আজকের শিরোনাম :

মহালয়া ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

  দেবাশীষ দেবু

০৬ অক্টোবর ২০২১, ১৩:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ

তখন আশ্বিনেই শীত পড়ে যেত। আর সকালগুলো ছিল কুয়াশাময়। এমন শীত শীত ভোরে ঘুম আরও গাঢ় হয়ে আসে।

তবু আরামের ঘুম ভেঙে বাবার ডাকে বিছানা থেকে উঠে আসতে হতো। এরপর ঢুলুঢুলু চোখ আর চরম বিরক্তি নিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে বসে থাকা রেডিওর সামনে। এই সাতসকালে পরিবারের সবাই রেডিও ঘিরে বসা। নারীদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে ফুল আর বেলপাতা।

রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক জায়গায় গিয়ে থামতেন বাবা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই স্টেশন থেকে ভেসে আসত একটি দরাজ কণ্ঠ।

প্রতি মহালয়ার ভোরেই এই ছিল রুটিন, ভোরে উঠে রেডিওতে সেই কণ্ঠ শোনা।

এই কণ্ঠে ভর করেই আমাদের শৈশবে দেবী দুর্গা আসতেন। পূজার ঢাকে কাঠি পড়ত। শুরু হতো ক্ষণগণনা।

মহালয়া মানেই ছিল সেই সম্মোহনী কণ্ঠে ভেসে আসা-

“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির;

ধরণির বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;

প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।

আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।

তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।

আজ চিৎ-শক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।”

পরে, অনেক বড় হয়ে জানা গেছে দরাজ কণ্ঠের সেই লোকটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। রেডিওর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই যিনি হয়ে উঠেছেন অনেকটা মহালয়ারই সমার্থক।

বাণী কুমারের রচনায় ও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে আকাশবাণী রেডিওর এই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ১৯৩২ সালে দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর ভোরে প্রথমবার প্রচারিত হয় বেতারের এই কালজয়ী অনুষ্ঠান।

তখন নাকি বেতারে রেকর্ডিং করার সুযোগ ছিল না। সব অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। যারা মহিষাসুরমর্দিনীতে অংশ নিতেন তারা আগের রাতেই রেডিও অফিসে চলে আসতেন। রাতভর চলত মহড়া। আর ভোরে অনুষ্ঠান শুরুর আগে স্নান করে গরদের ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে চণ্ডিপাঠে বসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

যার চণ্ডীপাঠ ভক্তিরসে ভাসিয়ে দেয় আবালবৃদ্ধবণিতাকে, পুণ্যকর্ম ভেবে মহালয়ার ভোরে যার কণ্ঠ শুনতেন সকলে, তিনি কিন্তু সেই অর্থে তেমন ধার্মিক ছিলেন না। বাবার ধর্মচর্চা সম্পর্কে বীরেন্দ্রকষ্ণের মেয়ে সুজাতা দেবীর মন্তব্য- ‘বাবাকে কখনও ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতে দেখিনি।’

 

যে ভাঙা-ভাঙা স্বরের কারণে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠ হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র, সেটি নাকি হয়েছে অসুখের কারণে। ছেলেবেলায় ডিপথেরিয়া হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের। চিকিৎসকরা সে যাত্রায় তাকে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও বদলে যায় কণ্ঠস্বর। এই ‘নষ্ট’ হওয়া স্বরই তাকে এনে দিয়েছে অমরত্ব।

প্রথম জীবনে ভাঙা স্বরের কারণে রেডিওর অডিশনে অকৃতকার্য হন বীরেন্দ্র। আবার এই কণ্ঠস্বরের কারণেই কিছুদিন পর রেডিওতে ডাক পড়ে তার। একটা রাক্ষস চরিত্রের জন্য এমন একটা কণ্ঠস্বরই খুঁজছিলেন পরিচালক। রাক্ষসরূপে রেডিওতে প্রবেশ করা এই লোকটি পরবর্তী সময়ে ঢুকে পড়েন বাঙালির, বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের মনোজগতেও।

১৯৭৬ সালে একটি হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যায় কলকাতায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তখন বৃদ্ধ। উত্তমকুমার তখন মহাতারকা। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি নতুনভাবে রেকর্ডের। ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’ নামের সেই অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বদলে মহানায়ক উত্তমকুমারের কণ্ঠ ব্যবহার করা হয়। ৭৬-এর মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বদলে ভেসে আসে উত্তমকুমারের কণ্ঠ।

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা উত্তমকুমারের কারণে এই অনুষ্ঠান আরও জনপ্রিয়তা ও ভিন্নমাত্রা পাবে বলে আশা করেছিল রেডিও কর্তৃপক্ষ, কিন্তু অনুষ্ঠান প্রচারের পর দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। প্রিয় কণ্ঠ শুনতে না পেরে খেপে গেল কলকাতার মানুষ। ক্ষোভে মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। ব্যাপক বিক্ষোভ হয় কলকাতা শহরে। ভাঙচুর করা হয় আকাশবাণীর কার্যালয়।

মানুষের ক্ষোভের মুখে সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করতে বাধ্য হয় রেডিও কর্তৃপক্ষ।

এই কাহিনি নিয়ে ‘মহালয়া’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন পশ্চিমবঙ্গের পরিচালক সৌমিক সেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রযোজিত ছবিটি ২০১৯ সালে মুক্তি পায়। এতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শুভাশীষ মুখোপাধ্যায় আর উত্তমকুমারের ভূমিকায় ছিলেন যীশু সেনগুপ্ত।

তাকে সরিয়ে উত্তমকুমারকে দিয়ে এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন: ‘হাজার হোক, আমি তো অমর নই। একদিন না-একদিন ওদের তো কাজে নামতেই হবে।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কথায় বিনয় প্রকাশ পেলেও তার নাতি সায়ন ভদ্র পরবর্তীকালে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দাদু সেদিন আঘাত পেয়েছিলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে।’

একবার বাংলাদেশে এসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেখেন, এখানকার মুসলমান শ্রোতারাও তার মহিষাসুরমর্দিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এতে বিস্মিত বীরেন্দ্র বলেন, ‘আমি কায়েতের ছেলে হয়ে মাতৃবন্দনার সুযোগ পেয়েছি। আর ওই অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজান খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী এরা। এর থেকে সম্প্রীতির পূজার্চনা আর কী হতে পারে!’

জীবৎকালেই অমরত্ব পেয়েছিলেন। তবু শেষ জীবনটা তার কেটেছে দারিদ্র্য আর জরায়। ১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে মারা যান এই কণ্ঠের জাদুকর।

তবে জাদুকরী কণ্ঠের কারণে এখনও তিনি থেকে গেছেন বাঙালির স্মৃতিতে। রেডিওর যুগ ফুরিয়েছে। তবু ইউটিউবের কল্যাণে এখনও মহালয়ায় বেজে ওঠে তার কণ্ঠ।

 

(সংগৃহিত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