বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কিছু স্মৃতি, কিছু উপলব্ধি
ইনাম আহমেদ চৌধুরী
১০ জানুয়ারি ২০২২, ১১:১৭ | অনলাইন সংস্করণ
জাতির জীবনে কখনোবা এমন দিন আসে, যার তাত্পর্য শাব্দিক অর্থেই হয়ে ওঠে সীমাহীন। বাঙালি জাতির জীবনেও ১০ জানুয়ারি এমনই এক অন্তহীন জ্যোতি বিকীর্ণমান দিন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা সূচিত হয়েছিল বটে। তবে বাঙালির জাতিসত্তা প্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপূর্ণতা এল যেদিন জাতির জীবনে ফিরে এলেন সেই মহানায়ক—মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা যিনি করেছিলেন, আর সংগ্রামকালীন চেতনা, উদ্দীপনা ও ঐক্যবোধের উৎস হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধজয়কে সম্ভব করে তুলেছিলেন। আমার পরম সৌভাগ্য ছিল একাত্তরের ১০ জানুয়ারি দিল্লি ও ঢাকা উভয় স্থানে উপস্থিত থেকে জাতির পিতার সেই মহাআগমন প্রত্যাশা করার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। সেদিনের প্রতিটি ক্ষণের স্মৃতি আমার মনে জীবন্ত হয়ে বেঁচে রয়েছে, আজীবন থাকবে।
তবে সেদিনের বর্ণনায় এর পূর্ববর্তী কয়েকটি দিনের কিছু ঘটনার বিবরণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
এটা ঠিক যে স্বাধীনতা যুদ্ধ আমরা জিতেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু স্বাধীন সরকারের কার্যক্রম তখনই শুরু হতে পারেনি। পূর্ববর্তী পাকিস্তান প্রশাসনের অবশিষ্টাংশ নিজ গতিতেই চলমান ছিল। অবিশ্বাস্য কিন্তু অরাজকতার চিহ্নমাত্র ছিল না। সব কাঠামোই পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে আপন কর্তব্য সাধনে ব্যাপৃত ছিল।
দৃশ্যমান প্রথম পরিবর্তন লক্ষণীয় হলো যেদিন মুজিবনগরে কর্তব্যরত উচ্চতর কর্মকর্তাদের প্রথম ব্যাচ ঢাকা এল। রুহুল কুদ্দুস (মহাসচিব), আবুল ফতেহ, এমএ সামাদ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, এইচটি ইমাম, এমএ খালেক, আনোয়ারুল হক খান প্রমুখ হেলিকপ্টারে এলেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন বিকালেই সচিবালয়ের সম্মেলন কক্ষে রুহুল কুদ্দুসের সভাপতিত্বে হলো ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সভা। অবশ্য এর একদিন আগে ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর ভোরবেলা এসেছিলেন প্রশাসন সচিব নূরুল কাদের। খবর পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফারুক চৌধুরী (বড় ভাই) তাকে এয়ারপোর্ট থেকে ধানমন্ডির আমাদের পৈত্রিক বাড়ি সুরমায় নিয়ে এলেন। ওখানে আমিও ছিলাম। নূরুল কাদের ও আমি চাকরিতে সমসাময়িক এবং বন্ধুও বটে। সে বলল, রুহুল কুদ্দুস সাহেব সহযোগী হেলিকপ্টারে কর্মকর্তাসহকারে আসবেন এবং বিকালেই সচিবালয়ে সভা করবেন। বিবেচনা করে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো এবং সভার উদ্যোগের জন্যই তার অগ্রিম আগমন।
তার অনুরোধে আমিও কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানালাম। ঢাকায় তদানীন্তন ডিসি আহমদ ফরিদকেও নূরুল কাদের এ অনুরোধ জানান। সেদিন সভায় বেশ কয়টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। একটি ছিল আপাতত সপ্তাহে সাতদিনই ৯-৫টা (দ্বিপ্রহরকালীন ১ ঘণ্টা বিরতিসহ) অফিস হবে। সে সভায় উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা এসএম হাসান (প্রাক্তন আইসিএস, সিএসজি) রাজস্ব বোর্ডের সদস্য। তিনি অবাঙালি ছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতিসম্পন্ন বলে তার পরিচিতি ছিল। একাত্তরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় সিএসপি অ্যাসোসিয়েশনের তারই সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা এবং প্রশাসনিক কাঠামোর উচিত হবে আইন ও রীতিসম্মতভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে সরকার গঠনের দায়িত্ব প্রত্যর্পণের কাজে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান। তারই স্বাক্ষরিত সিদ্ধান্তের অনুলিপি মার্শাল ল প্রধান, গভর্নর ও বঙ্গবন্ধু সমীপে পাঠানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এতে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। যা হোক, এ সভায় পরিচিতি জ্ঞাপন পর্ব-উত্তরকালে জনাব হাসান নতুন সরকারের প্রতি তার আনুগত্য জানিয়ে বিদায় নিলেন এবং বলে গেলেন, প্রয়োজনবোধে তিনি সহযোগিতা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছেন।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন এলেন রাজনৈতিক নেতারা। বিকাল ৫টায় তারা এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন—প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখ। বিমানবন্দরে তুমুল হর্ষধ্বনি এবং উৎসবমুখর জনতা তাদের বরণ করে নিলেও একটি বিষাদের রেশ ছিল বিশেষভাবে উপস্থিত। মহানায়কের অবর্তমানে বিজয়ের অনুভূতি যে কিছুতেই পূর্ণতা পাচ্ছে না।
