুক্ত করেছেন, করেছেন কলংকমুক্ত।  আমাদের মতো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের পক্ষে এর বেশি আর কি করা সম্ভব।

 

অন্য আলোয় দেখা

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ দেশে একক নেতা হিসেবে বিবেচিত; বিদেশেও প্রসংশিত।  তাঁর নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। মানুষের আয় আর জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। শিশু মৃত্যু কমানো, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষাসহ  বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।  যে পাকিস্তান একাত্তরে পরাজিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানতে বাধ্য হয়েছিল - কিন্তু বড়ো জনসংখ্যকে দায় হিসেবে দেখিয়ে পূর্বাংশ না থাকায় কি কি সুবিধা তাই নিয়ে গত শতকের নব্বইর দশক পর্যন্ত নানা আলোচনায় ব্যস্ত থাকত তাচ্ছিল্য নিয়ে - তারাই এখন বাংলাদেশকে তাদের উন্নয়নের মডেল হিসেবে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশটি বিশ্বের অন্যতম ডিজিটাল রূপান্তরের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। মোবাইল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার যা মোবাইল ব্যাঙ্কিং (বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) দ্রুত কার্যকরী করতে সহায়ক হয়েছে।

কিন্তু এই ব্যাপক উন্নয়ন আমাদের কয়েকটি জায়গায় পিছিয়ে দিচ্ছে:

১. জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি একটি স্থায়ী অস্থিতিশীল পর্যায়ে চলে গেছে।  গত দুই বৎসরের বিশ্বব্যপি করোনা অতিমারীতে জনগনের একটি বড় অংশ কাজ না থাকায় অক্ষমতায় চলে গেছে।

২. এই বৎসর ২৪ ফেব্রুয়ারী হতে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্ব ব্যাপী যে বহুবিধ সংকটের সূত্রপাত করেছে তার প্রাথমিক পর্যায়ে এরই মধ্যে জ্বালানি সংকটে দেশটি পড়ে গেছে।

৩. বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের চক্রে আমাদের পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

৪. বিশ্ব স্বীকৃত ব্যাপক দুর্নীতি আর অর্থ পাচার দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে।  এখনই দেশে মার্কিন ডলারের ব্যাপক সংকট তৈরী হয়েছে। 

৫. আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।  অনেকে শ্রীলংকার অবস্থা হওয়ার আশংকা করছেন।

আলোচনার শেষে আপাত সম্পর্কহীন এই বিষয়টির অবতারণা এই জন্য যে, ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাটির আগের বৎসর দেশ একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিল।  বিশ্ব পরিস্থিতি সঠিক বিচার করতে না পারলে শ্রীলংকার মতো অর্থনৈতিক দেউলিয়া হয়ে গত এক যুগের বেশি বর্তমান প্রধানমত্রীর নেতৃত্বের বাংলাদেশের সমস্ত অর্জন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

এই আস্থা রেখে লেখাটি শেষ করতে চাই যে, বাঙালি কোনো অবস্থাতেই নিজ সম্মান হারাবে না।  যে জাতি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে মাত্র নয় মাসের মধ্যে সংগঠিত হয়ে একটি প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, যে জাতি সঠিক নেতৃত্ব পেলে মাত্র এক যুগের মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক নতুন মডেল সংযোজন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে, যে জাতি দেশি-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করে নিজেকে কলংকমুক্ত করতে পারে - তার অগ্রযাত্রা কখনো থামবে না।

 

লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।
ইমেইল: [email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