আজকের শিরোনাম :

অপ্রতিরোদ্ধ চীনই কি হবে আগামীর বিশ্বমোড়ল

  আলাউদ্দিন মল্লিক

২৬ জুন ২০২২, ১৭:১৩ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
প্রাচীন চৈনিক এবং  রোমান সভ্যতা 
বিশ্ব ইতিহাসের পণ্ডিতরা প্রায়শঃই হান রাজবংশের চীন এবং রোমান সাম্রাজ্যকে একটি তুলনামূলকভাবে আলোচনায় নিয়ে আসেন। এর কারণ স্পষ্ট: এই দুই সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা বতমানে একটি নতুন যুদ্ধের সম্মুখীন।  হান চীন (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে  তৃতীয় শতাব্দী) এবং ইম্পেরিয়াল রোম (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী) উভয়ই শক্তিশালী, কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত শাসনব্যবস্থা ছিল যা ভৌগলিকভাবে বিস্তৃত হয়েছিল, জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের আত্তীকরণকে উন্নীত করেছিল এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল। তারা নিজ নিজ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছিল। তারা জনগণকে এবং অঞ্চলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, রাস্তা তৈরি করেছিল, প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর এবং জলের কাজ করেছিল এবং তাদের সীমান্তে "বর্বর" দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল এমনকি তারা সামরিক সহায়ক হিসাবে এই ধরনের লোকদের নিয়োগ করেছিল। অবশেষে, এই প্রাচীন শাসনব্যবস্থাগুলির প্রত্যেকটি ধর্মকে রাষ্ট্রের স্বার্থের অধীনস্থ করে এবং একটি জনপ্রিয় বিদেশী বিশ্বাসের (চীনে ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম, রোমে সেমেটিক/ ফিলিস্তিন অঞ্চলের   খ্রিস্টধর্ম) প্রবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করে। এই দুটি প্রারম্ভিক সাম্রাজ্যিক সংস্কৃতি অধ্যয়ন করার জন্য এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে তারা উভয়ই কিভাবে ব্যাপকভাবে বিভক্ত ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে  একই ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করেছে ।

সাদৃশ্যসমূহ 
বর্বরদের সাথে সম্পর্ক: উভয় সাম্রাজ্যই মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠীর মুখোমুখি হয়েছিল যারা তাদের সীমানায় হুমকি ও অনুপ্রবেশ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, হুনরা, যারা ইউরোপ আক্রমণ করেছিল এবং চীনে আক্রমণকারী জিয়ংনু একই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উভয় সাম্রাজ্যই তাদের সীমানার কাছে "বর্বরিয়ানদের" বসতি স্থাপন করেছিল এবং তাদের সাম্রাজ্যের তালিকাভুক্ত করেছিল সেনাবাহিনী উভয় ক্ষেত্রেই, বারবারিয়ানরা মহান ক্ষমতা ধরে রাখতে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত, যাইহোক, তারা চীনাদের দ্বারা শোষিত হওয়ার সময় রোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে দেয়।

ধর্মীয় নীতি: উভয় সাম্রাজ্যই বিদেশী ধর্মকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, বিশেষ করে সাম্রাজ্যিক বিশৃঙ্খলার সময়ে, কিন্তু রোমে, খ্রিস্টধর্ম সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে পারেনি এবং পার্থিব শক্তির তাত্পর্যকে চ্যালেঞ্জ করে এটি সাম্রাজ্যের দুর্বলতায় অবদান রাখতে পারে। চীনে, বৌদ্ধধর্ম কনফুসিয়ানিজম এবং দাওবাদে লীন হয়েছিল এবং রাজনৈতিক সমস্যার সময়ে জাতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল।

গণপূর্ত প্রকল্প: তাদের সাম্রাজ্য জুড়ে রোমানরা রাস্তা, জলাশয়, পাবলিক স্মারক কাঠামো, প্রশাসনিক/সামরিক শহর এবং রোম এবং কনস্টান্টিনোপলের মহান রাজধানী শহরগুলি তৈরি করেছিল। চীনারা গ্রেট ওয়াল, গ্র্যান্ড ক্যানেল, রাস্তা ও জলের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থা, পাবলিক স্মারক কাঠামো, সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে প্রশাসনিক/সামরিক শহর এবং বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক রাজধানী, বিশেষ করে চ্যাং'আন এবং লুয়াং নির্মাণ করেছিল।

