২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
অনির্বাণ শিক্ষা জন্মজয়ের সর্বক্ষেত্রে অবদান গর্ব ও গৌরবের
খন রঞ্জন রায়
১২ জুন ২০২১, ১২:২১ | অনলাইন সংস্করণ
বৃহস্পতিবার, গুরুবার, ২৩ জুন, ১৯৪৯ সাল। পুরান ঢাকার রোগ গার্ডেনে গুটিকয়েক নেতার উদ্যোগে এদিন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল স্বাধীন দেশে মুক্তিকামী দল আওয়ামী লীগ। ২০০ বছর পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ভগীরথী নদীর তীরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হয়েছিল এই ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে। ১৯২ বছর পর ঠিক একই দিনে মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দল। শূন্য থেকে ভাসানী-বঙ্গবন্ধুরা যা শুরু করেছিলেন প্রথমে ৫ কোটি, ৭ কোটি সবশেষ ১৮ কোটি মানুষ সেই শূন্যের ফলই ভোগ করছেন।
রোজ গার্ডেনে কয়েকজন নেতার সমন্বয়ে গড়া সেদিনের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ’; যার সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক হন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়টি সুখকর ছিল না। গ্রেপ্তার এড়াতে ভাসানীকে বোরকা ( কেউ বলেন কম্বল) পর্যন্ত পরানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ বলে রাখা ভাল যে, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগেই ’৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আত্মপ্রকাশের পরদিন ২৪ জুন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ ৭২ বছরে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনও বিরোধী দলে, কখনও সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৌশলপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশটাকে মজবুত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে এনে দাঁড় করিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি অনেক ষড়যন্ত্রের আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই সাথে দেশবাসীর প্রত্যাশা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী,’ থেকে জানা যায় সে সময়ের পরিস্থিতি ও গণমানসিকতা বিবেচনায় রেখে ‘মুসলিম’ শব্দটির যথার্থতা নিরূপণ করা হয়েছিল। পরে ১৯৫৩- তে কাউন্সিল সভায় প্রস্তাবিত হয়ে ১৯৫৫-র ২২ অক্টোবর ‘মুসলিম’ বাদ হয়ে যায়। একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। দলের এমন নাম বদলে বঙ্গবন্ধুসহ কিছু বামমনা সদস্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। দলীয় কর্মসূচি প্রণয়নে দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রচিত ‘মূলদাবী’ নামের পুস্তিকাটিকে বিবেচনায় নেয়া হয়; ক্রমান্বয়ে তা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তৃত হয়ে ৪২ দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়। দাবিগুলোর মৌল বিষয় ছিল দুটো- পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দলটির প্রথম কার্যালয় ছিল ১৮ কারকুনবাড়ী লেন; পরে চলে যায় ৯৪ নবাবপুর রোডে। বেশ ক’বার স্থানান্তরিত হয়ে দলটির বর্তমান স্থায়ী ঠিকানা ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।
গতবছর ২৩ শে জুন ২০২০ করোনায় ল-ভ- দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৭১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সংক্ষিপ্ত পর্ব আয়োজন করা হয়। অনলাইনে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা রাখেন। বক্তৃতায় তিনি আওয়ামী লীগকে হীরার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “হীরা যত কাটে, তত উজ্জ্বল হয়। জনগণের জন্য কাজ করে বলেই আওয়ামী লীগের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। তবু ৭১ বছর ধরে আওয়ামী লীগ টিকে আছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের শিকার দলটির অসংখ্য নেতাকর্মীর বলিদানেই দলটি শক্তিশালী হয়েছে।” শেখ হাসিনা আরো বলেন, “অর্জনের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ উজ্জ্বল। আওয়ামী লীগ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী এখন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ চলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের মানুষ অন্তত কিছু পায়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের গতিপথে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।”
১৯৭০ এর নির্বাচনের পর নানা চড়াই-উৎরাই, বাদ-অনুবাদ প্রতিক্ষা-তিতিক্ষা অতিক্রমের পর ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের ফসল- স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, “আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল নিপীড়ন রোধ করতে, শোষণ-বঞ্চনা-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে। আওয়ামী লীগই দেশকে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। গত পঞ্চাশ বছরে কৃষিখাতে নতুন নতুন জাতের ফলন শুরু হয়েছে। গতানুগতিক ধান, গম, আলু, ভুট্টা ছাড়াও ক্যাপসিকাম, ড্রাগন ফল কিংবা স্ট্রবেরির মতো নতুন কৃষিপণ্যের উৎপাদন শুরু হয়েছে। এই সমস্ত চাষে অনেক কৃষক যেমন লাভবান হয়েছেন, তেমনি কর্মসংস্থানও হয়েছে। উৎপাদন বাড়ায় দেশ এখন খাদ্যেও স্বয়ংসম্পূর্ণ।”
কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়েও স্বাধীনতার পরে ঘাটতি ছিলো ব্যাপক। সেই সময়ে দারিদ্র্য এবং ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে বিশ্ব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো দেশটি। বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করা হতো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে ৩টি শর্ত ছিল। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্তই পূরণ করে। ২০২১ সালেও ৩টি শর্তপূরণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেখিয়ে চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি আদায় করেছে। জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোন দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদ- পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ সেই সুপারিশ পেয়েছে। জাতিসংঘের ৩টি শর্তের প্রথমটি হচ্ছে, মাথাপিঁছু আয়। এরপর অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং সবশেষে মানবসম্পদ উন্নয়ন। মাথাপিঁছু আয়ে ন্যূনতম দরকার এক হাজার ২শ ৩০ ডলার। বাংলাদেশ সেখানে ২০২০ সালে মাথাপিঁছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। ২০১৮ সালে এসে তা মাত্র ২২ জনে নেমে আসে। ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রতি হাজারে ২১২ জন। ২০১৮ সালে তা প্রতি হাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বাস্তবতাও তাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সন্ধিক্ষণে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমরা আরো দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। দেশকে ‘উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ‘উন্নয়নশীল দেশ’- এই দুটি মাইলফলকে পৌঁছানো এবং টেকসই অবস্থান ধরে রাখতে কার্যকর মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে কাজ চলছে। সরকার সম্প্রতি অষ্টম বার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) প্রকাশ করেছে। এই পরিকল্পনা দলিলের সঙ্গে উল্লিখিত দুটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাইলফলক অর্জন করার অভীষ্ট লক্ষ্যে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল)-এর ১৭টি সূচকের বেশিরভাগই মানুষের কল্যাণ এবং মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত। মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার কয়েকটি দিকের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভবিষ্যতে বিভিন্ন খাত যেমন কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, প্রশাসন, সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, প্রযুক্তি খাতে কত লোকবলের চাহিদা হবে এবং তাদের শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণগত যোগ্যতা নিরূপণ করে কোন ধরনের শিক্ষা/প্রশিক্ষণ প্রয়োজন- যেমন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি ও উচ্চতর ইত্যাদি চূড়ান্ত করতে নির্দেশনা আছে। দেশের ভেতরে ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য কী ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এবং কত পরিমাণ লোক সেটা নিরূপণ করা। সুনির্দিষ্ট কোন ধরনের শিক্ষা/ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদের প্রয়োজন তাও নির্ধারণ করে কাজ এগুনোর শর্তারোপ করা আছে। এখানে মোটাদাগে মোট ১২টি ধরন উল্লেখ করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশাসক/ব্যবস্থাপক; মধ্যম ও কনিষ্ঠ পর্যায়ের প্রশাসক/ব্যবস্থাপক; সহকারী ও সাধারণ পর্যায়ের কর্মচারী; ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারী ও কর্মী; ইঞ্জিনিয়ার; কৃষি বিশেষজ্ঞ; কৃষি বিষয়ক সহকারী ও কারিগর; ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কিত সহকারী ও দক্ষ ব্যক্তি; কারিগর (ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভার, তাঁতি, ওয়েল্ডার, স্যানিটারি মিস্ত্রি ইত্যাদি); সাধারণ প্রশিক্ষণবিহীন কর্মী এবং সর্বশেষ শিক্ষক সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অধিক মনোযোগী হওয়ার বাধ্যবাদকতা রয়েছে।
মানসম্পদ পরিকল্পনা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়া প্রয়োজন। লোকবল ও তাদের সংখ্যা দীর্ঘ মেয়াদে আয়োজন করা একটু জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু মধ্য মেয়াদ ও স্বল্প মেয়াদে প্রক্ষেপণ দ্রুত সম্ভব হবে। এই দুটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, সময় সময় পর্যালোচনা এবং সেগুলোর পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপরেখা তৈরি করা কঠিন হবে না। সেটা হতে হবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সঠিক নেতৃত্ব পেলে তা যে দুরুহ না তা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। যে বাংলাদেশ একসময় খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেই বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য উদ্ধৃত্তের দেশ হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে বাংলাদেশ সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করে তাদের খাদ্য সহায়তা করেছে। নেপাল এখন নিয়মিত বাংলাদেশ থেকে সার আমদানি করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রিলিফের চাল বা গম না এলে অনেক বাড়িতে হাড়ি চড়ত না। এই সময় খাদ্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই বাংলাদেশ এখন সীমিত আকারে সংকটকালে তার প্রতিবেশীকে খাদ্য সহায়তা দিতে সক্ষম। