আজকের শিরোনাম :

সকল জঙ্গিবাদী চরমপন্থি কিন্তু সকল চরমপন্থিই জঙ্গিবাদী নয়

  মোশাররফ হোসেন মুসা

২৩ অক্টোবর ২০২১, ১৩:৩২ | অনলাইন সংস্করণ

মোশাররফ হোসেন মুসা
পশ্চিমারা সবরকম চরমপন্থাকে বোঝাতে এক্সট্রিমিস্ট  (Extremist) শব্দটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। তবে সেখানে ধর্মীয় উগ্রপন্থাকে বোঝাতে মাঝে-মধ্যে মিলিট্যান্ট (Militant) ও  রেজিমেন্ট (Regiment) শব্দসমূহ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বর্তমানে তারা ইসলামি উগ্রপন্থাকে বোঝাতে রাজনৈতিক ইসলাম (Political Islam) বাক্যটিও ঘন ঘন ব্যবহার করছেন। এদেশের মানুষেরা  বহু আগে থেকেই ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের ‘জঙ্গিবাদী’ এবং উগ্র বামপন্থিদের ‘চরমপন্থি’ নামে অভিহিত করে আসছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এদেশের মূল্যায়নই যথার্থ।

ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুরু থেকেই অহিংসপন্থি ও সহিংসপন্থি নামে দুটি ধারা বিদ্যমান ছিল। অহিংসবাদীরা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলতেন-‘ভারতে বহু জাতির বাস এবং ভারতের মানুষ উদারমনা হওয়ায় বিভিন্ন মতাদর্শের লোকেরা এখানে জায়গা পেয়েছে। সেজন্য অহিংস কর্মসূচীর মাধ্যমেই বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে হবে।’ এর বিপরীতে সহিংসবাদীরা বলতেন-‘বিদেশীরা এদেশকে বার বার দখল করেছে অস্ত্রের জোরে। তাই তাদের তাড়াতে হবে অস্ত্রের মাধ্যমেই'’। সহিংসবাদীরা যুগান্তর ও অনুশীলন পার্টি গঠন করে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে (এ দুটি দল ছাড়াও সে সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু রকম সন্ত্রাসী দলের অস্তিত্ব ছিল)। বৃটিশ সরকার তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে। সে সময়কার পত্র-পত্রিকা ও সুশীল সমাজের কাছে তাদের পরিচয় ছিল ‘চরমপন্থি’। চরমপন্থায় বিশ্বাসীদের কেউ কেউ পরবর্তীতে চরমপন্থা ত্যাগ করে সন্যাসব্রত জীবন বেছে নেন এবং কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন। যেমন, অরবিন্দ ঘোষ প্রথম জীবনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে কারাভোগ করেন। পরে জেল থেকে বের হয়ে আধ্যাত্মিকতায় মনোযোগী হন এবং হিন্দু ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। পাকিস্তান আমলে উগ্র বামপন্থিদের ‘চরমপন্থি’ নামেই ডাকা হতো। এখনও এদেশের মানুষ উগ্র বামপন্থিদের ‘চরমপন্থি’ নামেই চিনে থাকে। অর্থাৎ চরমপন্থি শব্দটি দিয়ে এমন এক গোষ্ঠিকে বোঝানো হয় যারা সর্বশেষ পন্থায় পৌছানোর আগে অন্যান্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থাগুলো পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু জঙ্গিবাদে সে সুযোগ নেই। সেখানে মত ও পথ অভিন্ন। সেখানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তিই গ্রহণীয় নয়। 

যতদূর জানা যায়, ‘জঙ্গনামা’ থেকে ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি এসেছে। ফারসি ‘জঙ্গ’ শব্দের অর্থ যুদ্ধ। ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সময় সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনার উপর রচিত কাব্যনামাই হলো ‘জঙ্গনামা’। এখানে মধ্যযুগের দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘জঙ্গনামা’, শেরবাজের ‘কাসিমের লড়াই ও ফাতিমার সুরতনামা’ প্রভৃতি কাব্য সমূহের নাম উলে­খ করা যেতে পারে (এ বিষয়ে বাংলা পিডিয়ায় খন্দকার মুজাম্মিল হকের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ আছে)। জঙ্গনামার বৈশিষ্ট্য হলো এতে শুধু যুদ্ধের বর্ণনা থাকে। লেখক ইচ্ছে করে সেখানে কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে ট্রাজিডি সৃষ্টি করতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধুর নাম উলে­খ করা যেতে পারে। তিনি কারবালার বিয়োগাত্মক কাহিনী নিয়ে বিষাদ-সিন্ধু রচনা করলে ধর্মান্ধরা তাঁর বিরুদ্ধে নানারকম ফতোয়া দেন। অনেকে আশুরার দিনে শিয়াপন্থিদের আহাজারিকে ট্রাজিডির সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে করুণ সুর উদ্রেকের চেয়ে নিজেদের প্রতি নিষ্ঠুরতা  প্রদর্শনই বেশি থাকে। যেসব কাব্য-গল্প-উপন্যাস ও ওয়াজ-মাহফিলে যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি থাকে জঙ্গিবাদীরা সেসবকেই শুধু সহিহ্ মনে করে। একই কারণে তারা সুফিবাদের অহিংসবাদী কর্মকাণ্ডকে (এমনকি তাবলীগ জামায়াতের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকেও) বিভ্রান্তকারী মতাদর্শ হিসেবে দেখে থাকে। 