পুরনো গভর্নর হাউজকে বঙ্গভবন আখ্যায়িত করে সেখানেই নতুন সরকারের কেন্দ্রস্থল। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেখানেই বসবাস শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমও সেখানেই শুরু। ২৪ ডিসেম্বর এলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী। প্রধানমন্ত্রী, যিনি অর্থ মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন, একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, কারেন্সির নাম হবে টাকা। নতুন মূল্যমান নির্ধারিত হলো এবং স্বর্ণ বেচাকেনা অবিলম্বে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো। মনে আছে, সে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব রুহুল কুদ্দুস, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন, তদানীন্তন অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, বাণিজ্য সচিব নূরুল ইসলাম ও যুগ্ম সচিব আমি। কেবিনেট সচিব এইচটি ইমাম এলে প্রধানমন্ত্রী তাকে সিদ্ধান্তগুলো পাঠানো হবে জানালে চলে গেলেন। বিভিন্ন খাতের এসেনশিয়াল সাপ্লাইস নিয়েও কিছু সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দিলেন। সম্ভবত ব্যাংকার হামিদ উল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো এবং ২৯ ডিসেম্বর হলো দায়িত্ব পুনর্বণ্টন। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ এবং খন্দকার মোশতাক পেলেন আইন, সংসদবিষয়ক ও ভূমি-রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব। ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন যে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি, রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি ত্বরান্বিত করা, কিছু জরুরি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের জন্য এবং কোনো কোনো বিপর্যস্ত অবকাঠামো জরুরি ভিত্তিতে পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা-মানসে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধি দল দিল্লিতে পাঠাবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে এ দলের অন্য সদস্যরা হলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন, রাষ্ট্রাচারপ্রধান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ফারুক চৌধুরী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরী অর্থাৎ আমি। সাময়িকভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়েও আমি তখন কর্মরত।
কলকাতা হয়ে আমরা দিল্লিতে পৌঁছলাম ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং, প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য সুখময় চক্রবর্তী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা পালাম বিমানবন্দরে প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানালেন। সরদার শরণ সিং তার গাড়িতে করেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজাদকে হোটেলে পৌঁছে দিলেন। রাষ্ট্রাধীন অশোক হোটেলে আমরা সবাই অবস্থান করলাম।
পরদিন ৬ জানুয়ারি আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে ডেলিগেশন প্রথমে রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বিদেশমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পরম উষ্ণতায় অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তিলাভের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার এবং বিপর্যস্ত জনগণের জন্য যথাসম্ভব সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদানে তারা প্রস্তুত। আমাদের প্রতিনিধি দলের অভীষ্ট সাধনে সাফল্যের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা জানালেন। সৌজন্য সাক্ষাত্গুলোর পর জনাব আজাদের নেতৃত্বে নয়াদিল্লির নর্থ ব্লকে ভারতীয় ডেলিগেশনের সঙ্গে মিলিত হলেন। নেতৃত্বে ছিলেন মন্ত্রিপর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সেলের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বিশ্বস্ত ডিপি ধর। দ্রুত কর্তব্য-কর্ম সমাধার জন্য আমরা দুটো গ্রুপে বিভক্ত হলাম।
