আজকের শিরোনাম :

গানে ও নেপথ্যসঙ্গীতে অসামান্য প্রাচ্য-প্রতীচ্য যোগ তাঁর ছবিতে

দুই ভুবনের পারে

  দেবাশিস রায়চৌধুরী

১৫ মে ২০২২, ১১:২৭ | অনলাইন সংস্করণ

হীরক রাজার দেশে ছবির গান রেকর্ডিংয়ে সত্যজিৎ রায়, সঙ্গে রবি ঘোষ, তপেন চট্টোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল প্রমুখ। ছবি: সন্দীপ রায়
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে উত্তাল পৃথিবী, অস্থির কলকাতা। রাত জেগে এক তরুণ বিবিসি রেডিয়োতে নিবিষ্ট মনোযোগে শুনছেন নারায়ণ মেননের বীণায় বাখ-এর একটি কম্পোজ়িশন! বীণা তো একান্ত ভারতীয় ধ্রুপদী যন্ত্র। সেই যন্ত্রে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত কেউ বাজায়? বাজিয়েছিলেন ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতে প্রাজ্ঞ নারায়ণ মেনন (যিনি পরে বিবিসির অধিকর্তা হয়েছিলেন)। আর সেই খোঁজ রাখতেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বুঁদ হয়ে থাকা এই তরুণ। তখন তিনিও জানেন না আর দুই দশকের মধ্যে তিনিই সৃষ্টি করবেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীত-সমন্বয়ে এমন এক সম্ভার, ভারতীয় চলচ্চিত্রে যা নিয়ে আসবে প্রার্থিত শৈল্পিক সাবালকত্ব।

চলচ্চিত্র নির্মাণ করার অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের প্রথম প্রেম সঙ্গীত। তা হবে না-ই বা কেন? জন্মসূত্রে পিতৃ-মাতৃকুল থেকে পেয়েছিলেন স্বাভাবিক সাঙ্গীতিক বোধ ও উত্তরাধিকার। তাঁর সুরস্মৃতি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের প্রখর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই বার্লিন রেডিয়োতে শুনেছিলেন বাখ ও হাইডেন-এর সঙ্গীত। তার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে শাখাপ্রশাখা-র শুটিংয়ের সময়ে প্রযোজক জেরার দেপার্দু-কে সেই বাজনার স্টাফ নোটেশন স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ নির্ভুল লিখে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় উপহার পাওয়া ছোট গ্রামোফোনে পশ্চিমের বাজনা শোনার হাতেখড়ি। কৈশোরে রেকর্ডে বেটোফেনের কম্পোজ়িশন শুনে, তাঁর সম্পর্কে বইপত্র জোগাড় করে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। সেই সময় থেকেই বাখ, মোৎজ়ার্ট ও বেটোফেন তাঁর প্রিয় কম্পোজ়ার। অন্য দিকে, পারিবারিক আবহাওয়ায় ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ব্রহ্মসঙ্গীত। তুলনায় ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিতি একটু দেরিতে, চল্লিশের দশকে। এ সব সত্ত্বেও নিজে সঙ্গীত সৃষ্টি করবেন বা কম্পোজ়ার হবেন, এমন কথা পথের পাঁচালী করার সময়েও ভাবেননি। তাই অপু ট্রিলজিতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জলসাঘর-এ উস্তাদ বিলায়েত খান, দেবী-তে উস্তাদ আলি আকবর খান আর রবীন্দ্রনাথ টেগোর তথ্যচিত্রে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে দিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব। তবে জলসাঘর-এর একটি বিশেষ দৃশ্যে বিলায়েত খানের সঙ্গীতের সঙ্গে সিবেলিয়াস-এর একটি সুরসৃষ্টির রেকর্ডিং উল্টো করে বাজিয়েছিলেন। নেশাতুর বিশ্বম্ভর রায়ের মনের ভিতরে বয়ে চলা ওলটপালট চিন্তার ঝড়কে এই ধ্বনি অব্যর্থ ভাবে প্রকাশ করেছিল।

