আজকের শিরোনাম :

নজরুল জন্মজয়ন্তী

সৃজনজুড়ে বিশ্বলোক

  সঙ্গীতা ইমাম

২৫ মে ২০২২, ১২:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

১১ জ্যৈষ্ঠ, নজরুলজয়ন্তী। প্রতিবছর এ দিনটিতে স্মরণ করা হয় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। প্রেম, দ্রোহ, দেশাত্মবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা আর আধুনিক মননের এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর অসামান্য সৃষ্টিভান্ডারের সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, কি জীবন, কি রাজনীতি, কি মানবপ্রেম বা বিরহগাথা—সবকিছুরই এক অনন্য সমন্বয় যেন তিনি রেখে গেছেন আমাদের জন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলার মানুষের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশেরও প্রতিটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে তাঁর গান-কবিতা-নাটক আমাদের পথ দেখিয়েছে, প্রেরণা জুগিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে নিয়ে আসা হয় এ দেশে। এরপর আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন।

নজরুলজয়ন্তী বা তাঁর প্রয়াণের দিনে কিংবা অন্য যেকোনো উপলক্ষে যখন কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টির কাছে আমরা হাঁটু মুড়ে বসি, মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা আদৌ কি তাঁকে সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে পেরেছি? যে অপার সাহিত্য ঐশ্বর্য তিনি রেখে গেছেন আমাদের জন্য, তার মর্মবাণীর কিছু কি অনুধাবন করতে পেরেছি আমরা? প্রশ্নগুলো আসে। কেননা, এমন বহুমাত্রিক প্রতিভাকে আমরা বড় খণ্ডিতভাবে গ্রহণ করছি প্রতিনিয়ত। তাঁর গান-কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের সুগভীর আখ্যান বাদ দিয়ে কেবল হামদ-নাতের রচয়িতাকেই কেন তুলে আনি বারবার? এ বোধ করি আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা। এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে ইসলামের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের স্বর্ণখনিকে কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাঙ্‌ময় প্রতিভায় অন্তত বাংলা ভাষায় আর কেউ ব্যবহার করতে পারেননি। তিনি ভাষা ও তার সার্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানতেন বলেই তাঁর শব্দচয়নে বিপুলভাবে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দগুলো কখনো কানেই বাজেনি। পড়তে গেলে মনেই হয় না শব্দগুলো অন্য ভাষা থেকে এসেছে। তাঁর রচিত হামদ-নাতগুলো কেবল ধর্মের ঐতিহ্যকেই বহন করেনি, তাতে মূর্ত হয়েছে মানবপ্রেমের জয়গাথা।

কিন্তু যে বোধ থেকে তিনি এই অপূর্ব সৃষ্টিগুলো করেছিলেন, তা কি আমরা আদৌ ধারণ করতে পারি? যদি পারতাম, তবে আর যা-ই হোক, তাঁকে ‘মুসলমান কবি’ শব্দবন্ধে আটকে ফেলার অপচেষ্টা করতাম না। কে না জানে, তাঁর শ্যামাসংগীত যে অকৃত্রিম আকুলতা আর আর্তি—তার নজির বাংলা গানের জগতে নেই বললেই চলে। অথচ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কথা বলতে গেলে তাঁর রচিত শ্যামাসংগীতের কথা যেন আমরা ভুলেই যাই। আমাদের এই দ্বিচারিতা ও মানসিক সংকীর্ণতাই নজরুলপাঠের প্রধান অন্তরায় বলে আমি মনে করি। কথাগুলো বলছি, কারণ প্রতিবছরই ১১ জ্যৈষ্ঠ বা ১২ ভাদ্রতে নজরুলসমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের সময় কেবল বাছাই করা কিছু হামদ-নাত বা ইসলামি সংগীতই বাজানো হয়। তাঁর গানের যে ভান্ডার, বছরের এ দুটো দিন যদি নির্দিষ্ট কয়েকটি গান বাছাই করেও বাজানো হয়, আমার মনে হয় তাতে অনেক দিন কোনো গানের পুনরাবৃত্তি করতে হবে না। তিনি তো নিজেকে কোনো ধর্ম-সম্প্রদায়-জাতিগোষ্ঠীর শিকলে বাঁধেননি, তবে আমরা কোন ধৃষ্টতায় তাঁকে কেবল মুসলমান কবি বানাতে চাই?

এ তো গেল একধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা। যদি সাহিত্যের তাত্ত্বিক আলোচনার দৃষ্টিতেও দেখি, তবু মনে হয় তাঁকে সম্পূর্ণ খুঁজে পাওয়ার বাসনাটুকুও আমাদের নেই, চেষ্টা তো পরের কথা। ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম’ এ বাক্যটির পাশে তাঁর অবিনশ্বর প্রেমের গানগুলো যেন আমরা খুঁজেই পাই না। নিজেদের বঞ্চিত করি তাঁর বিরহগাথার অপার সৃষ্টিমালা থেকে। তিনি বিপ্লব বা বিদ্রোহের গান-কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি সুরে-ছন্দে ধরে রেখেছেন মানব হৃদয়ের নানামাত্রিক অনুভূতি। খুঁজতে গেলে তার তল স্পর্শ করাও আমাদের জন্য শ্রমসাধ্য।

অথচ তিনি নিজেকে মেলে ধরেছিলেন বিপ্লবে-বিদ্রোহে-প্রেমে-বেদনায়-নির্জনতায়-একাকিত্বে। নিজেকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বলোকের প্রতিটি স্তরে। ভেদহীন, শ্রেণিহীন মানবাত্মার জয়গান গেয়েছিলেন উদাত্ত কণ্ঠে। ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে’ উঠেছিলেন বলেই তিনি ছিলেন চির উন্নত শির। নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো যদি পেরিয়ে আসতে না পারি, তবে কী করে খুঁজে পাব ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ সেই কাজী নজরুল ইসলামকে?

লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী।

এই বিভাগের আরো সংবাদ