প্রথমটি হলো মুখ্যত বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তির আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার এবং বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণে সমন্বিত কার্যক্রমের ব্যাপারে আলোচনা। দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশে জরুরি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ক্রয়-বিক্রয়ের পদ্ধতি এবং বিপর্যস্ত কোনো কোনো সেক্টরের আশু পুনর্বাসনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আমি ছিলাম দ্বিতীয় কমিটিতে। সাউথ ব্লকে আমাদের আলোচনা হয় মুখ্যত বাণিজ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী এলএন মিশ্র, ভারতীয় যোজনা কমিশনের সদস্য ড. সুখময় চক্রবর্তী, যুগ্ম বাণিজ্য সচিব রঘুপতির সঙ্গে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কর্মকর্তা কেপিএস মেনন ও মনি দীক্ষিত প্রথম কমিটিতে এবং মনিশংকর আয়ার দ্বিতীয় কমিটিতে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। আমার অক্সফোর্ড জীবনের পুরনো বন্ধু মনটেক সিং আহলুওয়ালিয়াও (প্ল্যানিং কমিশন অথবা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে ঠিক মনে নেই) দ্বিতীয় কমিটির আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বস্তুতপক্ষে মনিশংকর আয়ার (যার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে উষ্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়) ও আমি একসঙ্গে কাজ করে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তুতি নিই। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় বিদেশমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশ ডেলিগেশনের অভ্যর্থনার জন্য একটি যথেষ্ট বড় ভোজসভার আয়োজন করেন। সেখানে যখন জনাব আজাদ ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামসহ কিছু অতিথির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আলাপরত তখন মন্ত্রী জগজীবন রাম অকস্মাৎ অদূরে দণ্ডায়মান একজন অতিথিকে আহ্বান করে নিয়ে এলেন। আজাদ সাহেবকে বললেন, ইনিই আমাদের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ। অতিরিক্ত বিশেষ কোনো বাগাড়ম্বর নেই।
পরদিন ৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাক্ষাৎ করলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী চ্যভন, কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলি আহমদ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, শিল্পোন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে। কমিটি দুটো কর্মরত থাকল। মনে পড়ে, বিকালে মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এলেন হোটেলে আজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। শিলচরের মন্ত্রী চৌধুরীর সঙ্গে আজাদ সাহেবের সম্ভবত ছাত্রকালীন পরিচিতি ছিল। আমরাও তার কথা জানতাম। আরো কয়েকজন সুহূদ এলেন। বেশ আন্তরিক খোলামেলা অনানুষ্ঠানিক আলাপ-গল্প হলো। সবাই বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তিলাভের জন্য উদগ্রীব।
৮ জানুয়ারি যখন আমাদের আলোচনা চলছে, বিদেশ মন্ত্রকের মনি দীক্ষিত অত্যন্ত উদ্দীপিত ও উত্তেজিতভাবে এসে নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করলেন যে খবর জানার জন্য জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেছেন এবং এ মুহূর্তে তিনি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের (পিআইএ) একটি বিশেষ ফ্লাইটে লন্ডনের পথে উড্ডীয়মান। তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালি। এটাও জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে এবং দিল্লিতে তার অভ্যর্থনার ব্যাপারে ভাবনা ও আলোচনা শুরু করেছেন। আমাদের আনন্দানুভূতি বর্ণনার অতীত।
আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই সমাপ্ত হলো। ৯ জানুয়ারি প্রকাশ হলো সমাপনী ইশতেহার, যার প্রতিটি শব্দ উভয় পক্ষ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সংযোজন করেছিল। দুটি অনুচ্ছেদের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। ১৩ অনুচ্ছেদে বিবৃত ছিল:
দুই সরকারই পুনর্বার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করছে যে বাংলাদেশের মুক্তির উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগদানকারী ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার চাওয়ামাত্রই বাংলাদেশের সীমানা অন্তর্বর্তী এলাকা থেকে অপসারণ করা হবে।
