আজকের শিরোনাম :

করোনায় শিক্ষা ও স্বরলিকা’র সংসার যাত্রা

  ফাহমিদা হক

৩০ জুলাই ২০২১, ১৩:৪২ | আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২১, ১৩:৪৫ | অনলাইন সংস্করণ

ফাহমিদা হক
গত বছর ১৭ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয় করোনার কারণে।  তারপর থেকে ১৫ মাস ধরে বন্ধ প্রতিষ্ঠানে সীমিতভাবে যে অনলাইনে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে তাতেও নানান প্রতিবন্ধকতা। বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা হয়নি।  সীমিত সিলেবাসে এসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্যায়ন হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পেয়েছে অটোপাস। এবার আবার অটোপাস বন্ধ করে সীমিত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়াও সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিতে পারছে না। এমন কি ভর্তি পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি।কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষা নিলেও সব প্রতিষ্ঠানে এমন পদ্ধতি বাস্তবায়িত করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারী সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আছেন চরম হতাশায়। তাদের একদিকে যেমন সেশনজটের ভয় অন্যদিকে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার ভয়। এই বয়সে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। সঙ্গী নির্বাচনে উদ্যেগী হয়। জীবনের এই ধাপকে বলা হয় নিজেকে আবিস্কার এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়। সেলফ ডিফাইনডিং পিরিয়ডের এই সময়টাই পরবর্তী জীবন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে। কিন্তু করোনার কারণে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের কোনকিছুই ঠিক মতো হচ্ছেনা, সবকিছু থমকে থাকলেও বয়স কিন্তু চলে যাচ্ছে। এই হতাশা থেকে কেউ মানসিক অসুখে ভুগছে, কেউ নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ আবার আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলছে। ডিজিটাল এই শিক্ষাব্যবস্থা ধনী দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলেছে। গ্রামের শিশুরা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মোবাইল, টেলিফোন, ইন্টারনেট সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় বা অ্যাক্সেস করতে না পারায় তারা দূরশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে না। গত বছর ব্র্যাকের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের বাইরে থেকে গেছে।  অর্ধেকের বেশী শিক্ষার্থী যে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত সেই শিক্ষা কেবল বৈষম্য সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।  

ইউনিসেফের এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, করোনা মহামারীর এই সময়ে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর প্রতি তিন জনে একজন অর্থাৎ সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সংঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।  দীর্ঘদিন  স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার কারণে অনেকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পুরো দেশে বাল্য বিবাহ বেড়ে গেছে। অনেকের হয়তো স্বরলিকার কথা মনে আছে। ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবলে হ্যাটট্রিক কন্যা নামে খ্যাতি পাওয়া স্বরলিকা টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতেছিল। সেই স্বরলিকা মহামারী করোনার কারণে বাল্য বিবাহের শিকার। স্বরলিকা একা নয় তার মতো বহু শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে বই খাতা ছেড়ে সংসারের গ্লানি টানতে ব্যস্ত এখন। অনেক শিশু স্কুল না থাকার কারণে, পরিবারকে আর্থিক কাজে সহায়তা করার জন্যে নানা রকম কাজে যুক্ত হচ্ছে। এইসব শিশুরা আর হয়তো কোনদিন স্কুলে ফিরে আসবে না। শুধু বাংলাদেশের এই অবস্থা না। সেভ দ্যা চিলড্রেনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারী করোনার কারণে বিশ্বের ৯৭ লাখ শিশুর আর হয়তো স্কুলে ফেরাই হবে না। আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তির অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যেই শিক্ষা ঘরে বসে পুরোপুরি কোনভাবেই সম্ভব নয় কারো পক্ষে। কোন পরিবার যেই শিক্ষা দিতে পারে না নানান সীমাবদ্ধতার কারণে, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশুকে সেই শিক্ষা দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ তৈরী করে তুলে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত শিক্ষায় কোনরকম বৈষম্য থাকে না।মৌলিক অধিকারের জায়গাটিতে সকল শিক্ষার্থী সমান সুযোগ নিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমান করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ডিজিটাল এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই সুবিধা সবাই সমান ভাবে পাচ্ছে না। ফলে মেধার যাচাই ও ঠিকমতো হচ্ছে না।                                                   

