আজকের শিরোনাম :

বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

  আলাউদ্দিন মল্লিক

২২ মে ২০২২, ১১:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

আলাউদ্দিন মল্লিক
গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে ABNews24.com  এ প্রকাশিত "কোনদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত" নিবন্ধটিতে যা বলা হয়েছে তার চাইতে ভিন্ন কিছু এখনও না ঘটাতে এই যুদ্ধ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো লেখা দেয়া হয়নি।  যুদ্ধের প্রায় তিনমাস পর এর বিশ্বব্যাপী সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই নিবন্ধটি আবর্তিত।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ 
রাশিয়া ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করে, ৪ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে, এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার পথে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে অধিভুক্ত করে। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের রাষ্ট্রত্বের অধিকারকে অস্বীকার করে রুশ-ভাষী ও জাতিগত রুশ সংখ্যালঘুদের নিপীড়নকারী নব্য-নাৎসিদের দ্বারা আধিপত্যের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন। পুতিন  উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো) ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করে রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে – এই'দাবি করেন।  তার মতে ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে যোগদান না করার দাবি জানিয়েছেন। রাশিয়া স্বঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্রী দোনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্কে ২০২২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দেয়, দোনবাসের দুটি স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্র রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পরের দিন, রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিল বিদেশে সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় এবং রুশ সেনারা উভয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, সকালে আক্রমণ শুরু হয়, যখন পুতিন ইউক্রেনকে "অসামরিকীকরণ ও ডিনাজিফাই" করার জন্য একটি "বিশেষ সামরিক অভিযান" ঘোষণা করেন। কয়েক মিনিট পরে, রাজধানী কিয়েভ সহ ইউক্রেনের সর্বত্র ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা হয়, এর পরেই একাধিক দিক থেকে একটি বড় স্থল আক্রমণ শুরু হয়।
রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের দুটি বিদ্রোহী অঞ্চল (ক্রিমিয়া ও দোনবাস) থেকে বহুমুখী আক্রমণ শুরু হয়েছিল। চারটি প্রধান সামরিক আক্রমণের ফ্রন্ট গড়ে উঠেছে: কিয়েভ আক্রমণ, উত্তর-পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ, পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ ও দক্ষিণ ইউক্রেন আক্রমণ। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পশ্চিম ইউক্রেনের অনেক দূর পর্যন্ত বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। রুশ বাহিনী চেরনিহিভ, খারকিভ, খেরসন, কিয়েভ, মারিউপোল ও সুমি সহ মূল বসতিসমূহের কাছে পৌঁছেছে বা অবরোধ করেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে এই হামলার ব্যাপক নিন্দা করা হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হামলার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সম্পূর্ণভাবে হামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রাশিয়াকে সামরিক অভিযান স্থগিত করার নির্দেশ দেয় এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল রাশিয়াকে বহিষ্কার করে। অনেক রাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা রাশিয়া ও বিশ্বের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, এবং ইউক্রেনকে মানবিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ হয়; রাশিয়ায় প্রতিবাদকারীরা গণগ্রেফতার এবং "যুদ্ধ" ও "আক্রমণ" শব্দগুলো নিষিদ্ধ করা সহ সংবাদ মাধ্যম সেন্সরশিপ বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়। অনেক কোম্পানি রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে তাদের পণ্য ও পরিষেবা প্রত্যাহার করে এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত মিডিয়া সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।

রাশিয়াকে যুদ্ধে আনার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যত চেষ্টা 
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়- ২রা ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অভিযোগ করে বলেছিলেন, তাঁর দেশকে ইউক্রেনে একটি যুদ্ধে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। পুতিন বলেন, রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের অজুহাত হিসেবে একটি সংঘাতকে ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। রুশ প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ইউরোপে ন্যাটো জোটের বাহিনী নিয়ে মস্কোর উদ্বেগকে যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করছে।