আরেকটি অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ছিল: উভয় দেশের ক্রয়-বিক্রয়ে পণ্যমূল্য আন্তর্জাতিক হারে নির্ধারিত হবে। তবে ভৌগোলিক নৈকট্যজনিত কারণে পরিবহন খরচের আকাঙ্ক্ষিত হ্রাসপ্রাপ্তি সামগ্রিক মূল্য নির্ধারণে বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। উভয় সরকার যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, যোগাযোগ উন্নয়ন ও বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন মানসে আলোচনায় ব্যাপৃত হবে।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও হাঙ্গেরির সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য চুক্তি অদূরভবিষ্যতেই সম্পাদন হয়েছিল। পূর্ব জার্মানির সঙ্গে আলোচনাভিত্তিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক যাত্রী ও জরুরি বাণিজ্যিক দ্রব্যাদি পরিবহনের জন্য ‘ইন্টার-ফ্লুগ’ এয়ারলাইনস সার্ভিস (বার্লিন-ঢাকা-হ্যানয়) চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭২ সালের মার্চেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে অপসারিত হয়।
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান দিল্লির পালাম এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। সেটি একটি অবর্ণনীয় অনুভূতির মুহূর্ত। প্লেনের দ্বার খুলে গেল। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ধূসর স্যুট ও কালো ওভারকোট পরিহিত সুদর্শন, ঋজু, দীর্ঘকায়, সহাস্য শেখ মুজিবুর রহমান। রক্তস্নাত সংগ্রাম ও সীমাহীন ত্যাগে প্রতিষ্ঠিত এক নতুন রাষ্ট্রের জন্মদাতা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বাঙালির জাতিসত্তা, বদলে দিয়েছেন এশিয়ার মানচিত্র। হাত তুলে স্বাগতিক জনগোষ্ঠীকে অভিবাদন জানিয়ে উচ্চকণ্ঠে মহানায়ক বলে উঠলেন, ‘জয় বাংলা’।
চারদিকে স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি। ধ্বনিত হলো ২১ বার তোপধ্বনি। স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা, কূটনীতিকরা, সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা, সাংবাদিকসহ বহু গণ্যমান্য লোক।
ব্র্যাশব্যান্ডে গীত হলো বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত—একই বাঙালি কবি রচিত। গার্ড অব অনার পরিদর্শন শেষে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে তার সংক্ষিপ্ত আবেগময়ী আনুষ্ঠানিক ভাষণ দিলেন।
তিনি বললেন, ‘ভারত ও ভারতবাসীকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। আমার এ যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।’ দেশবাসীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ত্যাগ স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন ছিনিয়ে নেয়া হলো, তারা কেঁদেছিল, আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনেই তো হলো আমাদের বিজয়ের পরিপূর্ণতা। তিনি আরো বললেন, ‘তার এ জয়যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিত্ব থেকে স্বাধীনতার, নিরাশ থেকে আশার। সংগ্রামের এ কয়েক মাসেই আমার মানুষ শতাব্দী অতিক্রম করেছে।’ এ বিজয়কে শান্তি, প্রগতি ও উন্নতির পথে চালিত করতে তার ফিরে আসা। অবশেষে জয় হয়েছে অসত্যের ওপর সত্যের, উন্মাদনার ওপর সুস্থ মানসিকতার, কাপুরুষতার ওপর বীরোচিত আচরণের, অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের এবং অনিষ্টের ওপর মঙ্গলের। আনুষ্ঠানিক এ ইংরেজি ভাষণের খসড়া লিখেছিলেন ফারুক চৌধুরী।
বিমানবন্দর থেকে মোটর মিছিল করে যাওয়া হলো অদূরবর্তী একটি বিরাট জনসভায়। হিন্দিতে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শুরু করলেন। বাংলায়। পকেটেই রয়ে গেল তার ইংরেজি ভাষণ। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধুর কিন্তু সুচিন্তিত ভাষণ। প্রায়ই করতালি। খণ্ডে খণ্ডে হিন্দিতে তরজমা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও ভারতবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা, জীবনদান ও ত্যাগের জন্য তিনি আবার সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালেন। স্মরণ করলেন বাঙালি জনগণের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং অগণিত শহীদানের কথা। বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, সবার সঙ্গেই মিত্রতা, কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই এ নতুন দেশের। কারো বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ-বিদ্বেষ নেই। তিনি একটি শান্তিপূর্ণ সংঘাত-বিবর্জিত দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্নের কথা বললেন—পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে জাতির ও আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে বিশ্বকে শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে হবে সহায়ক।