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী সঠিক শিক্ষা গ্রহণ এবং তাদের সমবয়সীদের সাথে আলাপচারিতার সুযোগটি হাতছাড়া করছে; যা তাদের শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে। স্কুলবন্ধের খারাপ প্রভাব মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্যে বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, রেডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছিল; তবে সব শিক্ষার্থীর এই প্লাটফরমগুলোতে অ্যাক্সেস না থাকায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি এবং এই প্লাটফরমে তাদের অ্যাক্সেস কম ছিল। জরিপ করা স্কুল শিশুদের ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী যথাক্রমে ৫০ শতাংশের কম রেডিও, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনের অ্যাক্সেস পেয়েছে। যদিও প্রায় সবারই মোবাইল ফোনের অ্যাক্সেস রয়েছে তবে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নেই। এই সমীক্ষায় ধনী দরিদ্র পরিবারের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন পাওয়া গেছে। ধনী পরিবারের সাথে তুলনা করা হলে, সবচেয়ে দরিদ্রতমদের মধ্যে ৯.২ শতাংশ টেলিভিশন অ্যাক্সেস পেয়েছে। পক্ষান্তরে সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে অ্যাক্সেস পেয়েছে ৯১ শতাংশ। এছাড়াও অন্য আর একটি জরিপে বলা হয়েছে, অনলাইন লার্নিং প্রোগ্রাম গুলোতে অ্যাক্সেস থাকা ২১ শতাংশ পরিবারের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পরিবার এর সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে শিক্ষার্থীদের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, কত শিক্ষার্থী পড়ালেখার বাইরে চলে গেছে কিংবা আদৌ সব শিক্ষার্থীদের শ্রেনীকক্ষে ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বা সরকারের নেই। বেসরকারী কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হলেও তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে।

শিক্ষা ব্যবস্থার এমন মহাসংকটে সবার একটাই প্রশ্ন, অল্প পড়িয়ে উপরের ক্লাসে উঠিয়ে, অটো পাস দিয়ে, শিক্ষায় ডিজিটাল বৈষম্য রেখে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে সঠিক স্থানে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব? অভিজ্ঞজনদের  মতে, ক্ষতি কতটুকু হয়েছে তা পর্যালোচনা করে না বের করতে পারলে সংকট কাটানো সম্ভব না। করোনার কারণে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৈষম্য দূর করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যেমন-

(১) শেখার সব টুলসে সহজ অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা। দরিদ্রতম পরিবারগুলোর জন্যে ডিজিটাল লার্নিং একটি সম্ভাব্য বিকল্প নাও হতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে ফিজিক্যাল লার্নিং প্যাকেজ, মোবাইল ভিত্তিক পাঠ বা ফেস টু ফেস ক্লাস গুলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অন্যান্য পদ্ধতিতে করতে পারে।  
(২) কার্যকরী বিকল্প শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করতে ক্ষতির পরিমান চিহ্নিত করে, শিক্ষকগণ সঠিক স্তরে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থায় পাঠদান করতে পারে। 
(৩)শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট হ্রাস করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে উপবৃত্তি প্রদান করে, যোগাযোগের জন্যে সহজ শর্তে কোন বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলে দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে শিশুদের ফিরিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে ধরে রাখতে, অভিভাবকদের ও তাদের সন্তানদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে, তাদের সাথে নিয়মিত  যোগাযোগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 
(৪) মেকআপ ক্লাস বৃদ্ধি করেও এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারা যায়। রুটিন মাফিক পাঠের বাইরে, অথবা গ্যাপ আওয়ারে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের আরো বেশী সময় শেখার সুযোগ করে দিতে পারে। ফিলিপাইন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হারিয়ে যাওয়া সময়কে কাজে লাগাতে অতিরিক্ত ছুটির দিনগুলিকে কর্মঘন্টার সাথে যুক্ত করেছে। এতে বন্ধের দিনগুলোও কাজে লাগিয়ে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

উপরের সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন অতিরিক্ত লোকবল, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ।  ক্যাচআপ ও রিমেডিয়াল ধরণের প্রোগ্রামগুলো পরিচালনা করতে লোকবল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং বহুমাত্রিক কন্টেন্টস তৈরী করতে হবে যা শিক্ষন এবং প্রশিক্ষন কাজে বেশ সহায়তা করবে। মনে রাখতে হবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন আগামী প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলা। তা না হলে হলে বিশ্বায়ণের এই যুগে টিকে থাকাই কঠিন হবে।

লেখক: নিউ মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর, সিজিএস; পরিচালক, সিসিএন।

এই বিভাগের আরো সংবাদ