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভারত সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ সেখানে খাদ্যসহ অন্য জিনিসপত্র পাঠিয়েছে। মালদ্বীপে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গিয়েছে। এর আগেও মালদ্বীপকে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় তাদের প্রয়োজনে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি পণ্যের চালানও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে গেছে। বাংলাদেশ তার একাধিক নৌবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে ভারতকে। কয়েকটি রেলপথ ও সড়কপথ খুলে দিয়েছে দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যোগাযোগ যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই দুই দেশের জন্য মঙ্গল । দুই পক্ষই লাভবান।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০-২০২১ সালে মুজিব বর্ষ এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছরব্যাপী দুঃসাহসিক দুঃসাধ্য নানাকর্ম সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত করে বাংলাদেশ গড়তে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্ব এখন প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে। সারাবিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমেই দ্রুততর হচ্ছে। সেই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক যাত্রা শুরু হয়। সারাদেশে মোট ৩৯টি পার্ক তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ উপযোগী হয়েছে সাতটি হাইটেক পার্ক। এর মধ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। করোনাকালে দেশে যখন বিনিয়োগের খরা চলছে, তখনো এসব হাইটেক পার্কে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে। শুধু বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে এ সময়ে বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে ৬৬১ কোটি টাকার। ওরিক্স বায়োটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হবে এই হাইটেক পার্কগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিকে প্রযুক্তি বিশ্বের রাজধানী বলা হয়। গুগল, আ্যাপল, ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, অ্যাডোব, নেটফ্রিক্স, ইন্টেল, এইচপি, ইউটিউবসহ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর এখানে । কিন্তু উচ্চ শুল্ক এবং আবাসন ও কার্যালয়ের খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেশি হওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন সিলিকন ভ্যালি ছাড়ছে বা অন্যত্র তাদের ব্যবসা স¤প্রসারণ করছে। অনেক বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চীন থেকেও তাদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। আমাদের হাইটেক হাইটেক পার্কগুলো নতুন গন্তব্য হতে পারে। বিদ্যুতে দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ । তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎসহ নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। হাইটেক পার্কগুলোতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। হাইটেক পার্কগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে সরকার বিশেষ প্রণোদনা সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০ বছর কর মওকুফ, পার্ক ডেভেলপারের জন্য ১২ বছর পর্যন্ত কর মওকুফ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ, প্রতিটি হাইটেক পার্ককে ওয়্যারহাউস স্টেশন হিসেবে বিবেচনা করাসহ নানা সুবিধা। ফলে হাইটেক পার্কে একটি প্লট পাওয়ার জন্য এখন রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে।
প্রযুক্তির চরম উন্নতির এ যুগে এই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার বিকল্প নেই। মানুষকে স্বনির্ভর হতে যেমন সাহায্য করে তেমনি ভূমিকা রাখে বেকারত্ব দূরীকরণেও। সেইসাথে এগিয়ে নেয় দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে । বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করে দেশকে। তাই আগামী দিনে প্রযুক্তি শিক্ষাই হবে শিক্ষার মূলধারা। এ কারণে সারাদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করতে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে বেশিরভাগ বেকার বা কম বেতনভোগী হিসাবে কাজ করে দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে। দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে অনেকে দেশে-বিদেশে অমানবিক অবস্থায় ও স্বল্প বেতনে কাজ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের ভারতীয় প্রতিপক্ষের তুলনায় দুইগুণ কম এবং শ্রীলংকার সহকর্মীদের চেয়ে তিনগুণ কম উপার্জন করে; দক্ষতা উত্তরণ ঘটাতে না পারার কারণে।
সুখের কথা আমরা যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করছি। এখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ছাড়াও ক্রীড়াঙ্গনসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অলিম্পিক আ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন এবং আ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর নামকরণে ‘বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমস’-সর্ববৃহৎ ক্রীড়া উৎসব ১ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছে। ৩১টি খেলায় অংশ নিয়েছে কয়েক হাজার পুরুষ-মহিলা খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ। এই গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১ থেকে ১০ এপ্রিল ২০২০ সময়ে। করোনাভাইরাসের জন্য ঠিক এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন রাজনীতি ও