পথের পাঁচালী-পূর্ববর্তী বাংলা ছবির অকারণ ও নির্বিচার নেপথ্যসঙ্গীতের ও গানের প্রয়োগের অযৌক্তিক রীতিকে এড়িয়ে, সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে প্রচলন করলেন এমন এক নেপথ্যসঙ্গীত যা আলাদা করে জেগে থাকে না, ছবি আলো অভিনয় সংলাপ ও নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে মিশে, দৃশ্যের মূল ভাবকে দর্শকের মনে সঞ্চারিত করতে সাহায্য করে। এর মূল লক্ষণ এক শিল্পিত পরিমিতি। মনে পড়ে যায় পথের পাঁচালী-তে দুর্গার মৃত্যুর পর সর্বজয়ার কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্যে তারসানাইয়ের করুণ মূর্ছনা (এই কম্পোজ়িশনটি যদিও রবিশঙ্করের, ছবিতে সর্বজয়ার কান্নার শব্দটিকে না শুনিয়ে তারসানাইয়ের ধ্বনি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত সত্যজিতের)। এই রকম অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সত্যজিৎ সৃষ্টি করেছেন তাঁর নেপথ্যসঙ্গীতের সুচারু প্রয়োগে। তিন কন্যা ছবি থেকে সত্যজিৎ নিজের হাতে তুলে নিলেন সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব। তিনি ক্রমশই টের পাচ্ছিলেন, তাঁর নিজের মনেই বহু সাঙ্গীতিক ভাব আসছে যার যথার্থ রূপায়ণ তাঁর চলচ্চিত্রের মুহূর্তগুলিকে সমৃদ্ধ করবে। সত্যজিতের সঙ্গীত সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভাবেই চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে, তা সে নেপথ্যসঙ্গীতই হোক বা গান রচনা।

সত্যজিতের সঙ্গীতসৃজনের প্রণালীটি ছিল অনেকাংশে পাশ্চাত্য সঙ্গীত ঘেঁষা। কোনও সুর মনে এলে প্রথমে শিস দিয়ে তা ব্যক্ত করতেন। অনেক সময়ে এডিটিং চলাকালীন সেই দৃশ্যের নেপথ্যসঙ্গীত তাঁর মাথায় চলে আসত। সঙ্গে সঙ্গেই তা চিত্রনাট্যের খাতায় লিখে ফেলতেন। তার পর পিয়ানোতে তা বাজিয়ে স্টাফ পদ্ধতিতে স্বরলিপিবদ্ধ করতেন। মূল সুরের বা গানের অর্কেস্ট্রেশন করে, সেই মূল স্বরলিপি থেকে বিভিন্ন যন্ত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা স্বরলিপি বা স্কোর শিট তৈরি হত। গায়ককে গান শেখাতেন নিজেই। তার পর রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে সব যন্ত্রী ও গায়ক নিয়ে হত মহড়া। তার পর শুরু হত রেকর্ডিং।

সঙ্গীত সৃজনের পদ্ধতিটি পাশ্চাত্যধর্মী হলেও, চলচ্চিত্রের বিষয়টির উপর নির্ভর করত বাদ্যযন্ত্রের নির্বাচন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেহালা, চেলো, ডবল বেস-এর মতো পাশ্চাত্যযন্ত্রের সঙ্গে অনায়াস মুনশিয়ানায় মিশিয়ে নিতেন সেতার, সরোদ, বীণা, বাঁশির মতো ভারতীয় যন্ত্র। আধুনিক নাগরিক পটভূমিতে প্রোথিত গল্প বা চরিত্রের ক্ষেত্রে এই ধরনের ইঙ্গ-বঙ্গ বাদ্যযন্ত্রের সমাহার ব্যবহার করতেন সত্যজিৎ, কারণ তাঁর মতে আমাদের নাগরিক জীবনে বড়ই পাশ্চাত্যপ্রভাব, তাই শুধুই ভারতীয় যন্ত্রে রাগসঙ্গীত দিয়ে সুরসৃষ্টি করলে তা যথার্থ হবে না। কিন্তু যেখানে আঞ্চলিক পটভূমিতে গল্প বা চরিত্রের স্থিতি, সেখানে আবশ্যিক ভাবে ব্যবহার করেছেন লোকসুর ও লোকসঙ্গীতের যন্ত্র। মনে পড়ে, কাঞ্চনজঙ্ঘা-র ভিখারি বালকের গলায় নেপালি গান আর আঞ্চলিক যন্ত্রের ব্যবহার, কিংবা সোনার কেল্লা-য় রাজস্থানি লোকগান আর ‘রাবণহত্তা’ যন্ত্রের ব্যবহার।

চরিত্রের মানসিকতা এবং একাধিক চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বকে মূর্ত করতে সত্যজিৎ সব সময়ই রচনা করেছেন ‘পলিফনিক’ কম্পোজ়িশন, অর্থাৎ মূল সুর বা মেলডির উপর দিয়ে হারমনি এবং কাউন্টারপয়েন্ট। একে বলা হয় ‘পলিফনি’। মজা হল, এই পাশ্চাত্য ধ্রুপদী ঢঙের কম্পোজ়িশনে সত্যজিৎ নিয়ে এলেন ভারতীয় সুর আর যন্ত্র! এত দিন ভারতের বৃন্দযন্ত্রসঙ্গীত বা অর্কেস্ট্রা সমবেত ভাবে শুধু একটিই সুর বা মেলডি বাজাত। এ বার ভারতীয় সিনেমার সঙ্গীতে এল ‘পলিফনিক’ বৃন্দবাদন, যা চরিত্র বা নাট্যমুহূর্তের জটিলতাকে সাঙ্গীতিক মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে। আবার ছবির মূল সুরটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বা মূল চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য সৃষ্টি করেছেন ‘থিম’ সঙ্গীত। বেশ কয়েকটি ‘থিম’ রসিক শ্রোতাদের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। যেমন, পথের পাঁচালী-র থিম (যদিও রবিশঙ্করের করা), চারুলতা থিম (‘মম চিত্তে’ গানের উপর), ফেলুদা থিম, জেনে বা না জেনেও যা অনেকের ফোনের কলার টিউন, ঘরে বাইরে ছবিতে বিমলার বাহিরমহলে বেরোনোর থিম (‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণে’ গানের উপর) ইত্যাদি।