যুগে যুগে পরাশক্তিগুলো পৃথিবীজুড়ে শক্তিমত্তা দেখিয়েছে নিজেদের নানা মতবাদ ও তত্ত্বের মোড়কে ৷ অন্য দেশে কখনো কখনো বিনা প্ররোচনায় সামরিক হামলা চালিয়ে সেই দেশের নারী, শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কখনো কাঁপেনি ৷ কেবল মানুষ হত্যা নয়, তারা চেয়েছে ‘শত্রু দেশটি'র ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতিসমেত তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে৷ এরকম বহু একতরফা হামলার সাক্ষী এই বিশ্ব৷ সেসব তত্ত্ব বা মতবাদের অন্তর্নিহিত কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে কেবল আমাদের বিজয় পতাকা উড়বে, তোমাদের নয়৷ আমাদের দিকে চোখ রাঙিয়েছ তো মরেছো৷ তুমি শ্বাস গ্রহণ করতে পারবে, তবে প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হতে হবে আমাদের নাম৷ তোমাকে আমরা করুণা করতে পারি, তবে সমকক্ষ হতে দেবো না৷ মনরো ডকট্রিন বা মনরো মতবাদ নামে একটি তত্ত্বের কথা এখানে উল্লেখ করতে যায় ৷ আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে, ১৮২৩ সালের ২ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো কংগ্রেসের সপ্তম স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণে এই তত্ত্ব বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন৷ এর মোদ্দা কথা হচ্ছে, উত্তর বা দক্ষিণ অ্যামেরিকার সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবলয়ের অন্তর্গত৷ কেউ যদি এই গোলার্ধের কোনো দেশের ওপর নজর দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে এক হাত দেখে নেওয়ার সব আইনগত অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে ৷

ইউক্রেইনের সাথে যুদ্ধের প্রধান কারণ ন্যাটো। ন্যাটো (নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অরগাইজেশন) গঠন করা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিরুদ্ধের একটি সামারিক জোট। এর উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে এর প্রথম মহাসচিব লর্ড ইসমে বলেছিলেন, “এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো বিশ্বকে রাশিয়া থেকে দূরে রাখা, আমেরিকার নিকটে আনা এবং জার্মানদের দমিয়ে রাখা।”  প্রতিষ্ঠাকালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২। এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হবার পরই অধিক সংখ্যক দেশকে এর সদস্য করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এমনকি তাদের সামরিক জোট ওয়ারসের বিলুপ্তির পরও কি ন্যাটোর আর প্রয়োজন ছিল? পোল্যান্ডের ওয়ারশ-এ বসে রাশিয়ার নেতৃত্বে যে সামরিক জোট ওয়ারশ (ওয়ারপ্যাক) করা হয়েছিল সেই পোল্যান্ডই এখন ন্যাটোর সদস্য। শুধু পোল্যান্ড নয় পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশই এর সদস্য। ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ থেমে থাকেনি। সোভিয়েত রাশিয়ার ভূত তাদের মাথা থেকে যায়নি, পুঁজিবাদী পথে হাঁটলেও। তাদেরকে সামরিক নিশানায় রাখতে দরজায় চলে আসার উপক্রম ন্যাটোর নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্রের। তখন নিশ্চয়ই রাশিয়ার চুপ করে থাকার কথা নয়। যে কোনও ক্ষমতাধর পরাশক্তিই তা করবে না, তাই না?  ইউক্রেইন এতটা বেপরোয়া হতো না, তাদেরকে নিয়ে তোপের মুখে ফেলেছে মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি। এ জন্য তারা বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, সে তথ্য কংগ্রেসে প্রকাশিত। ‘নীল চোখ, ব্লন্ড হেয়ার, সাদা চামড়া, ইউক্রেনিয় ও ইউরোপিয় যারা নয়, তাদের সাথে চলে না’- এরা এমন শ্বেতাঙ্গবাদ ঢুকিয়ে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ক্যুর মাধ্যমে শাসকের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কারণ পূর্বের শাসক মার্কিনিদের ফাঁদে ও ফর্মুলায় পা দেয়নি।  পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দুনিয়াতে যত যুদ্ধ, রক্তপাত, বর্বরতা ঘটেছে তার ৮১ ভাগই করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ১৯ ভাগ করেছে অন্যান্য দেশ। বিগত ২০ বছরের হিসেব এর সাথে যুক্ত করলে তাদের বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পারদ উঠবে আরো উপরে।

বোকা ভালুকের আলু শস্যের আগা লাভ 
রুশদেশের উপকথায় বোকা ভালুক আর কৃষকের গল্প নিশ্চয়ই অনেকের জানা। ভাল্লুক শক্তিশালী হলেও কৃষক নিজের খাটুনির ফল দিতে নারাজ।  তাই কৃষক তাকে বুদ্ধি দিয়ে রাজি করাল যে, ভাল্লুক আলু শস্যের আগা পাবে, আর কৃষক নিবে গোড়া। এভাবে কৃষক ভালুককে ফাঁকি দেয়।  রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িত হয়ে ভালুকের মতোই মূল্যহীন প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।  আর কৃষক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র মূল ফসল ঘরে তুলে নিচ্ছে।  ইউরোপীয় দেশগুলো যারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে- তারা মার্কিন যুক্তরাস্ট্র হতে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহে নেমে পড়েছে।