পার্থক্যসমূহ 
ভূ-রাজনৈতিক: চীনের কেন্দ্রভূমি রোমের চেয়ে অনেক বড় এবং আরও সুসংহত, ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে ছিল। রোমের কেন্দ্রস্থল হিসাবে শুধুমাত্র মধ্য ইতালি ছিল, এবং এমনকি ইতালি জয় করার পরেও, এটি আল্পস পর্বতমালা এবং ভূমধ্যসাগর দ্বারা বেষ্টিত সেই একক উপদ্বীপটিকে ধরে রেখেছিল। রোমে অগাস্টাস এবং চীনে হান রাজবংশের সময়ে, রোমান এবং চীনা সাম্রাজ্যের প্রত্যেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন লোক ছিল, কিন্তু রোমে এই মিলিয়নের মধ্যে মাত্র কয়েক মিলিয়ন  ইতালিতে ছিল। চীনে কার্যত সবাই "অভ্যন্তরীণ চীনে" ছিল, তাদের ৯০ শতাংশ উত্তর চীন সমভূমিতে।

স্থায়িত্ব : রোমের সাম্রাজ্য উঠেছিল, পতন হয়েছিল এবং চলে গিয়েছিল, যদিও এটি একটি ধারণা হিসাবে বেঁচে ছিল। চীনের সাম্রাজ্য গত দুই হাজার বছর ধরে টিকে আছে। রাজবংশ এসেছে এবং চলে গেছে, এবং কখনও কখনও সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য একটি একক রাজনৈতিক সত্ত্বা হিসাবে টিকে আছে। আজ, যদিও সম্রাট ছাড়া, চীনের ভূ-রাজনৈতিক ঐক্য অব্যাহত রয়েছে।

ভাষা নীতি: চীনারা কখনই অন্য ভাষা এবং সংস্কৃতির অধীনস্থ ছিল না, যেমন ল্যাটিন বহু বছর ধরে এবং অনেক অঞ্চলে গ্রীক ছিল। এমনকি লাতিনের মতো আঞ্চলিক ভাষার সাথে চীনারাও প্রতিযোগিতা করেনি। প্রকৃতপক্ষে চীনারা এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলি, ভিয়েতনাম, কোরিয়া এবং জাপানকে একক সাধারণ সাংস্কৃতিক ইউনিটে একত্রিত করতে সাহায্য করেছিল। ল্যাটিন প্রতিস্থাপিত হয়েছিল উত্তরসূরী রোমান্স ভাষা: ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, কাতালান এবং রোমানিয়ান। 

রোমান সভ্যতার অবদান 
রোমান সাম্রাজ্য প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। এত বছর পরও পৃথিবী তাদের দেওয়া অনেক অবদান ভুলতে পারেনি। আধুনিক অনেক প্রযুক্তিই প্রাচীন রোম থেকে পাওয়া। কৃষি থেকে শুরু করে বিনোদন সব জায়গাতেই রোমানদের ঐতিহ্য, জ্ঞান আর ডিজাইন ব্যবহার করা হচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। 

রোমান প্রজাতন্ত্র: রোম একটি বিশাল সাম্রাজ্য হওয়ার আগে, এটি প্রধানত ইতালীয় পেনিনসুলায় একটি উদীয়মান প্রজাতন্ত্র হিসেবে ছিল, যেখানে দুজন নির্বাচিত নেতা ছিলেন, যাদের একজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং অপরজন নির্বাচিত সিনেট প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। সেই যুগকে বলা হয় রোমের রিপাবলিকান অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের যুগ। বেশ কিছু সময় রাজাদের শাসন থাকার পরও এই পদ্ধতি চালু ছিল। 

কংক্রিট: দীর্ঘ সময় টিকে থাকার জন্য রোমানরা খুব ভালো মানের কংক্রিট বানাতে পারত। 

সড়ক ও জনপথ: রোমানরা তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত অসংখ্য পাকা রাস্তা  তৈরী করে। ৭০০ বছর ধরে, পুরো ইউরোপে ৫৫ হাজার মাইল রাস্তা তারা পাকা করে ফেলে। 

