আজকের শিরোনাম :

ওডেসা হামলা রাশিয়ার আসল রূপ দেখাল

  নিক রবার্টসন

২৬ জুলাই ২০২২, ১১:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

শুক্রবার ইস্তাম্বুলে রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে বেশ চাপমুক্ত মনে হয়েছিল। কারণ তাঁর দূতিয়ালিতেই চুক্তিটি হয়েছে। কিন্তু চুক্তিটি স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে রাশিয়ার হামলা গুতেরেসের সেই স্বস্তিকে এক ধরনের শঙ্কায় পরিণত করেছে বলে মনে হচ্ছে। চুক্তিতে কোনো যুদ্ধবিরতির কথা বলা না হলেও স্পষ্ট করে লেখা আছে, 'রুশ ফেডারেশন খাদ্য, সূর্যমুখী তেল ও সারের বাধাহীন রপ্তানি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।' কিন্তু চুক্তিটিকে বিশ্বের ভুখা মানুষের জন্য 'আশার আলো' হিসেবে বর্ণনা করার রেশ না কাটতেই রাশিয়া চুক্তিতে রপ্তানির জন্য নির্ধারিত প্রধান বন্দর ওডেসায় কৃষ্ণসাগর থেকে দুটি ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করে। চুক্তিতে বলা আছে, জাহাজগুলো ইউক্রেনীয় পাইলটদের পরিচালনায় কৃষ্ণসাগরের এ নিরাপদ করিডোরগুলো দিয়ে বসফরাস প্রণালিতে যাবে।

যদিও রাশিয়া দাবি করেছে, ওডেসায় তারা ইউক্রেনের যুদ্ধজাহাজ ও অস্ত্রাগার ধ্বংসের লক্ষ্যে ওই মিসাইল ছুড়েছে। ইউক্রেন সরকারের বক্তব্য হলো, এ ঘটনা রাশিয়ার দ্বিচারিতাকেই তুলে ধরেছে। চুক্তিটির আরেক মধ্যস্থতাকারী তুরস্ক যদিও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি; এ কথা বলাটা বাহুল্য হবে না যে, এ হামলার মধ্য দিয়ে রাশিয়া তুরস্কের সরল বিশ্বাসেও আঘাত করল। এখানে বলে রাখা দরকার, রাশিয়া বরাবরের মতোই প্রথমে ওই হামলা চালানোর কথা অস্বীকার করে। এ কথা বলার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর দেশটির বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানান যে, হ্যাঁ, ওই হামলা তাঁরাই চালিয়েছেন।

রাশিয়া চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক এ হামলা এমন এক সময়ে করল, যখন তুরস্ক চুক্তির ধারা মেনে তার বাস্তবায়ন তদারকির জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা নিয়ে একটা যৌথ কমান্ড সেন্টার বা জেসিসি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। চুক্তি অনুসারে, এ জেসিসির প্রধান দপ্তর হবে আঙ্কারায় এবং এ কমিটিতে থাকবেন রাশিয়া, ইউক্রেন ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা। জেসিসির কাজ হবে উল্লিখিত করিডোর দিয়ে খাদ্যবাহী জাহাজগুলোর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও চুক্তিতে তুরস্ককে বন্দরগুলোতে শস্যবাহী জাহাজে নজরদারি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেন সেগুলোতে কোনো ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করা না হয়।

ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যঝুড়ি হিসেবে পরিচিত। এখান থেকে বছরে বিশ্ববাজারের অন্তত ১০ শতাংশ গম রপ্তানি হয়। আর রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলে এ শেয়ার ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন গোটা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে রুশ আক্রমণের পর থেকে ধাঁই ধাঁই করে গমের দাম বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় ভারতের মতো গম রপ্তানিকারক দেশগুলোও ভবিষ্যতে দেশের ভেতরে গম সংকট দেখা দিতে পারে- এ শঙ্কা থেকে গম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে বিপদে পড়ে যায় বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার গম আমদানিকারক দেশগুলো। আফ্রিকার কোনো কোনো দেশ তো এখনই দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। দুঃখজনক হলো, এ পরিস্থিতির জন্য রাশিয়া দায়ী হলেও শুক্রবারের চুক্তিতে এ দেশটিরই বেশি সুবিধা হলো। কারণ ইউক্রেনের গম বাইরে আসতে দেওয়ার বিনিময়ে রাশিয়া জাতিসংঘের মাধ্যমে তার নিজের খাদ্য ও সার ব্যবসার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া অবরোধ তোলার একটা সুযোগ পাচ্ছে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটা চুক্তি রাশিয়া ও জাতিসংঘের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এ চুক্তির বদৌলতে রাশিয়া নিঃসন্দেহে তার রাজকোষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার সুযোগ পাবে। এর বিনিময়ে পুতিন অল্পস্বল্প ছাড় দিতে নিশ্চয় কার্পণ্য করবেন না। তবে এর মাধ্যমে পুতিন প্রমাণ করে দিলেন- তাঁর প্রতিরক্ষা কৌশলে অনেক ফাঁকফোকর আছে, যেগুলো সত্যিকার অর্থেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। পুতিনের এ অবস্থাকে টোলকিয়েনের বিখ্যাত বই দ্য হব্বিটে বর্ণিত স্মগ নামক ড্রাগনের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে না। স্মগ ছিল লাল এক ড্রাগন, যার কাজ ছিল অবৈধভাবে ধনসম্পদ অর্জন করা এবং তাকে যক্ষের ধনের মতো পাহারা দেওয়া। কিন্তু তার একটা দুর্বলতা ছিল; তার হিসাবে গরমিল হয়ে যেত। মনে হচ্ছে, পুতিনেরও দুর্বলতা হলো, তিনি আন্তর্জাতিক অবরোধের ধাক্কা সামাল দিতে পারেন না। অন্তত অর্থনীতিতে ওই অবরোধ যে ধাক্কা দিয়েছে, তাতে তিনি কিছুটা হলেও কাবু হয়ে গেছেন। শস্য রপ্তানির চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার পেছনে তাঁর আর যে কারণই থাকুক, যুদ্ধ বাজেট ঠিক রাখার জন্য পুতিনের অনেক টাকা দরকার।

যাই হোক, ইউক্রেনকে যে কোনো মূল্যে তার শস্য রপ্তানি করতে হবে। তাই দেশটি ওই রুশ হামলার তোয়াক্কা না করেই গম রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। গুতেরেসেরও আশাবাদী হওয়ার অধিকার আছে। তবে তাঁকে এ আশাবাদ জিইয়ে রাখতে হলে রাশিয়াকে তার খেয়ালখুশিমতো ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ আরও তীব্র করা থেকে বিরত রাখতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকারিতাও তার এ সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। শুক্রবার চুক্তি স্বাক্ষরের সময় আশাবাদের পাশাপাশি তাঁর চোখে যে শঙ্কা দেখা গেছে, তা দূর করতে পারে এমন কিছুর দেখা তিনি এখনও পাননি। বিশেষ করে রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভ দাবি করলেন যে, রুশ জাহাজ শস্যবাহী জাহাজগুলোকে নিরাপদে পার হতে সহায়তা করবে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তাঁর এ বিবৃতিটির লক্ষ্য ওই মিসাইল হামলার মতোই ইউক্রেনকে উস্কানি দেওয়া।

 

লেখক : সিএনএনের কূটনীতিবিষয়ক সম্পাদক; 

সিএনএন থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন।  সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল।

এই বিভাগের আরো সংবাদ