বিরাট এ জনসভা শেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমভিব্যাহারে বঙ্গবন্ধু মোটর মিছিলেই গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। তোরণ শোভিত পথের পাশে হর্ষোত্ফুল্ল জনতার জয়ধ্বনি। রাষ্ট্রপতি গিরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর একান্ত বৈঠক হলো। সম্ভবত আলোচনা চলাকালীনই ভারতীয় রাষ্ট্রাচারপ্রধান মাহবুব খান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বললেন, হিজ এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্রমণসূচির বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। তার ইচ্ছানুযায়ীই তিনি ভারতীয় প্লেনে নয়; যে ব্রিটিশ প্লেনে তিনি এসেছেন, সে প্লেনেই তিনি ঢাকা যাবেন। ভারতীয় প্লেন রাজহংসে স্থানান্তরিত তার ও তার সফরসঙ্গীদের ব্যাগেজ ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ওই প্লেনে। আর তিনি সরাসরিই ঢাকায় যাবেন। পথিমধ্যে কলকাতায় নেমে যে এক গণভাষণ দেয়ার প্রোগ্রাম ছিল, তা বাতিল হয়েছে। পরে জানা গেল বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের অত্যন্ত সংগত কারণগুলো। তার বক্তব্য, যে প্লেনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করেছেন, তা মাঝপথে পরিবর্তন শিষ্টাচারসম্মত হবে না।
ঢাকায় ব্রিটিশ প্লেন অবতরণ করতে পারবে কিনা এ সংশয় অমূলক বলেই বঙ্গবন্ধুর ধারণা। ‘তারা কি না জেনেশুনেই আমাকে ওই প্লেনে উঠিয়েছেন?’ তার প্রশ্ন। তবু তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধান (সিপি) ফারুক চৌধুরীকে ডেকে তার অনুমান নিশ্চিতকরণের কথা বললেন। দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্সকে ফোন করতেই তিনি জানালেন, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকার এয়ারপোর্টের বর্তমান অবস্থা যাচাই করার পরই তাদের প্লেন নির্ধারিত হয়েছে। সঠিকভাবেই বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, কলকাতায় জনসভার জন্য যাত্রাবিরতি হলে তিনি সূর্যালোকে ঢাকায় হয়তো পৌঁছতে পারবেন না। আলোকস্নাত ঢাকায়ই তিনি তার প্রিয় দেশবাসীকে দেখতে চান, কথা বলতে চান। যথার্থ। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাবাসী বাংলাদেশের গৃহত্যাগী জনগণকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতা ও সম্প্রীতির মনোভাব দেখিয়েছে, তার জন্য তিনি বিশেষ করে কলকাতায় গিয়েই তার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানালেন যে বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফরের সময় তিনিও কলকাতায় আসবেন। আর তিনিও অদূরভবিষ্যতে সম্ভবত আগামী মার্চেই বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ঢাকা সফরের প্রত্যাশী। বঙ্গবন্ধু বললেন, ঢাকা তাকে স্বাগত জানানোর জন্য উন্মুখ থাকবে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য ঢাকা সফরের আগেই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবই কার্যকর করা হয়েছিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব, কূটনীতির শিষ্টাচারজ্ঞান, দেশপ্রেম, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মসম্মানবোধ ও তাত্ক্ষণিকভাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অসাধারণ ক্ষমতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল।
পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজাদ, রাষ্ট্রাচারপ্রধান ফারুক চৌধুরী ও লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসা ড. কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেন, বন্ধু জনাব মাওলা ও সাংবাদিক আতাউস সামাদ একই প্লেনে বঙ্গবন্ধুর সহগামী হলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কিছু জরুরি কাগজ আগেই পৌঁছানোর জন্য অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও আমি একটি ভারতীয় এয়ারফোর্সের প্লেনে বঙ্গবন্ধুর প্লেন অবতরণের ঘণ্টাখানেক আগে এসেই ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাগজগুলো পৌঁছে দিলাম এবং তারই জন্য সম্ভব হলো ঢাকার বিরাট জনসমুদ্রে মহানায়কের প্রত্যাগমনের সেই ঐতিহাসিক শুভক্ষণটি প্রত্যক্ষ করার। ওই মুহূর্তেই পরিপূর্ণতা পেল স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পরম বিজয়। প্রথমবারের মতো উদ্বেগাকুল প্রতীক্ষারত ঢাকা স্বাগত জানায় জাতির জনককে, বাঙালি জাতিসত্তার স্রষ্টাকেও, যিনি চার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক রাজধানীকে রূপান্তর করলেন এক নবীন স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে। আর তারই সৃষ্ট রাজধানীতে বিজয়রথে এলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : সাবেক সচিব ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
(সংগৃহিত)
এই বিভাগের আরো সংবাদ