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার: প্রাচীন রোমে সবচেয়ে কার্যকর ক্যালেন্ডারের কথা যদি বলতে হয়, তবে সেটি হচ্ছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। মাস, দিন, অধিবর্ষসহ যেসব গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়, তার সবই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে অনুপ্রাণিত। 
পাইপ: প্রাচীন রোমানরাই সর্বপ্রথম এক্যুইডাক্ট বা কৃত্রিম জলপ্রবাহ তৈরি করতে যুগান্তকারী পাইপ সরবরাহ পদ্ধতির আবিষ্কার করে। পাইপের মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে নগরে নিয়ে যেত। 

কুরিয়ার সার্ভিস: রোমান সাম্রাজ্যর সর্বপ্রথম রোমান সম্রাট অগাস্তাস কুরিয়ার পদ্ধতি চালু করেন। এর মাধ্যমে নানা ধরনের বার্তা এবং ট্যাক্সজাতীয় তথ্যাদি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আদান-প্রদান করা হতো। 

আইনি পদ্ধতি: রোমান আইন জীবনের সবদিককে প্রাচীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। নাগরিকত্ব, অপরাধ, শাস্তি, দায়বদ্ধতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তি থেকে পতিতাবৃত্তি, কল্পনা এবং স্থানীয় রাজনীতি পর্যন্ত রোমানরা আইনি ব্যবস্থায় সর্বোত্তম অনুশীলন গঠনে সহায়তা করেছিল। যেকোনো অবস্থায় রোমানরা যেন সঠিক এবং সম-আইনি বিচার পায় তার জন্য তারা সব সময় সচেষ্ট থাকত।

পত্রিকা: পত্রিকার কথা জানতে হলে অনেক পেছনে ফিরতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে, শুধু সিনেটরদের সব মিটিংয়ের রেকর্ড রাখার জন্য রোমানরা এটি শুরু করে। পরে, খ্রিস্টপূর্ব ২৭-এর পর, ‘অ্যাক্টা ডিউরনা’ নামে প্রতিদিনের একটি গ্যাজেট প্রথম পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়।

কলোসিয়াম: কলোসিয়ামকে বলা হতো ফ্লাভিয়ান অ্যাম্পিথিয়েটার। রোমানদের স্থাপত্যের নজির আর বিনোদনের অন্যতম প্রতীক ছিল এই কলোসিয়াম।

রোমান সংখ্যা: সাধারণত জিনিসপত্রের সঠিক মূল্যমান নির্ধারণের জন্য রোমান সংখ্যা ব্যবহার করত রোমানরা। রোমানদের সময়ে, এটি প্রায় সবাই ব্যবহার করত। 

নালা-নর্দমা: খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় উপদ্বীপে আর্টস্কানের রাজত্বকালে রোমানরা নর্দমার পুরো পথ তৈরি করেছিল। 

চিকিৎসার যন্ত্রপাতি: রোমানদের চিকিৎসার যন্ত্রপাতি  ২০ শতক পর্যন্ত ব্যবহার করা হতো। সে সময় আবিষ্কৃত হয় ভ্যাজাইনাল স্পেকালাম, রেক্টাল স্পেকালাম এবং পুরুষদের জন্য ক্যাথেটার।

নগর-পরিকল্পনা: নগর-পরিকল্পনায় রোমানরা ছিল সত্যিই অসাধারণ। নগরের সঠিক পরিকল্পনা দিয়েই তারা আবিষ্কার করে  ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা  ব্যবসা এবং উৎপাদনকে আরও বেশি কার্যকর করে। 

