রুয়েটের ঐশী জ্যোতির ব্যাখ্যা কী!
মোশাররফ হোসেন মুসা
১৩ আগস্ট ২০২২, ১২:৩৭ | অনলাইন সংস্করণ
রুয়েট (RUET)- এর লোগোতে লেখা আছে- ‘ঐশী জ্যোতিই আমাদের পথ প্রদর্শক’ (Hevens light is our guide)। ‘ঐশী জ্যোতি’ শব্দটি মূলত ঐশী বাণী সমৃদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে এসেছে। সে কারণে এ শব্দটি সেমিটিক ধর্ম বিশ্বাসীদের মুখে বেশি শোনা যায়। ‘রুয়েট’ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তথা পদার্থের নিত্য-নতুন আবিষ্কার নিয়ে এটির নিরন্তর কায়-কারবার। সেজন্য বিজ্ঞানের জ্যোতিই পথ প্রদর্শক হওয়ার কথা। সেটি না হয়ে কেন যে ঐশী জ্যোতিই পথ প্রদর্শক হলো সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। রুয়েট (রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি) পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল।
শোনা যায়, কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালে (১৯৬৪ সালে) তাবলীগ জামায়াতের অনুসারী জনৈক পরিচালক তার ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বাক্যটি সংযোজন করেন। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নীত হওয়ার পরও একই মানসিকতার শিক্ষকরা বাক্যটি যতœ করে রেখে দেন। তবে বাক্যটি ছোট হরফে উৎকীর্ণ থাকায় খুব কম লোকেরই চোখে পড়ে। আবার অনেকের চোখে পড়লেও ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার ভয়ে নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেন। তবে রুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাক্যটি সস্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছেন। কিন্তু এর মর্মার্থ নিয়ে ভাবার লোক সেখানে খুব কমই আছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির জনৈক শিক্ষক আমাকে বলেছেন- ‘আদর্শহীনতার যুগে এরকম ধর্মীয় আলোর কথা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই মঙ্গলজনক’ (তাকে পূর্বের কোন সময়টি আদর্শের যুগ ছিল প্রশ্ন করলে তার বিশ্বাসের কথা উগরাতে থাকেন)। রুয়েটের পাশেই রয়েছে উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী রুয়েটের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। তারা অনেকেই রুয়েটের জ্যোতি বিষয়ক তত্ত্বটি পড়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউ এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন- এরকম কথা জানা যায়নি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত ‘অর্থনীতি শাস্ত্রের বিকাশ ও নব্য উদারাবাদী মতবাদ: দর্শনের দারিদ্র, শীর্ষক এক বক্তব্যে বলেন- ‘আমরা দায়সারা বিষয়ের মধ্যে যতদিন থাকব, ততদিন দর্শন শাস্ত্রের উন্নয়ন হবেনা। যিনি বিজ্ঞানের যুক্তি বিশ্বাস করেন না, তিনি আর যা-ই হোন, দার্শনিক হতে পারবেন না। ... ...আপনারা করপোরেট দার্শনিক ও বেচাকেনার দার্শনিক হবেন না। আপনাদের হতে হবে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী দার্শনিক’(প্রথম আলো, ২৭ সেপ্টেম্বর’১৪)।
আবার গত ১৮ নভেম্বর রুয়েটের ৪র্থ সমাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ রা.বি.’র শিক্ষক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান এবং অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের আহবান জানান। তিনি বলেন- ‘বর্তমান বিশ্ব তথ্য প্রযুক্তির। এ বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ প্রকৌশলী তৈরির কোনো বিকল্প নেই।’ সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক জামিলুর রেজা বলেন-‘ সাম্প্রতিক বিশ্বে পারস্পরিক নির্ভরতা ও প্রযুক্তি আমদানি-রপ্তানি জরুরি একটি বিষয়। কিন্তু এখনও আমরা প্রযুক্তি আমদানিতে উন্নত বিশ্বের উপর নির্ভরশীল।’ উপরিউক্ত দুটি অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাড়াও রাজশাহী নগরের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউ-ই রুয়েটের ঐশী জ্যেতির বিপক্ষে কোন মতামত দেননি ।
পূর্বেই বলা হয়েছে-সেমিটিক তিনটি ধর্ম ইহুদি, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীরা মনে করেন তাদের ধর্ম গ্রন্থগুলো ঐশী বাণী প্রধান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ওভাবে ঐশী বাণীর দাবী না করলেও তারা সৎ কর্মের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, তাদের দেবতা ও অবতাররা ঐশী জ্ঞান ও ক্ষমতা প্রাপ্ত। তাদের আলোয় আলোকিত হয়ে সাধারণ অনুসারীরাও দেবতায় পরিণত হতে পারেন। ভাববাদীরা সাধারণত আধ্যাত্মিক মানসিকতা থেকে জগতকে ব্যাখ্যা করতে বেশি পছন্দ করেন। তারা আত্মাকে অধিক প্রাধান্য দেন। তারা মনে করেন, মানুষ ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আলোকিত আত্মার মাধ্যমে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করা সম্ভব। অর্থ্যাৎ ঐশী জ্যোতির ব্যাখ্যা একেক ধর্মের কাছে এক এক রকম হলেও মূলে রয়েছে বিশ্বাস। কিন্তু বিজ্ঞান শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল থাকে না, নতুন নতুন আবিস্কারের মাধ্যমে বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দেয়। রুয়েট কোনো আধ্যাত্মিকতা, মহানুভবতা কিংবা সার্বজনীন মানবতাবাদের উদ্দেশ্যে ওই বাণী প্রচার করছে না, এর পিছনে রয়েছে সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত বুদ্ধিচর্চার পীঠস্থান। সেখানে সন্দেহ করা, প্রশ্ন করা এবং অস্বীকার করার সুযোগ থাকায় প্রগতিমুখী জ্ঞানসৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এদেশে সেই সুযোগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ধর্মান্ধ ও কূপমুণ্ডুকদের আশ্রয় স্থলে পরিণত হয়েছে। সেখানে কেউ যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তার চর্চা করলে তার প্রাণ হারানোর ভয় থাকে। একই কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন উন্নত বিশ্ব থেকে প্রযুক্তি আমদানি করতে হচ্ছে। বিধায়, রুয়েটের উচিত হবে উপরিউক্ত স্লোগান পরিবর্তন করে ‘বিজ্ঞানের জ্যোতিই আমাদের পথ প্রদর্শক’ কথাটি সংযুক্ত করা।
লেখক- গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক
এই বিভাগের আরো সংবাদ