মানুষের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ছিলেন মনেপ্রাণে ক্রীড়াপিপাসু ও ক্রীড়া মানসিকতা বান্ধব একজন উদার হৃদয়ের মানুষ। খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। ক্রীড়াঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি ছিল তাঁর অন্য এক ধরনের আবেগ ও ভালোবাসা । তিনি ক্রীড়াঙ্গনের সব খোঁজ-খবর রাখতেন। তাঁর নামে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে উদযাপনের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক, যৌক্তিক ও অপরিহার্য। ক্রীড়াঙ্গন শুধু বিনোদন চত্বর নয়। এর গুরুত্ব ও মর্যাদা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির চরিত্রের প্রতিফলন ঘটানো হচ্ছে। খেলার বিজয় আনন্দে মিশে থাকে জাতিগত আত্মমর্যাদাবোধ আর অহং জাতিসত্তার গৌরবানুভূতি। মানুষকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বলেই ব্যক্তিমানুষের শক্তিমত্তাকে টেকসই পরিবর্তনে কাজে লাগাতে ক্রীড়াঙ্গনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সময়ের আগে।
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই সর্বক্ষেত্রে এগুচ্ছে দেশ। কভিড নিয়ন্ত্রণে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হয়েছে বিশ্বব্যাপী। করোনা টিকা নেওয়ার শুরুতে বিভ্রান্তি, বাংলাদেশে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ আমাদের রয়েছে ভ্যাকসিন নেওয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্য। অথচ কত কিছুই না হলো। কিন্তু জননেত্রীর দৃঢ় পদক্ষেপ সচেতন চিন্তার ফসল শেষ পর্যন্ত ভ্যাকসিন কেন্দ্রে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার। প্রথম যেদিন ভ্যাকসিনেশনের পাইলটিং করা হলো, সেদিন তিনি নিজে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থেকে সাহস জুগিয়েছেন, ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের সঙ্গে গোটা জাতিকে। তারপর মন্ত্রিসভার বৈঠক, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান, আনসার-ভিডিপির বার্ষিক কুচকাওয়াজ-সবখানেই তিনি আহ্বান জানিয়েছেন মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করার। বাংলাদেশে আগেভাগে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার অসামান্য কৃতিত্বও তাঁরই। অ্যাস্ট্রোজেনেকার কাছ থেকে টেক-ট্রান্সফারের মাধ্যমে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার উৎপাদিত কোভিশিল্ড বেছে নেওয়ার কারণেই ভ্যাকসিনের বেলায় আমাদের জোরালো সাফল্য। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এ যখন গণটিকাদান কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল, সেদিন পৃথিবীর ১৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় আড়াই শ কোটি মানুষ ভ্যাকসিনের প্রত্যাশায় গালে হাত দিয়ে অপেক্ষায় ছিল। যেসব দেশ আমাদের অনেক আগেই ভ্যাকসিনের আগাম মূল্য পরিশোধ করে বগল বাজাচ্ছিল কিংবা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টে, তাদের অবস্থাও কিন্তু খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিলনা। নিজ দেশের প্রতিজন নাগরিকের জন্য চার ডোজ করে আগাম ভ্যাকসিনের মুল্য পরিশোধ করেও কানাডা নিতে পেরেছিল অল্প কিছু ভ্যাকসিন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এসওএস বার্তা পাঠিয়েছিলেন ভারতে, নিজে ফোন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন কোভিশিল্ড নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এর আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন যেহেতু তার নিজের হাতে এই বিষয়টি নেই। তাই তার দেশের মানুষের ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন না। ইউরোপের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। আগাম টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন না পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানে উৎপাদিত ভ্যাকসিন রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মুজিববর্ষকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নানান চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে। এ উন্নয়নকে বেগবান ও টেকসই করতে দেশের প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদসহ সকলের ভূমিকা খুবই সুরক্ষিত হয়েছে। অধিকৃত বিশাল সমুদ্র এলাকার বৈচিত্র্যময় সম্পদ আহরণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা বহুল প্রত্যাশিত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী সমৃদ্ধিশালী উন্নত দেশ গড়তে সরকার বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হাইটেক পার্কের মতো মেগা প্রকল্প। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিঁছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে দেশ এখন দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু’র শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন, প্রযুক্তিমনস্ক জাতি গঠনে রাজনীতিতে প্রযুক্তি ভাবনা যুক্তকরণ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়সহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সরকার সামুদ্রিক অর্থনীতি বিকাশে ২৬টি কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে। এগুলো হল: শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্রবন্দর, ফেরীর মাধ্যমে যাত্রী সেবা, অ্যন্তরীণ জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প,' মৎস্য, সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন, মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনিজ সম্পদ (বালি, নুড়ি এবং অন্যান্য) সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, উপকূলীয় সুরা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা পরিকল্পনা। এইসব পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে হলে প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং শিক্ষিত মানবসম্পদ প্রয়োজন তা মাথায় রেখে দক্ষ প্রকৌশলী, নৌবাহিনী, প্রযুক্তিবিদ, মৎস্য প্রযুক্তিবিদ, জৈব প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞ মানুষদের হাত ধরে ব্লু-ইকোনমির সফলতা অর্জনে একযুগে কাজ চলছে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ সমুদ্র অর্থনীতি থেকে আসবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ছোট বড় প্রায় ৭৫টি দ্বীপ রয়েছে। এগুলোতে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। টেকসই উপকূলীয় পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে নানা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক ক্রীড়া বাইচ, বিনোদন জাহাজ ভ্রমণ ও গাইর্ডিংসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা নির্ভর করছে বিশ্বমানের সমন্বিত ব্যবসা মডেল খুঁজে বের করার সক্ষমতার ওপর। এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে। সাগরসম্পদকেন্দ্রিক যে অপার সম্ভাবনা, তার সুফল তুলে নিতে হলে বাংলাদেশকে সাগরসম্পদ অনুসন্ধানের জন্য প্রচুর বিনিয়োগের পাশাপাশি এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ, জীবিত ও জড় সম্পদের সংরক্ষণ, দূষণ রোধ, জলদস্যু দমন, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং মানবপাচাররোধসহ নানা পদক্ষেপ জোরালোভাবে নিতে হবে। নীল অর্থনীতিকেন্দ্রিক বিস্তৃত গবেষণা এবং অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরিতে দিতে হবে মনোযোগ। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি)'র ১৪ নং লক্ষ্যটি নীল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ লক্ষ্যটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সবগুলো অর্জন করা সম্ভব।
নীল অর্থনীতি কর্মকা- বাস্তবায়নে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে (ক) যথাযথ স্টাডির ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও সঠিক পরিকল্পনা; (খ) বিভিন্ন কর্মভিত্তিক দক্ষ জনবল; (গ) সমুদ্র সীমার সম্পদের পরিমাণ ও সম্পদের সঠিক মূল্যতথ্য; (ঘ) মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যে প্রয়োজন (১) অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, (২) প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল তৈরির জন্য বড় নদী ও সাগর তীরবর্তী এলাকায় ‘ওশনারি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, (৩) এক্সপ্লোরেশন বৃদ্ধি, (৪) গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন, (৬) ইতোমধ্যে স্থাপিত মেরিটাইম ইনস্টিটিউশন তথা নারায়ণগঞ্জস্থ মেরিন টেকনোলজি ও অন্য ৫টি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করা, (৬) সামুদ্রিক গবেষণা বৃদ্ধি, (৭) দেশে নীল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় জনবলসহ একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে সম্ভাবনাকে দ্রুত কাজে লাগানোর বাস্তবভিত্তিক জোরালো পদক্ষেপ নেয়া যায়।
১৭৫৭ সালের জুন মাস থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ২৬৪ বছরের ইতিহাস। আমাদের দেশটি দু’বার স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সময় কেটে যাচ্ছে স্বাধীনতা-পরাধীনতার পর্যালোচনায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ভ্রান্তনীতি প্রজন্মকে জ্ঞানচর্চাবিমুখ করছে। এতে অন্তহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সম্ভাবনার তরুণ সমাজ। অতীতের বাংলাদেশে যা হয়েছে, বর্তমানে যা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যা হবে; তার সবকিছুতেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের অবদান ছিল, আছে, থাকবে। বাংলাদেশ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে এবং আগামী দিন যেখানে যাবে- পুরো পরিকল্পনার রূপকার থাকবেন বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। দেশ, দশ ও বাঙালির প্রত্যেকটি অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে প্রাপ্তির সাথে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আমাদের নেত্রী নতুন লক্ষ্যমাত্রা এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন। আমরা আগামী ২০ বছরে ২০৪১ সালে হব একটি সুখী, শান্তিপ্রিয় সমৃদ্ধ দেশ যেখানে কোনো দারিদ্র্য থাকবে না। এই উচ্চবিলাসী ভিশন বাস্তবায়নে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্রের বিবেচনায় বন্দি না রেখে জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত মেধাবী প্রজন্মকে বেড়ে ওঠার পথ তৈরি করে দিতে হবে। পারবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পারবে জননেত্রী শেখ হাসিনা। তারাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলার মাটি ও মানুষ নিয়ে। দেশের সার্বিক কল্যাণ তাদের ছাড়া কল্পনাতীত। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দঘন এইদিনের দীপশিখা অনির্বান থাকুক। আলোকছটায় আলোকিত করুক দেশের ১৮ কোটি জনগণকে।
লেখক: সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক
এই বিভাগের আরো সংবাদ