চৈনিক সভ্যতার অবদান
চৈনিক দর্শন: চীনের দর্শনের ইতিহাস ভারত ও গ্রীক দর্শনের ন্যায় সুপ্রাচীন। এদের মধ্যে তাও দর্শণ এবং মোতিদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লাওজ এবং চুংজুকে তাও দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাতা বলা হয়। কুংসুঙলুন নামক দার্শনিক ভাবকে বস্তুনিরপেক্ষ ভাবের মিল দেখা যায়। নীতিগত এবং রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কনফুসিয়াস এবং মেঙজুর মতের প্রসার ঘটে। প্রাচীন চীনা দর্শনের এ যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল প্রধানত আকাশ ‘মনের ভাব’, ধর্মশক্তি, চরিত্র, বস্তুর মৌলিক গুণ ইত্যাদি। চীন ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রসারও এই যুগে ঘটতে থাকে। কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদ একটি তৃতীয় দার্শনিক মত হিসাবে অনুসৃত হতে শুরু করে। ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুন সংগ্রামী বস্তুবাদী চিন্তাধারারও পথ প্রশস্ত করে দেয়। মাওসেতুং এবং সানইয়াত সেনের ন্যায় অগ্রসরবাদী চিন্তাবিদ এবং নেতৃবৃন্দ প্রাচীন বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচার এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
আধুনিক কাগজের ব্যবহার আবিষ্কার: মনে করা হয়, দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে আধুনিক কাগজের পুর্বরূপ উদ্ভব হয়ে ছিল যদিও এর পূর্বে কাগজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাগজের উদ্ভাবনকে প্রাচীণ চীনের চারটি বিশাল উদ্ভাবনের অন্যতম একটি বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন চীনে মণ্ড দ্বারা তৈরি কাগজ দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে হান জাতির চাই লুন নামের একজন আবিষ্কার করেন। চীনে সিল্কের সাশ্রয়ী ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে কাগজ ব্যবহার শুরু হয়।

কম্পাস: "দিক নির্দেশক" হিসেবে একটি চুম্বক জাতীয় যন্ত্র ব্যবহারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৪০-১০৪৪ সালের দিকে সং সাম্রাজ্যের একটি গ্রন্থে। সেখানে লৌহ নির্মিত একটি "দক্ষিণ-মুখী মাছের" উল্লেখ আছে যা এক বাটি পানিতে ভাসমান অবস্থায় দক্ষিণমুখী হয়। যন্ত্রটিকে “রাতের আধারে” পথ বোঝার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[১৫] যাইহোক, প্রথম নিমজ্জিত সূচালো চুম্বক কম্পাসের উল্লেখ পাওয়া যায় শেন কুও কর্তৃক ১০৮৮ সালে রচিত একটি গ্রন্থে।
গানপাউডার: চীনা আলকেমিগণ অমরত্বের অমৃত খুঁজতে গিয়ে গানপাউডার উদ্ভাবন করেন। সং সাম্রাজ্যের শাসনামলে জেং গংলিয়াং এবং ইয়াং ওয়েইডি কর্তৃক ১০৪৪-এ রচিত গ্রন্থ উজিং জংইয়াও-এ (武经总要) গানপাউডারের নাইট্রেট মাত্রা ২৭% থেকে ৫০% বলা হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে চীনারা যে মাত্রায় নাইট্রেট ব্যবহার করে গানপাউডার বানাত তার বিস্ফোরণ ঢালাই লোহা দিয়ে তৈরি ধাতব কনটেইনার ভেদ করতে পারত।

ছাপার যন্ত্র: ৮৬৮ সালে পৃথিবীর প্রথম ছাপানো বই (ডায়মন্ড সুত্রা) পৃথিবীতে ছাপানোর সংস্কৃতি তৈরির কিছু সময় পূর্বে চীনে কাঠের টুকরো দিয়ে বই ছাপানোর পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। কাঠের টুকরো দিয়ে বই ছাপানোর পদ্ধতি চীনা বর্ণমালার সাথে বেশি খাপ খেয়েছিল চলনযোগ্য ছাপানোর যন্ত্রের তুলনায়, যেটিও চীনারাই আবিষ্কার করেছিল কিন্তু প্রথম পদ্ধতিটিই ধরে রেখেছিল। 

রোমান  উত্তরাধিকার পাশ্চাত্য সভ্যতা
ইউরোপীয় রেনেসাঁ: রেনেসাঁ এর অর্থ হলো পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ।  ইউরোপে মধ্যযুগে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, বিবেকহীনতার সৃষ্টি হয় এবং স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার দ্বার রুদ্ধ হয়। ফলে ব্যক্তি মানসিকতার বিকাশ ব্যাহত হয়। এ দুর্বিসহঃ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। 

