যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ
আলাউদ্দিন মল্লিক
১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ
শুরুটা এমনই: ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি বড় পদক্ষেপ নিতে গত কয়েক বৎসর যাবৎ চীন চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ তেল আমদানিকারক দেশ হিসেবে তার নিজস্ব মুদ্রায় কেনার অধিকার পেতে চাইছে দেশটি। আমদানিতে মার্কিন মুদ্রার ঝুঁকি হ্রাস এবং আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য আগ্রাসন হতে বাঁচতে এটি তার জন্য একান্তই দরকার। চীন তার মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করে ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল কিনছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের জন্য মার্কিন মুদ্রায় তেল বিক্রর অর্থ গ্রহণ করা কঠিন, সেজন্য চীন ইউয়ান দিয়ে মূল্য পরিশোধ করার চিন্তা ভাবনা করছে। এতদিন পণ্যের বিনিময়ে চীন ইরান হতে তেল কিনছিল। এক সময়ের বিশ্ব শক্তি রাশিয়া আর ইসলামী বিশ্বের নতুন নেতা হওয়ার দৌড়ে সামিল তুরস্ক এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। হুগো শ্যাভেজের পথে হাটতে থাকা মাদুরোর ভেনেজুয়েলা এই যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করার অভিন্ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে যোগ দিবে।
বিশ্ব মোড়লের ইঁদুর দৌড়: গত শতকের নব্বইর দশকের প্রথম ভাগে মুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভুত হয়। এই ঘটনাটি ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে। অনেক মতভেদ থাকলেও সবাই একটি বিষয়ে একমত যে অর্থনীতির পতন এই ঘটনার মূল নিয়ামক শক্তি। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে প্রযুক্তির উন্নতি তাতেই দুই বিশ্ব মোড়লের একজন সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ে। আর প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে অর্থনীতিতে টেক্কা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এই অর্থনীতি আর প্রযুক্তির মহারণে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট সাথী ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন আর ভারত। এর মধ্যে শিল্প আর প্রযুক্তির উন্নয়নে চীন আর ভারত সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। অল্প মজুরি আর অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্তি আর কৌশলগত মিত্রতার কারণে চীন হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের ডান হাত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর বৃহৎ কারখানাগুলো চীনে স্থানান্তরিত হয়; চীন হয়ে উঠে পাশ্চাত্য অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
তাই মাত্র পঁচিশ বৎসরের মধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে এক নম্বর স্থান দখল করেছে। প্রযুক্তিতে এরই মধ্যে চীন হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সামরিক আর মহাকাশ গবেষকদের বড় একটা অংশ চীনের ছত্রছায়ায় চলে আসে। ফলে এ দুটি বিষয়ে চীন দ্রুত অগ্রসর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। অর্থিনীতির অগ্রগতির সুবিধা নিয়ে অতি শীঘ্র চীন বিশ্বের প্রধান মোড়ল হয়ে উঠতে যাচ্ছে।
নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ: গত বৎসর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশন সামনে রেখে তিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যেকোনো মূল্যে স্নায়ুযুদ্ধ এড়াতে হবে। নতুন করে এ যুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা। সম্ভবত তা হবে আরও বিপজ্জনক এবং সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।’ চীনের সঙ্গে চলমান সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে বলে ২০২০ এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই । চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে দোষারোপ করেছেন। ওয়াং ই বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তি চীন-মার্কিন সম্পর্ককে জিম্মি করছে এবং এই দুই দেশকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।' তাইওয়ান ইস্যু: ২৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দ্বীপ তাইওয়ানের ব্যাপারে একবারে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের। চীন তাইওয়ানকে নিজের অখন্ড অংশ বিবেচনায় নিয়ে এর পুনঃএকত্রীকরণকে তার জাতীয়তাবাদী চেতনার অপৰিহাৰ্য অংশ মনে করে । যুক্তরাষ্ট্র বেইজিং নিয়ন্ত্রিত চীনকে একক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। আর তাইওয়ান তার কাছে নিজ জাতীয় স্বার্থ আর অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করে। গত কয়েক বছরে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা ছড়িয়েছে, উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের যৌথ সামরিক মহড়া নিয়ে; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের বৈঠককে কেন্দ্র করেও। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরের একক নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে দিতে নারাজ। ফলে তাইওয়ান প্রশ্নে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে আছে দুই দেশ। তাই বিশ্ব রাজনীতির অনেক বিজ্ঞজন "নতুন স্নায়ুযুদ্ধে পলিসি ফুটবলে পরিণত হয়েছে তাইওয়ান" বলে মন্তব্য করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের জটিল সমীকরণ: গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১অকাস চুক্তি যা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নতুন চুক্তি - একুশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বিন্দু হিসেবে দেখা হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই বিশেষ নিরাপত্তা চুক্তিটি চীনের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পকের নতুন একটি মাত্রা যুক্ত করেএই অঞ্চলকে এক জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপের সঙ্গে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৭২ সালের রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর বা ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতনের পূর্বাপর তুলনীয় হতে পারে। এই প্রতিটি ঘটনাই গোটা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল। চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ অস্ট্রেলিয়াকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর এই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা অস্ট্রেলিয়ার নৌবহরে যোগ করছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। অস্ট্রেলিয়া নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতেও সই করেনি। ফলে এমন কোনো অস্ত্র যদি তাদের নৌবহরে যুক্ত হয়, তবে কোনো চুক্তিই ভঙ্গ হবে না। এই চুক্তি পুরো অঞ্চলে এক নয়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণ হবে নিশ্চিতভাবে। কারণ, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল যে, তারা চীনের সঙ্গে দ্বৈরথে দক্ষিণ চীন সাগরকেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছে। এদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো এই সাগরকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবেই দেখতে চায়। তারা এখানে কোনো বহিঃশক্তির প্রবেশ দেখতে চায় না। ক্ষতি হয়েছে দুই দেশেরই: চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উভয় দেশই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর দুই দেশের বাণিজ্য কমেছে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এ দ্বন্দ্বের ফলে লাভবান হয়েছে অন্য দেশগুলো। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড)-এর প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের ক্ষতি হলেও লাভবান হয়েছে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, মেক্সিকোর মত দেশগুলো। চীনা পণ্যে শুল্ক বসানোর ফলে অন্য দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়েছেন মার্কিন আমদানিকারকরা। চীনের হারানো বাণিজ্যের প্রায় ৬৩ শতাংশই কব্জা করেছে এসব দেশগুলো। বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জেতে না: বৈশ্বিকভাবে প্রায় সবাই একমত যে, বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ ‘জেতে’ না। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জয়ী না হলেও সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সাধারণ ক্রেতা, যারা সংখ্যায় অনেকগুণ । দেশ দুটি একে অপরের পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর করে চলেছে । বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে পারেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে যেতে পারেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে, তার পরও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। চীনের অভিযোগ, বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।’এ অভিযোগ অসত্য নয়। বাংলদেশের সম্ভাবনা: চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ। চীনে তৈরী পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক এড়াতে দেশটি থেকে আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকবে। ফলে চীনের হারানো বাজার ধরার সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশ ও উল্লিখিত দেশগুলোতে। আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে বেসবল ক্যাপ, ব্যাগ, মোটরসাইকেলের মতো চীনা পণ্য আমেরিকানদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্য, যেমন- ওয়াশিংমেশিন, ডিশ ওয়াশার, হেয়ার ড্রায়ার, ওয়াটার ফিল্টার ইত্যাদির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বাড়তি শুল্ক। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর চীন ছাড়ার প্রবণতা অবশ্য শুল্ক আরোপের আগেই শুরু হয়েছিল। কারণ চীনের সস্তা শ্রমের সুবিধা নিতেই তারা সে দেশে কারখানা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমবাজার আর সস্তা নেই। বরং চীনের চেয়ে অনেক কম খরচে পাশের দেশগুলো থেকে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণেই ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরী পোশাক রফতানি ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দ্রুত প্রয়োজনীয় বৈদেশিক বিনিয়োগ আর বৃহৎ পাশ্চাত্য বাজারে আরো বেশি অনুপ্রবেশ একটি সহজতর বিষয়ে পরিণত হবে। তাই আমাদের দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নিতে হবে। লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যেকোনো মূল্যে স্নায়ুযুদ্ধ এড়াতে হবে। নতুন করে এ যুদ্ধ বাধলে তা হবে আগেরটি থেকে আলাদা। সম্ভবত তা হবে আরও বিপজ্জনক এবং সেটি থামানোও হবে বেশি কঠিন।’ চীনের সঙ্গে চলমান সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে বলে ২০২০ এর মে মাসের শেষ সপ্তাহে মন্তব্য করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই । চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে দোষারোপ করেছেন। ওয়াং ই বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক শক্তি চীন-মার্কিন সম্পর্ককে জিম্মি করছে এবং এই দুই দেশকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে।' তাইওয়ান ইস্যু: ২৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার দ্বীপ তাইওয়ানের ব্যাপারে একবারে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের। চীন তাইওয়ানকে নিজের অখন্ড অংশ বিবেচনায় নিয়ে এর পুনঃএকত্রীকরণকে তার জাতীয়তাবাদী চেতনার অপৰিহাৰ্য অংশ মনে করে । যুক্তরাষ্ট্র বেইজিং নিয়ন্ত্রিত চীনকে একক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। আর তাইওয়ান তার কাছে নিজ জাতীয় স্বার্থ আর অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করে। গত কয়েক বছরে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা ছড়িয়েছে, উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের যৌথ সামরিক মহড়া নিয়ে; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের বৈঠককে কেন্দ্র করেও। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরের একক নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে দিতে নারাজ। ফলে তাইওয়ান প্রশ্নে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে আছে দুই দেশ। তাই বিশ্ব রাজনীতির অনেক বিজ্ঞজন "নতুন স্নায়ুযুদ্ধে পলিসি ফুটবলে পরিণত হয়েছে তাইওয়ান" বলে মন্তব্য করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের জটিল সমীকরণ: গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১অকাস চুক্তি যা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নতুন চুক্তি - একুশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বিন্দু হিসেবে দেখা হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগাভাগি করে চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই বিশেষ নিরাপত্তা চুক্তিটি চীনের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পকের নতুন একটি মাত্রা যুক্ত করেএই অঞ্চলকে এক জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপের সঙ্গে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৭২ সালের রিচার্ড নিক্সনের চীন সফর বা ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতনের পূর্বাপর তুলনীয় হতে পারে। এই প্রতিটি ঘটনাই গোটা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিল। চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ অস্ট্রেলিয়াকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর এই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা অস্ট্রেলিয়ার নৌবহরে যোগ করছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। অস্ট্রেলিয়া নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতেও সই করেনি। ফলে এমন কোনো অস্ত্র যদি তাদের নৌবহরে যুক্ত হয়, তবে কোনো চুক্তিই ভঙ্গ হবে না। এই চুক্তি পুরো অঞ্চলে এক নয়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণ হবে নিশ্চিতভাবে। কারণ, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল যে, তারা চীনের সঙ্গে দ্বৈরথে দক্ষিণ চীন সাগরকেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করছে। এদিকে এই অঞ্চলের দেশগুলো এই সাগরকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবেই দেখতে চায়। তারা এখানে কোনো বহিঃশক্তির প্রবেশ দেখতে চায় না। ক্ষতি হয়েছে দুই দেশেরই: চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উভয় দেশই। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর দুই দেশের বাণিজ্য কমেছে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এ দ্বন্দ্বের ফলে লাভবান হয়েছে অন্য দেশগুলো। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড)-এর প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধে চীনের ক্ষতি হলেও লাভবান হয়েছে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, মেক্সিকোর মত দেশগুলো। চীনা পণ্যে শুল্ক বসানোর ফলে অন্য দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়েছেন মার্কিন আমদানিকারকরা। চীনের হারানো বাণিজ্যের প্রায় ৬৩ শতাংশই কব্জা করেছে এসব দেশগুলো। বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জেতে না: বৈশ্বিকভাবে প্রায় সবাই একমত যে, বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ ‘জেতে’ না। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জয়ী না হলেও সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় সাধারণ ক্রেতা, যারা সংখ্যায় অনেকগুণ । দেশ দুটি একে অপরের পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর করে চলেছে । বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে পারেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে যেতে পারেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে, তার পরও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। চীনের অভিযোগ, বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।’এ অভিযোগ অসত্য নয়। বাংলদেশের সম্ভাবনা: চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধে লাভবান হতে পারে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ। চীনে তৈরী পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক এড়াতে দেশটি থেকে আমদানি কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকবে। ফলে চীনের হারানো বাজার ধরার সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশ ও উল্লিখিত দেশগুলোতে। আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ফলে বেসবল ক্যাপ, ব্যাগ, মোটরসাইকেলের মতো চীনা পণ্য আমেরিকানদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্য, যেমন- ওয়াশিংমেশিন, ডিশ ওয়াশার, হেয়ার ড্রায়ার, ওয়াটার ফিল্টার ইত্যাদির ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বাড়তি শুল্ক। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর চীন ছাড়ার প্রবণতা অবশ্য শুল্ক আরোপের আগেই শুরু হয়েছিল। কারণ চীনের সস্তা শ্রমের সুবিধা নিতেই তারা সে দেশে কারখানা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমবাজার আর সস্তা নেই। বরং চীনের চেয়ে অনেক কম খরচে পাশের দেশগুলো থেকে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ কারণেই ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরী পোশাক রফতানি ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দ্রুত প্রয়োজনীয় বৈদেশিক বিনিয়োগ আর বৃহৎ পাশ্চাত্য বাজারে আরো বেশি অনুপ্রবেশ একটি সহজতর বিষয়ে পরিণত হবে। তাই আমাদের দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নিতে হবে। লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, আমরা ৯৯ শতাংশ (আপহোল্ড ৯৯) ।
এই বিভাগের আরো সংবাদ