বর্তমান জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বে সভ্যতার সংকট নিয়ে এসেছে। খ্রীষ্টান যাজকরাও এক সময় জঙ্গিবাদের ন্যায় উগ্রপন্থায়  বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা রেঁনেসার হাত ধরে যাবতীয় উগ্রপন্থা ত্যাগ করেন। তাঁদের রেঁনেসার মুলে ছিল ক্ষমা করা, ভুল স্বীকার করা, যুক্তিবাদী হওয়া এবং আত্মশুদ্ধি লাভ করা। আরবী ‘জেহাদ’ শব্দটির অর্থ কঠোর পরিশ্রম করা, চেষ্টা করা, সাধনা করা, সংগ্রাম করা ইত্যাদি। কিন্তু  জঙ্গিবাদীরা ‘জেহাদ’ শব্দটি ধর্মযুদ্ধের পক্ষে ব্যবহার করছে। অথচ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রচার জীবনে জেহাদ শব্দটি ‘আত্মার মঙ্গলের জন্য পরিশ্রম’ বা সৎকাজ করার অর্থে ব্যবহার করতেন। জঙ্গিবাদের উত্থান দেখে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশাধিকার বন্ধের দাবী করেছিলেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট বলেছেন-‘বেশিরভাগ মুসলিম সন্ত্রাসবাদকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করে, তবে অনেকেই নাস্তিক বা বিধর্মীদের হত্যার বিষয়টিকে ন্যায্য বা জায়েজ প্রমাণ করতে ইচ্ছুক’ (যুগান্তর,১০ ডিসেম্বর’১৫)। 

এর আগে বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছেন- ‘ইসলাম ধর্মের দর্শনের মধ্যেই উগ্রতার বীজ লুকায়িত রয়েছে’। কিন্তু জঙ্গিবাদীদের জন্ম  কিভাবে ঘটছে, কারা তাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে সেগুলো এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। তারপরেও তাদের অভিযোগগুলো মিথ্যা প্রমাণীত করতে হলে আমাদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যেমনিভাবে ভারতের আলেমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মতামত দেওয়া শুরু করেছেন। পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, ভারতের উত্তর প্রদেশে আয়োজিত একটি ওরস থেকে প্রায় ৭০ হাজার আলেম সারা বিশ্বের জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন (প্র.আলো,১৩ ডিসেম্বর’১৫)। এদেশেও স্বল্পসংখ্যক আলেম উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যগুলো সরকারের আয়োজিত সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা মসজিদগুলোকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিণত করে প্রমাণ করতে পারি মসজিদগুলো শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য নয়, এই পবিত্র ঘরগুলো মানুষের  বিভিন্ন  ইহলৌকিক সমস্যার সমাধান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। বর্তমান সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ নির্মাণ করছে। সেসব মসজিদে ( বিশেষ করে জুম্মার দিনে) আগত মুসুল্লিরা ইমামের কাছে মন খুলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যাসহ নানাবিধ ইহলৌকিক সমস্যার কথা বলবেন। তার আগে মডেল মসজিদের পার্শ্বে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঠাগার, বিশ্রামাগার নির্মাণসহ নারী-পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক টয়লেট স্থাপন করতে হবে। সেসঙ্গে আমাদের আলেম ও ইমাম সাহেবরা সম্পুর্ন রাজনৈতিকমুক্ত থেকে অনুচ্চস্বরে ও মিষ্টভাষায় আমাদের ধর্মীয় বাণীগুলো প্রচার করবেন। এরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে প্রস্তাবিত ও নির্মাণাধীন মডেল মসজিদগুলো সত্যিকার 'মডেল' মসজিদে পরিণত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