শিল্প বিপ্লব: আঠারো শতকের শেষদিকে এসে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় সাধারণভাবে তা শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। মোটামুটি ১৭৬০-১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ এই সময়কালে কৃষি এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে গতি শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সমুদ্র যাত্রা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়। এরপর পুঁজিবাদের উদ্ভব, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার, কয়লার খনি আর ইস্পাতের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক শিল্প শহর আর কারখানা গড়ে উঠে। ইংল্যান্ডে শুরু হলেও ইতালি, ফ্রান্স সহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসমূহে এর বিস্তার লাভ করে। ফলে অবিস্মরণীয় সব আবিষ্কার,  ব্যাপক কর্মসংস্থান আর পণ্য উৎপাদন ইউরোপকে পৃথিবীর নেতৃত্বস্থানীয় করে তোলে।  

চৈনিকদের পশ্চাদপসরণ
মধ্যযুগে চীন: কিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১১):  কিং রাজবংশ চীনের ইতিহাসের সর্বশেষ রাজবংশ। মাঞ্চুসরা এই বংশ প্রতিষ্ঠা করে যারা উত্তর পশ্চিম চীনে মিং শাসিত এলাকার বাইরে মহাপ্রাচীরের অপর প্রান্তে বসবাস করত। মিং বংশের শেষ সময়ে  নুরচাই যথন সকল জুরচেন উপজাতিদেরকে সংঘবদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।  কিয়ালং সম্রাটের শাসনামলে, কিং সম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্ব্বোচ্চ শীখরে পৌছায়। চীন সম্রাট তখন পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনগনকে শাসন করত। এবং একই সাথে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। 

আফিম যুদ্ধ: আফিম যুদ্ধ পরিচিত অ্যাংলো-চীনা যুদ্ধ। এর মাধ্যমে চীনে ইউরোপিয়ান আগ্রাসন শুরু হয়।  ব্রিটেন এবং মার্কিন এই দুই শক্তির যৌথ সক্ষমতার কাছে চীন বার বার পরাজয় মানতে বাধ্য হয়।  এটি  একটি  সিরিজ যুদ্ধ ছিল।  ব্রিটিশ নৌবাহিনী প্রযুক্তিগতভাবে উচ্চতর জাহাজ ও অস্ত্র ব্যবহার করে চীনাকে পরাজিত করে এবং ব্রিটিশরা তখন একটি চুক্তি চাপায় যা ব্রিটেনের জন্য অঞ্চল প্রদান করে এবং চীনের সাথে বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেয়।

আধুনিক চীন 
চীন প্রজাতন্ত্র (১৯১২-১৯৪৯): কিং রাজদরবারের দূর্বলতার কারণে তরুন রাজকীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এবং ছাত্রসমাজ সম্রাটকে উৎখাত করে একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করতে প্রয়াসী হন। ১২ই মার্চ ১৯১২ সালে নানজিংএ একটি অন্তর্বর্তী কালিন সরকার গঠিত হয়। সমাপ্ত হয় চীনের ২০০০ বছরের রাজকীয় শাসনের। ১৯১৯ সালে ভার্সাইলিস চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এ চুক্তিতে চীনের উপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদ এই চুক্তির স্বাক্ষরের বিপক্ষে মত দেয়। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দর্শনের প্রতি অশ্রদ্ধা, চীনের বামপন্থী নেতাদের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এছাড়া বলিসেভিক বিপ্লবীরা ও মস্কো থেকে প্রেরিত রুশ বিপ্লবীদের প্রতিনিধিরাও এর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯২০ সালে সান ইয়েত-সেন দক্ষিণ চীনে একটি বিপ্লবী ভিত্তি গড়ে তোলেন, বিভক্ত চীনকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। সোভিয়েত বিপ্লবীদের সাহায্য নিয়ে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন। ১৯২৫ সালে তার মৃত্যুর পর চিয়াঙ কাই সেং কুমিনটাং (চীনের রিপাবলিকান পার্টি) এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি উত্তর অভিযান (১৯২৬-১৯২৭) নামের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মধ্য ও দক্ষিণ চীনে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ ও মধ্য চীনের যুদ্ধবাজ নেতাদের দমন করে উত্তরের নেতাদের সাথে নামমাত্র মৈত্রী চুক্তি করেন। ১৯২৭ সালে, চিয়াং কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পূর্ব ও দক্ষিণ চীনের কমিউনিস্ট সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে তাদের উত্তর পশ্চিমের দুর্গম এলাকায় বিতাড়িত করেন। এ সময় কমিউনিস্টদের নতুন নেতা মাও সেতুং এর আবির্ভাব হয়।

