আজকের শিরোনাম :

ছয় দফা: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অনন্য উপাখ্যান

  শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

০৭ জুন ২০২১, ১১:২৩ | আপডেট : ০৮ জুন ২০২১, ১৬:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি বাইবার অন্যতম মই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, ছয়দফা নামক ঐতিহাসিক সিঁড়ি বেয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। জাতির পিতার ছয় দফায় স্বাধীন বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির যে স্বপ্ন লুকায়িত ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে সেসব স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজকের বাংলাদেশ।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে এবং ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের ডাকে পূর্ব বাংলায় হরতাল চলাকালে পাকিস্তানি পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালায়। টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। প্রায় আটশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং হাজারো আন্দোলনরত সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর থেকেই ৭ জুন ‘ছয় দফা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ছয় দফার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে হলে শুরুতেই আসলে এর বিস্তারিত সম্পর্কে খানিকটা জানা প্রয়োজন। সেই সাথে ছয় দফার প্রয়োজন কেন হলো সেই পটভূমি নিয়েও একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আদায়ের সংগ্রাম বাঙালির মুখের ভাষার অধিকার তো নিশ্চিত করেছেই, এর পাশাপাশি চিরতরে এদেশের মানুষের মনে একটি বার্তা গেঁথে দিয়েছে যে, “তুমি এখনো স্বাধীন নও”। আর ঠিক এই মুহুর্ত থেকেই স্বাধীনতার জন্য তৃষিত বাঙালিদের সংগ্রামের শুরু। ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমান সবসময়ই একটি সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন। আর সেই স্বপ্নকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসতে তাঁর সহ-নেতাকর্মীদের মধ্যেও এই চেতনা সঞ্চার করেছেন। সেই ফলশ্রুতিতেই ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে লাহোর পৌঁছান। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয় দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। পরবর্তীতে, ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বাঙালিরা একটি আলাদা সার্বভৌম ও স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবার শুরু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।

ছয় দফায় প্রস্তাবিত দাবিগুলোর দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে পাঠকদের জন্য।

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে।

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে
পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে। এই দূরদর্শী ছয়টি দফার প্রত্যেকটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্বের মাপকাঠিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমকক্ষ করে তুলবার একেকটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই না। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক এই তিন ক্ষেত্রে নিজ ভূখন্ডের অভ্যন্তরে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়াই একটি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবার প্রথম নিশানা। এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রতিটি দফাই এমনভাবে নকশা করেছেন যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে স্বনির্ভর একটি নতুন রাষ্ট্রে পরিণত করে। অর্থাৎ, বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করাই ছিলো তাঁর সবসময়ের মূল ভাবনা।

ছয় দফার প্রথম দু’টি দাবি পুরোপুরিই রাজনৈতিক। লাহোর প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছিলো, “ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যে সকল অঞ্চলে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেট বা প্রদেশ) গঠন করতে হবে যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলি হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম”। অর্থাৎ, এর পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতকরণের দাবি ওঠানোর মানেই হচ্ছে, বাঙালীরা নিজেদের ভূখন্ডে নিজেদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের মূল রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাইছে। দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবন্ধু আবারো নিশ্চিত করেছেন লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী, ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যেন বৈদিশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত আর কোন ক্ষমতা না থাকে। এটি মূলত তৎকালীন পাকিস্তানকে ক্রমশ সামরিক শাসনের বলয় থেকে বের করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে আনয়নের একটি উদ্দেশ্য। জনগণের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস ন্যস্ত করবার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই শুরু থেকেই বদ্ধপরিকর ছিলেন, তা এই দুই দাবিতে স্পষ্ট হয় আরো।

অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব-পাকিস্তান নিগ্রহিত হয়ে আসছে ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর থেকেই। ধান, মশলা, চিনির মতো দেশের অভ্যন্তরের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ফসল তো এই ভূখন্ডে প্রচুর হতোই, সেই সাথে পাটের মতো অর্থকরী রপ্তানীযোগ্য পণ্যের মূল উৎপাদনস্থলও ছিলো এই বাংলা। কিন্তু, জাতীয় বাজেটে কখনোই এই অবদানের বিনিময়ে কিছু পায় নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। বিভিন্ন অর্থবছরে খাদ্যঘাটতিও ছিলো নিত্যদিনকার সমস্যা। তাই, জনমনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাহিদা ছিলো শুরু থেকেই। আর বঙ্গবন্ধু ৬ দফার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দাবি বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে আরো স্বনির্ভর করবার চেতনা থেকেই উৎপন্ন। তিনি এখানে দু’টি আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন; সেটা সম্ভব না হলে বলেছেন আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক তৈরি করতে। বৈদিশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজ্য যেন নিজের আয় নিজের রিজার্ভে রাখতে পারে সেই দাবি তোলেন তিনি। অর্থাৎ, কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের হাতে যেন বাংলার মানুষের পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ পাচার হতে না পারে তাই এই তিনটি দাবির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের দূরদর্শী স্বপ্ন তিনি তখন থেকেই দেখতেন।

সবশেষের দফায় তিনি সরাসরি সামরিক সার্বভৌমত্ত্ব দাবি করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীগুলোতে বাঙালি অফিসারদের পদোন্নতি দেয়া হতো না; বড় বড় মূল পদগুলোর একটিও পশ্চিম পাকিস্তানী ছাড়া অন্য কাউকে দেয়ার রেওয়াজই ছিলো না। বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো রাজ্যসরকারের হাতে অস্ত্র কারখানা তৈরি, নিজস্ব সামরিক বাহিনী প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দাবি করেছেন এই দফায়। সর্বোপরি, ছয় দফাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি স্বাধীকার আন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথম ড্রাফট হিসেবে মূল্যায়ণ করা যায়। কেননা, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে একের পর এক যা ঘটেছে ইতিহাসের পাতায় তাই বাংলাদেশকে স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কিংবা অন্য ভাবে বললে, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর মূল স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে। একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। ছয় দফা ঘোষণার পর তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং ন্যাপের প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ষড়যন্ত্র আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন, তার মূল কথাটি কী? ষড়যন্ত্র আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব, ষড়যন্ত্র আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম। ষড়যন্ত্র এই এক দফার ফলাফলই আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