আজকের শিরোনাম :

করোনা সংক্রমণ, টিকা রাজনীতি ও বর্তমান বাস্তবতা

  ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন

০৫ মে ২০২১, ১০:১৬ | অনলাইন সংস্করণ

করোনার প্রথম ঢেউ সামলে উঠে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের জীবন যাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো যেমন মাস্ক পরিধান, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার বিষয়ে সরকার জনগণকে সচেতন হতে অনুরোধ করে।

করোনার এই ঢেউ মোকাবেলা করতে ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন এমনকি আমেরিকা, যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। এ অবস্থায় টিকার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে।

আমরা সকলেই জানি একটি টিকা আবিষ্কার হতে কমপক্ষে ১০-১৫ বছর সময় লাগে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এই বাস্তবতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে AZD1222 টিকাটি অনুমোদন দেয়, যেটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রস্তুত হয়। এই টিকাটি ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট তৈরি করে, যেটি কোভিশিল্ড নামে পরিচিত।

রাশিয়ার স্পুটনিক টিকার কার্যকরী সাফল্যের হার ৯১ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি, যেটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে প্রতীয়মান হয়।

ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বাংলাদেশ গত ৭ জানুয়ারি এই টিকাটি বাংলাদেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে এই টিকাটি বিতরণের সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করে। এই টিকাটি ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে প্রয়োগ করা শুরু করে।

টিকা হাতে পাওয়া এবং জনগণের মধ্যে প্রয়োগ শুরু করা বর্তমান সরকারের অবশ্যই একটি যুগান্তকারী সাফল্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রথম দিকে টিকা নিবন্ধনের সংখ্যা খুবই কম ছিল। রাজনৈতিক অপতৎপরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভারতীয় টিকা অপবাদ দিয়ে কিছু জনগণ টিকা গ্রহণে নিরুৎসাহিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে টিকা নেওয়ার আগ্রহ বাড়ে।

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায় জানা যায় যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ায় করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশ কমে যায়। এছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০০ টিকা গ্রহণকারীর উপর জরিপ চালিয়ে প্রমাণ পান যে, প্রথম ডোজ গ্রহণকারী করোনা আক্রান্ত হলেও তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকটাই কম ছিল।

সম্প্রতি ভারতে করোনা সংক্রমণ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৩০০০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৮৮ জন। (২ মে ২০২১, ঢাকা পোস্ট)।

সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সেরাম ইন্সটিটিউট তাদের প্রতিশ্রুত টিকার সংখ্যা (যার অর্থমূল্য পরিশোধিত) আমাদেরকে দিতে গড়িমসি করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার স্পুটনিক ও চীনের সিনোফার্মের টিকা দেশে উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেছে।

সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ডাবল মাস্ক পরিধান (সার্জিক্যাল মাস্ক ও তিনস্তরের কাপড়ের মাস্ক একত্রে পরিধান) করোনা সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রাশিয়ার স্পুটনিক টিকার কার্যকরী সাফল্যের হার ৯১ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি, যেটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে প্রতীয়মান হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় করোনা বিপর্যয়ে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার সম্প্রতি ভারতে করোনার উচ্চ সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করে। এছাড়াও গত তিন সপ্তাহ ধরে সরকার ঘোষিত লকডাউন বলবৎ রয়েছে। কিন্তু আইন করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এক্ষেত্রে দেশের জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।

ভারতে ডাবল মিউটেটেড ও ট্রিপল মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ভারত থেকে আগত যে দশ জন ব্যক্তি করোনা শনাক্ত হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল, তারা হাসপাতাল থেকে পালানোর পর তাদের আটক করে পুনরায় আইসোলেশন সেন্টারে রাখা হয়। কিন্তু তাদের মাধ্যমে যদি ডাবল বা ট্রিপল মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্ট দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সংক্রমণে মৃত্যু ঝুঁকি মোকাবেলা করতে বাংলাদেশ সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

বাংলাদেশের মতো কম সম্পদশালী রাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন অব্যাহত রাখা কঠিন। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে করোনা মোকাবেলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করছি—

১। সরকারের টিকা সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং দেশের অধিকাংশ জনগণকে টিকা গ্রহণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।

২। এন-৯৫ বা কেএন-৯৫ মাস্ক এর মূল্য বেশি যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এ পরিস্থিতিতে স্বল্পমূল্যে সার্জিক্যাল মাস্ক ও তিনস্তর বিশিষ্ট কাপড়ের মাস্ক (যা ধৌত করা যায়) ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করা। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ডাবল মাস্ক পরিধান (সার্জিক্যাল মাস্ক ও তিনস্তরের কাপড়ের মাস্ক একত্রে পরিধান) করোনা সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও যারা টিকা গ্রহণ করেছেন তাদেরকেও মাস্ক পরিধানে নির্দেশ প্রদান করা।

৩। সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালতে এক-তৃতীয়াংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর উপস্থিতির মাধ্যমে অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করা। ষাটোর্ধ্বদের কাজে যোগদান থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাসায় থেকে অফিস পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম নজরদারি আনা জরুরি।

৪। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করতে উদ্বুদ্ধ করা। এক্ষেত্রে বয়স্ক ব্যক্তিদের বাসায় থেকে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে নির্দেশ প্রদান করা।

সর্বোপরি, করোনা মোকাবেলা শুধু সরকারি ঘোষণা বা পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়। দেশের জনগণের আন্তরিক সদিচ্ছা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও সমন্বয় এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো সংবাদ