চীনের মহাউত্থান: উপনিবেশ থেকে বিশ্ব শক্তি 
বিশ্ব শক্তির প্রস্তুতি: নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেখা পায়। জিয়াং-এর সামষ্টিক অর্থনীতির সংস্কারের মাধ্যমে দেং এর স্বপ্ন, "চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্রের" পথে দেশ আরেক ধাপ অগ্রসর ১৯৯৭ সালে, যুক্তরাজ্য কাছ থেকে হংকং-এর কর্তৃত্ব চীনের নিকট হস্তান্তর করে এবং ১৯৯৯ সালে পর্তুগাল তাদের কাছে ম্যাকাও প্রদেশটি ফিরিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী ঝু রোংজির অর্থনৈতিক নীতিমালা এশীয় অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও চীনা অর্থনীতিকে সজীব রাখতে সহায়তা করে। গড় বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ শতাংশ। কয়েক দশকব্যপী আলোচনার পর চীন অবশেষে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-কে তাদের বাজারে প্রবেশের অনুমতি দেয়। জীবনযাপনের মানের উন্নতি হয়। 

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ: সুবিশাল এই প্রকল্পটি চীনের দিক থেকে এটা পুনর্গঠনের শুরুর ধাপ – উন্নত সড়ক উন্নত জীবনের দিকে নিয়ে যাবে। চীনে এখনও অনেক মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সে কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের অবকাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টার কারণ বোঝা যায়।  চীনের উত্থানের অর্থ এটা নয় যে, বেইজিং তাদের আদর্শ ও সামাজিক সিস্টেম অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। চীন  আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য নতুন কোন মডেলও তারা তৈরি করছে না। চীন তাদের  শক্তির প্রসার ঘটাচ্ছে  এবং কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে তারা চীনা সংস্কৃতি ও ভাষা ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৃটেনের বৃটিশ কাউন্সিল বা ফ্রান্সের অলিয়েস ফ্রঁসেস দীর্ঘদিন ধরে যেটা করছে, তার চেয়ে এটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়।

বিশ্বজুড়ে চীনা প্রকল্প: কম্বোডিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অর্ধেকই আসে সাতটি বাঁধ থেকে। অর্থের বিনিময়ে এই বাধগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। দক্ষিণ আফ্রিকা একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পায়। চীনাদের অর্থায়ন এবং নির্মাণ প্রকল্প চালু আছে বাংলাদেশেও। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৬০০ প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চীন। অন্তত ১১২টি দেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছে। এই সহায়তার ক্ষেত্রে কখনো অনুদান, কখনো ঋণ, আবার কখনো বিনিয়োগ আকারে অর্থায়ন করেছে দেশটি। এই সহায়তা পাওয়া দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে চীনের প্রতি ঝুকে যাবে। এই দেশগুলোর বেশিরভাগকেই চীন সেইসব প্রকল্পে অর্থায়ন কিংবা ঋণ দিয়েছে যেগুলো তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত।

ইউক্রেন যুদ্ধে চীনা সুযোগ: ২০২২ এর ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ ইউরোপে যে যুদ্ধের শুরু করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র সহ সব ইউরোপিয়ান দেশ সক্রিয় অংশ নিচ্ছে।  এর মধ্যে রাশিয়াকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপকে জ্বালানি আর খাদ্য সমস্যায় ফেলেছে।  আর এর ফলে পৃথিবীর দুইটি দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ হয়েছে।  এর একটি ভারত আরেকটি চীন।  ভারত হয় উঠতে পারে ইউরোপের নতুন খাদ্য সরবরাহকারী।  আর চীন এরই মধ্যে রাশিয়ার সমস্ত বৈদেশিক বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।  আর ব্যাপক বিনিয়োগ আর সক্ষমতার কারণে চীন এই সময়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভুত হতে পারে।  এতে চীনের অর্থনীতি এমন এক উচ্চতায় যেতে পারে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তা আর ছুঁতে পারবে না। জ্বালানি বাজারে চীন হয়ে উঠতে পারে রাশিয়ার আর সারা বিশ্বের মধ্যে মধ্যবর্তী দেশ।  অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে সারা বিশ্ব চীনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনতে পারে।  এতে চীন প্রচণ্ড লাভবান হয়ে উঠবে।