ভুক্তভোগী ইউরোপ
নিজ মহাদেশে ইউরোপ বহুদিন এমন যুদ্ধ দেখেনি। এখন প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা আর টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে আসছে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ, হতাহত মানুষ কিংবা লাখ লাখ শরণার্থীর প্রাণ বাঁচানোর আকুতির ছবি। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপজুড়ে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।  গত শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি হলো স্বচ্ছ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি, যুদ্ধ না বাধানো ও পারস্পরিক আর্থ সামাজিক সম্পর্কের বিকাশ।
ইউক্রেনে যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমানোর যে সিদ্ধান্ত ইউরোপের দেশসমূহ নিয়েছে, পুরো বিশ্বব্যবস্থায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; এবং ইউরোপই এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি এই মন্তব্য করেছেন। ইউক্রেন ছিল ইউরোপের খাদ্য যোগানের অন্যতম মাধ্যম। যুদ্ধ সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত করেছে।  ইউরোপ বিকল্প উৎস হতে জ্বালানি আর খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।  কাতারের তেলমন্ত্রী এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার পরিবর্তে জ্বালানি দিতে সক্ষম নয়।  ভারত প্রাথমিকভাবে কিছুটা শস্য সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আমেরিকান অন্যান্য মিত্র দেশদের নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে।  কিন্তু এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে না।  

যুদ্ধে লাভ আমেরিকার 
ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপকে আরেকবার যুদ্ধ সম্ভাবনার দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতক্ষ্য মদদে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এরই মধ্যে জনমত এমন এক স্তরে নিয়ে এসেছে যেখানে অধিকাংশ মনে করেন রাশিয়া ইউক্রেন পুরোটা দখলে নিয়ে প্রথমে তার পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করবে।  এরপর পূর্ব ইউরোপ দখল অভিযান।  তারপর বাকি ইউরোপ। 

ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপকে আরেকবার যুদ্ধ সম্ভাবনার দ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতক্ষ্য মদদে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এরই মধ্যে জনমত এমন এক স্তরে নিয়ে এসেছে যেখানে অধিকাংশ মনে করেন রাশিয়া ইউক্রেন পুরোটা দখলে নিয়ে প্রথমে তার পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করবে।  এরপর পূর্ব ইউরোপ দখল অভিযান।  তারপর বাকি ইউরোপ। 

এর যৌক্তিক ফল হচ্ছে ইউরোপীয় শক্তির - যাদের যথেষ্ট অর্থ সম্পদ আছে - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রচুর পরিমান অস্ত্র ক্রয় করা।  আগামী এক দশক এই প্রবণতা টিকিয়ে রাখতে পারলে মার্কিন অর্থনীতি আবার দুনিয়ায় এক নম্বর হয়ে উঠবে যেমনটি হয়ে উঠেছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়।  বর্তমান চীনের সাথে যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ চলছে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত পদ্ধিতিতে নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন।  এই একটি উপায়ে যুদ্ধ লাগিয়ে বা আরেকটি  স্নায়ুযুদ্ধের অবতারণা করে তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারবে।

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই গণতন্ত্র আর ব্যক্তি অধিকারের নামে জন্ম নেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৬৯ বৎসর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তী ৪৫ বৎসরে শীতল বা স্নায়ু যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে এই অবস্থান একক কর্তৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করে।  ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রাধান্য দিয়ে নেতৃত্ব দেয়া এই দেশটি এখন চীনের কাছে অর্থনীতিতে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে।   বৈশ্বিকভাবে প্রায় সবাই একমত যে, বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ ‘জেতে’ না। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জয়ী না হলেও সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সাধারণ ক্রেতা, যারা সংখ্যায় অনেকগুণ । 

বিশ্ব ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  এমন এক শক্তি যার কাজ যুদ্ধ করা - তবে জয় নিশ্চিত হয়ে আর নিজের তেমন কোনো ক্ষতি না করে।  যুদ্ধ যে একটি ব্যবসা হতে পারে- আর তার থেকে লাভ করে নিজের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখা যায় তার জ্বলন্ত প্রমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  দেশটি নিজের অর্থনীতি গড়ে তুলেছে যুদ্ধ নিয়ে।  যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রয় ব্যবসার প্রবর্তক আর সেরা এই দেশটি এমন কোনো অঞ্চল নেয় যেখানে কোনো না কোনো ভাবে অংশ নিচ্ছে না। গহীন আফ্রিকা হতে সুদূর ল্যাটিন আমেরিকা, উন্নত ইউরোপ (আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি, বাস্ক গেরিলা প্রভৃতি) হতে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তর কোথায় নেই মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা?