গান রচনা আর তার অর্কেস্ট্রেশনের বেলায়ও একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। চলচ্চিত্রের বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছে গান, যা সেই সময়ে অবশ্যম্ভাবী। অকারণে, বা শুধুই গানের জন্য গান নয়। তাঁর জীবনের প্রথম গান রচনা দেবী ছবির জন্য রামপ্রসাদী সুরে একটি শ্যামাসঙ্গীত, তার পর চিড়িয়াখানা ছবির জন্য ‘ভালবাসার তুমি কী জানো’। অনুপুঙ্খ-সজাগ সত্যজিৎ গল্পের সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, সেই সময়ের ফিল্মে যেমন গান হত তেমন ঢঙে গানটি বাঁধলেন। যন্ত্রানুসঙ্গও একেবারেই সময়ানুগ!

এর পর আসে ‘গুপী গাইন’ সিরিজ়ের তিনটি ছবির ৩২টি গান। এই গানগুলিতে স্রষ্টা মিশিয়েছেন লোকসুর, বিভিন্ন রাগ এমনকি কর্নাটকি সুরও। গুপী-বাঘা বিপদে পড়লেই তাদের স্রষ্টা তাদের গলার গানে কর্নাটকি সুর ব্যবহার করেছেন। যেমন, গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে ‘ওরে বাঘা রে’, হীরক রাজার দেশে ছবিতে ‘পায়ে পড়ি বাঘমামা’ আর গুপী বাঘা ফিরে এল ছবিতে (পরিচালনা: সন্দীপ রায়) ‘মোরা আসি ধেয়ে’ গানগুলিতে। অর্কেস্ট্রেশনের দিক দিয়ে এই ৩২টি গানের তুলনা মেলা ভার।

এই গানগুলিতে গায়কের মূল মেলডির পিছনে রয়েছে বহুমাত্রিক হারমনি যা বাজতে থাকে যন্ত্রে। ‘নহি যন্ত্র’ গানটির ‘রাজা ধিক, ধিক, ধিক’ অংশে মিলিত বেহালা, চেলো ও ডবল বেস-এর কাউন্টারপয়েন্টের প্রয়োগ কম্পোজ়ার সত্যজিৎ রায়কে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পোজ়ারদের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসিয়ে দেয়।

যত বয়স বেড়েছে, কম্পোজ়ার সত্যজিৎ ক্রমশই পরিণত হয়েছেন। তাঁর শেষ পর্যায়ের চলচ্চিত্রের সঙ্গীত তার সাক্ষী। শাখাপ্রশাখা ছবিতে তিনি নিজের সৃষ্ট সঙ্গীত ছাড়াও ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজস্ব প্রিয় কম্পোজ়ারদের সঙ্গীত। প্রশান্ত নামের চরিত্রটি বাখ, বেটোফেন ও সঙ্কটের মুহূর্তে ‘কিয়েরি ইলেইসন’ (গ্রেগরিয়ান চান্ট) শোনেন। প্রাজ্ঞ শ্রোতাদের মনে আসতে পারে তাঁর রবীন্দ্রনাথ টেগোর তথ্যচিত্রে ব্যবহৃত ব্রহ্মসঙ্গীত ‘তুমি বিনা কে, প্রভু, সংকট নিবারে’। গ্রেগরিয়ান স্তোত্রটিতেও সেই একই প্রার্থনা নিহিত। পাশ্চাত্য কনচার্টো বা সোনাটা-র একটি ‘রনডো’ কাঠামো থাকে, যেখানে একটি থিম বাজনার শেষের দিকে ফিরে ফিরে আসে। পাশ্চাত্যসঙ্গীতের এই ‘রনডো’ আঙ্গিক সত্যজিতের চলচ্চিত্রের নির্মাণকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনই তাঁর জীবনবীক্ষাতেও এই সঙ্কটাপন্ন মানবতার সঙ্কট মোচনের প্রার্থনা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর শেষের দিকের ছবির সাউন্ডট্র্যাকে— গ্রেগরিয়ান স্তোত্রের উচ্চারণে।

 

সৌজন্যে : দৈনিক আনন্দবাজার

এই বিভাগের আরো সংবাদ