কখন চীন হয়ে উঠবে প্রধান বিশ্ব শক্তি: বিশ্ব অর্থনীতির গতি বিশ্লেষণকারী বিজ্ঞজনেরা মনে করে চীন ২০৩০ এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যকরীভাবে অর্থনৈতিক শক্তিতে ছাড়িয়ে যাবে।  কিন্তু বিশ্বব্যাপী সামরিক উপস্থিতির কারণে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ নিতে আরো দুই দশক সময় লাগবে বলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত। একটি মাত্র ঘটনা যুক্তৰাষ্ট্ৰকে তার অবস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে - তাহল চীনের শাসন ক্ষমতা হতে বর্তমান শাসক শ্রেণী তথা কমুনিস্ট পার্টির অপসারণ।  চীনে  যদি ১৯৯০ দশকের প্রথম দিককার রাশিয়ার মতো  কিছু ঘটে। 

চীন কি যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে ভাল বিশ্ব মোড়ল হবে 
প্রাচীন সময় হতে চীন একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা নিয়ে চলে এসেছে। সাম্রাজ্য ভিত্তিক শাসনের এক পর্যায়ে আত্মধ্বংসী একটি হাস্যকর প্রক্রিয়া পরিচালিত হলেও (নতুন প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য তারাই চীনের প্রথম সাম্রাজ্য প্রমান করার জন্য পুরোনো শাসনের ইতিহাস মুছে ফেলতে সচেষ্ট থাকতো।  এর অংশ হিসেবে পুরোনো ইতিহাস পুস্তক, দলিলাদি সহ সমস্ত উৎস পুড়িয়ে ফেলত। কিন্ত জ্ঞানী সাধুদের নিজস্ব মন্দিরগুলোতে এর কপি সংরক্ষিত থাকায় প্রক্রিয়াটি বন্ধ হওয়ার পর পুরোনো ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা সহজ হয়েছে। ) জ্ঞানের প্রতি শাসকদের অনুরাগ চীন মোটামুটি একটি প্রজাপালক শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত করে এসেছে।  এমনকি চীনা শাসকরা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ক্ষেত্রেও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন।  এদিক থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা একবারে আগ্রাসী যার উত্তরাধিকার এখন যুক্তরাষ্ট্র বহন করে চলেছে।  আর গত আড়াই হাজার বৎসরের বেশি পাশ্চাত্য সভ্যতা (রোমান থেকে শুরু করে এর উত্তরাধিকার ইউরোপ হতে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র) আদিবাসী আর দুর্বল দেশগুলির উপর যে বর্বর শাসন (ভূমি]হতে উচ্ছেদ, নৃগোষ্ঠীর বিলুপ্তি, ব্যাপক লুটপাট,জোর করে ব্যাপক ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি) চালিয়েছে তার তুলনায় চীনারা অনেক মানবিক।  তারা নিজ সাম্রাজ্যের জনগোষ্ঠীর দেখভাল করেছে। 

