আজকের শিরোনাম :

দীর্ঘ পথের সমাপ্তি স্বস্তিতে

  আবদুল মান্নান

২৮ নভেম্বর ২০২১, ১২:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

অনেক দিন হয়ে গেল তেমন কোনো ভালো খবর দিয়ে দিন শুরু হয় না। প্রায়ই শুনতে হয় আপনজনদের মৃত্যু সংবাদ বা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর। এই করোনাকালে নিজের চারদিকে শুধু কেমন যেন এক শূন্যতা। ঠিক এমন একটা সময় যখন পার করছি তখন গত বৃহস্পতিবার ভোরে একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিল, আগের দিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ছাড়পত্র। এই দিন বাংলাদেশ ছাড়াও এই ছাড়পত্র পেল নেপাল ও লাওস কম্বোডিয়া। সাধারণ পরিষদ এই ছাড়পত্র দিয়েছে বুধবার শেষ বিকেলে। সময়ের ব্যবধানে এই সুসংবাদটি বাংলাদেশে পৌঁছেছে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের বেশ পরে। দেশ যখন তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষ পালন করছে, তখন এই সংবাদটির চেয়ে আর ভালো কিছু হতে পারে না। ঠিক এই মন্তব্যটি করেছেন জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতেমা।

জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশের ছাড়পত্র পেতে বাংলাদেশের বেশ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। একদিন বাংলাদেশ এমন একটি স্থানে পৌঁছাবে সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আজীবন সংগ্রামী, বাঙালির এই বন্ধু সব সময় স্বপ্ন দেখতেন বাঙালির বাংলাদেশ হবে শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত, স্বয়ংসম্পূর্ণ, অসাম্প্রদায়িক, অগ্রসরমাণ ও নিরক্ষরতামুক্ত। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি লড়াই করেছেন ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৩ বছরের বাঙালির দাবি আদায় করে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকদের চরম শত্রু হতে হয়েছিল তাঁকে। বাঙালির স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে আর আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটেছেন ১৩ বছর, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কমপক্ষে দুবার। তবে তিনি হাল ছাড়েননি, লড়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাঙালি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। পরের মাসের ১০ তারিখ বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে ঢাকা ফিরলেন। ১২ জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা (প্রথমটি ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে গঠিত যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা)। বঙ্গবন্ধুর একটি বড় গুণ ছিল তিনি কাকে দিয়ে কী কাজ হবে তা বুঝতে পারতেন। সেই মতে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভা ও প্রশাসন সাজিয়েছিলেন। তার পরও তাতে কিছু নষ্ট লোক যে ঢুকে পড়েনি তা বলা যাবে না। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেশটাকে যখন তিনি নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করাতে দিন-রাত পরিশ্রম করছেন, তখন কিছু বিদেশি সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চাইলেন তিনি কিভাবে এই সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে আবার দাঁড় করাবেন। তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার মাটি আর মানুষ আছে। তাদের সহায়তায় আমি আবার দেশটাকে দাঁড় করাব।’ তার পরও বিশ্বের অনেক নামিদামি অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক সন্দেহ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একটি উন্নয়নের পরীক্ষাগার। সঠিক অর্থে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকলে যেকোনো দেশ টিকে থাকবে।’ আর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারের বহুল আলোচিত ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’ (বাস্কেট কেইস)।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করেছে, তখন যারা এই স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি তারা একটি ষড়যন্ত্রের মাধম্যে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘ ৩০ বছর বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে। জেনারেল জিয়া একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের শুধু পুনর্বাসিতই করেননি, তাঁদের নানাভাবে পুরস্কৃতও করেন।

১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হলে একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। তিনি তাঁর পূর্বসূরি জিয়ার সব কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রটিকে কাগজে-কলমে সাম্প্রদায়িক বানিয়ে ফেললেন। এরশাদ পতনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এলেন খালেদা জিয়া। মনে করা হচ্ছিল তিনি দেশটাকে আবার পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন। তা ছিল অনেকটা কল্পনাবিলাস। কারণ তিনি ক্ষমতায় আসতে সহায়তা নিয়েছিলেন একাত্তরের ঘাতকদল জামায়াতে ইসলামীকে। তাঁর শাসনামল পূর্ববর্তী দুই শাসনামল থেকে কোনো ধরনের ভিন্ন হলো না। একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সফল হলেন না। ক্ষমতায় এলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। চেষ্টা করলেন দেশটাকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে। কিন্তু অনেকটা প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে তা তেমন একটা সম্ভব হয়নি। এই মেয়াদে তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন করতে। ২০০১ সালে আরেকটি নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসাটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় ধরনের ছন্দঃপতন। এই মেয়াদে তাঁর মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন একাত্তরের ঘাতকদের কয়েকজন। বর্তমানে তাঁর পলাতক পুত্র তারেক রহমান হয়ে উঠলেন দুর্নীতির বরপুত্র। চালু করলেন তাঁর মায়ের সঙ্গে একটি সমান্তরাল প্রশাসন। চেষ্টা করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করতে। তাঁর দুর্বৃত্তপনা সব অতীত রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছিল।

২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে শেখ হাসিনার হাত ধরে শুরু হলো বাংলাদেশের নতুন করে পথচলা। গত ১২ বছর তিনি পর পর তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এখন শুধু বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রীই নন, বিশ্বস্বীকৃত একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর আমলেই বদলে গেছে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু রিলিফের চাল-গম খেয়ে, সেই দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যাত্রার শুরুতে বাংলাদেশে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, সেই বাংলাদেশ কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কাকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। ৫০ বছর আগে এই দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের কম, আর বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৫০ ডলারে। বাংলাদেশে উন্নয়নের চিত্র এখন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত, আর তা বলছে জাতিসংঘ আর বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে বিএনপিসহ কিছু স্বঘোষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সর্বদা বলে বেড়ান উন্নয়নের নামে দেশে মহাদুর্নীতি হচ্ছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই দেশের প্রশাসনের একটি অংশ, কিছু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ দুর্নীতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তবে আগের আমলের দুর্নীতিবাজদের মতো তাঁরা সহজে ছাড় পান না। তাঁদের আইনের আওতায় আনা হয়। এমনকি একজন সাবেক বিচারপতিকেও রেহাই দেওয়া হয়নি।

করোনার কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দুটি দেশকে ২০২৬ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হতে প্রয়োজনীয় সব সূচক পূরণ করার জন্য। আশা করা যায় বাংলাদেশ তার আগেই সব কিছু পূরণ করে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। এরই মধ্যে সরকার রূপকল্প ২০২১-২০৪১ প্রস্তুত করেছে। ২০৪১ সাল বাংলাদেশের জন্য আরেকটি মাইলফলক। সব কিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে উঠে যাবে। তবে তার জন্য কাজ করার আছে অনেক। থাকতে হবে শেখ হাসিনার মতো দূরদর্শী নেতৃত্ব আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সর্বক্ষেত্রে দায়িত্ব দিতে হবে উপযুক্ত ব্যক্তিদের। দুর্নীতিকে বিদায় জানাতে হবে। তা না হলে ২০৪১ সালের মাইলফলকে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার বেশির ভাগ কৃতিত্ব বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। (সংগৃহীত)

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