ডিম পাড়ে হাসে খায় বাগডাসে 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্ব মোড়লিটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এই বিশ্ব যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলতে গেলে কোনো প্রকার বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি।  জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণ একটি ঐতিহাসিক অপ্রমাণিত ঘটনা।  আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া। বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিগুলো যেমন ব্রিটিশ শক্তি, ফ্রান্স, স্পেন - এরাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  কিন্তু লাভের পুরো অংশটা নিয়ে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

এবারের ইউক্রেন যুদ্ধ এরকম আরেকটি সম্ভাবনা তৈরী করেছে।  যেহেতু অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর চীন যুদ্ধের কোনো অংশ নয় - কিন্তু রাশিয়া তার উপর বিশ্ব আর্থিক সমর্থন আর বাণিজ্যের জন্য নির্ভর করবে তাই শেষ পর্যন্ত রাশিয়া হয়ত এমন একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল যার শেষ ফলটা চীন ভোগ করবে।  
 
শেষ হাসিটা কার
কোনো যুদ্ধই আর এখন দূরে নয়। ইউক্রেনে বাংলাদেশের একটি জাহাজ পরিত্যক্ত হয়েছে। বিশ্বে সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে গেছে। যুদ্ধ ইউরোপে হলেও বাংলাদেশের মতো সব দেশ এর প্রভাব অনুভব করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে। এই যুদ্ধে ‘মিলিটারি কমপ্লেক্স’ (সামরিক খাত সংশ্লিষ্ট শিল্প) ছাড়া সবারই ক্ষতি হচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর আগেই বিশ্বে টালমাটাল পরিস্থিতি ছিল। ক্ষমতার কেন্দ্র পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে আসছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনার চর্চার আধিক্য এবং বৈশ্বিক মিলিটারি কমপ্লেক্স যুদ্ধের মাধ্যমে টাকা বানাতে চেয়েছিল। এই যুদ্ধ গত ৭৫ বছরে ক্রমহ্রাসমান দুই শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে লড়াই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর সমস্যাকে বৈশ্বিক সমস্যা বানিয়েছেন। যুদ্ধ কোনো নৈতিক কিছু হতে পারে না। যুদ্ধ নৃশংসতা নিয়ে আসে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ১০ বছর ধরে তাঁর নিরাপত্তার স্বার্থে ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন। প্রপাগান্ডা যুদ্ধে আপাতত পশ্চিমা গণমাধ্যম জয়ী হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর ফল কী হয় বলা কঠিন।  

পশ্চিমা ও এ দেশের গণমাধ্যম ইউক্রেনের দিকে ঝুঁকে আছে । এটি লুকানোর কোনো উপায় নেই। তথ্যযুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যম নাকি রাশিয়ার গণমাধ্যম জিতে গেল তা নিয়ে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।

সম্পদশালী ইউরোপীয় শক্তি নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেছে।  এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার চীনের নিটক হতে প্রথম স্থানটি কেড়েনেওয়া সম্ভব হবে। আরেকটি বিষয় বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তারকারী ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ সেন্টার ফর অলটারনেটিভ ফাইন্যান্সের তথ্য বলছে, ডিজিটাল মুদ্রার  জায়গা এবার দখলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মারাত্মক গোপনীয়তা আর নিরাপত্তার চাঁদরে ঢাকা এই মুদ্রা হতে চীন কেন সরে গেল এটি একটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। হয়ত চীনা প্রশাসন সময়ের আগে এটির পৃষ্ঠপোষকতা করে প্রযুক্তি নির্ভর ফাটকাবাজির সম্ভাবনা দেখে পিছিয়ে গেছে।  কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখানে বড় ধরণের বাজি ধরেছে।  যুক্তরাষ্ট্র জানে অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে আর প্রযুক্তির কাঁধে সওয়ার হয়েই শুধু পুরোনো বিশ্ব-মোড়লিটা ফিরে ধরে রাখা যেতে পারে।
 

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯)।

এই বিভাগের আরো সংবাদ