এমনকি আধুনিক যুগেও চীনা সাহায্য কোনো দেশকে তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় প্রলুব্ধ করেনি।  পাকিস্তান তার নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই আছে।  এমনকি উগ্র তালিবানরা পর্যন্ত চীনা সাহায্যে ভীত নয়।  আফ্রিকার আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো চীনা সাহায্যে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারছে।  চীন সত্যকার অর্থে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে থাকছে।  ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মত ব্যবসা করে নিজেদের আখের আগে গুছিয়ে নিচ্ছে না। তানাহলে নিজ দেশে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে সাহায্যকারী দেশগুলোতে তাদের মত শাসন ব্যবস্থা থাকতে সাহায্য করার কথা নয় - যেমনটি যুক্তরাস্ট্র করছে।  কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য করার প্রথম শর্ত নিজের ব্যবসায়িক লাভ।  দ্বিতীয় শর্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা - অন্তত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন।  শুনতে মধুর হলেও এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থে নতুন শাসক তৈরী করে।  পাশ্চাত্য সহযোগিতা একটি দেশকে তার নিজস্বতা নিয়ে চলতে দেয় না।  ব্যাপক ধর্মীয় বিরোধ থাকার কারণে মুসলিম দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কখনোই গণতন্ত্র চায়নি। 

ফলে একান্ত তাবেদার সৌদ রাজবংশ এখনো সৌদি আরবে টিকে আছে। মিশরে জনপ্রিয় মুরসি সরকারকে উচ্ছেদ করে সামরিক শাসন চলছে।  মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশের বিরোধিতার মুখেও ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নিজ স্বার্থে সমস্যা দীর্ঘায়িত  করছে। ভারত প্রীতি কাশ্মীর সমস্যার সমাধন হতে দিচ্ছে না।  উপরে যতই মানবতার ভান দেখাক না কেন  মায়ানমার সরকারকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয়ার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানহীন। মুখে মানবতার স্লোগান থাকলেও  যুক্তরাষ্ট্রসহ সমস্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজ স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করে না। পৃথিবীর সমস্ত মিডিয়া আর প্রকাশনায় এদের একতচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে এই দানব আমাদের কাছে মানবতার প্রতীক।  আর তাদের চশমায় দেখানো চীন, রাশিয়া বা অন্য কোনো দেশ আমাদের কাছে দানব সদৃশ।  তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ  যাদের শক্তি আর অবদানে জয়ী হয়ে বিশ্ব এই অবস্থানে সেই রাশিয়া আমাদের কাছে অগ্রহনযোগ্য।  যুদ্ধে জাপানের উপর পারমাণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র।  আর জাপানি শিশুরা শেখে এটি রাশিয়ার কাজ।  প্রায় তিন কোটি মানুষের মৃত্যু আর প্রধান শক্তি জার্মানিকে পরাজিত করার নায়ক হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী পরিত্যাজ্য। আর যুদ্ধের প্রায় সময় ইচ্ছা করে অংশ নিয়ে নিয়ে একেবারে শেষ সময়ে এসে লাভের বড় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যায় বিশ্ব ত্রাতা।  যুদ্ধকে ব্যবসায়িক লাভবান করাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আর বিশ্ব ব্যাপী যুদ্ধ উন্মাদনা ছড়ানো আর টিকিয়ে রাখা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সমাদৃত।

সমাপ্তির পূর্বে 
আজ আমরা যতই তর্ক করিনা কেন একসময় যুক্তরাষ্ট্র সহ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বিশ্ব মোড়লীর স্থানটুকু ছেড়ে দিতে হবেই। তখন কে আসবে - চীন না অন্য কেউ? অর্থনীতি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এই পরিবর্তণ একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।  এটি চীন নেতৃত্ব দিলে আগামী দুই দশকের মধ্যে ঘটবে।  আর যদি চীন ব্যর্থ হয় তবে হয়ত পাশ্চাত্য আরো কিছুটা সময় পাবে।  তবে আমাদের মনোজগত আমাদের উপর শাসনকারী উপনিবেশিক পাশ্চাত্য শক্তি যেভাবে তৈরী করে রেখেছে তাতে এটা মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।  কিন্তু বাস্তব বড়োই কঠিন-  আমাদের মেনে নেয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। তাই ছোট দেশ আর নির্ভরশীল মানসিকরার জন্য মনোজগত আগামীর পরিবর্তন অনুযায়ী তৈরী করাটা আমাদের জন্য একটি অতি দরকারি পদক্ষেপ।  অন্তত আমাদের যারা শাসন করবেন সেই রাজনৈতিক নেতাদের  আর তাদের শাসন কার্যে  সহায়তাকারী  আমলাদের (বেসামরিক অথবা সামরিক) প্রস্তুতি নেয়াটা দরকার।

 

লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