আজকের শিরোনাম :

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ: ইতিহাসের যুগল যাত্রা

  ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে

২৬ অক্টোবর ২০২০, ১২:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
'জাতির জনক' এবং 'বঙ্গবন্ধু'র মতো দুর্দান্ত উপাধি যুক্ত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সঙ্গে। এটা এমনি এমনি হয়নি, আর একদিনেই এসব বিশেষণ অর্জন করেননি তিনি। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রতিটি ধাপে অনন্য অবদানের কারণে এসব উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন শেখ মুজিব। এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, বঙ্গবন্ধু কেন দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন? এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হলো- বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত করাই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। তার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো গতিপথ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে বলা যায়, তার লড়াইটা মূলত ছিল বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকারের জন্য।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ছয় বোন এবং এক ভাইয়ের সঙ্গে আবহমান বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছেন শেখ মুজিব, সেসময় তিনি ছিলেন সবার আদরের খোকা। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৮ সালে তাকে বহিষ্কার করে। একই বছরে তিনি জেলেও গিয়েছিলেন দুবার। কারাগারে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা তাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অভিভাবক হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। তবে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো একটি অবস্থা থেকে ক্রমেই 'জাতির জনক' ও 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে ওঠার পথটি অতো সহজ ছিল না। উপাধিগুলো অর্জনের জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিভিন্ন পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা এবং স্বাধীনতার জন্য তার আজীবন সংগ্রামের বিষয়গুলো উপস্থাপন করা।

আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের শুরুর কথা

১৯৪৯ সালের জুন মাসে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে ১৯৫৪ সালের মধ্যে তিনি একজন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ততোদিনে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ রাজনীতির মধ্যমণিতে পরিণত হন এবং যুক্তফ্রন্ট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে ২২৭ আসনের মধ্যে ২২৩ আসনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে। আওয়ামী মুসলিম লীগ ২২৩টি আসনের মধ্যে ১৪৪ আসনে জয়ী হয়। একইসঙ্গে শেখ মুজিব নিজেও গোপালগঞ্জের নির্বাচনী এলাকা থেকে জয় লাভ করেন এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সংবিধানের ৯২-এ ধারার অধীনে নতুন এই মন্ত্রিসভাকে প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার করাচি থেকে ফেরার পথে শেখ মুজিবকে ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেফতার করে। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৫৫ সালে আবারও পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়গুলোতে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। এই ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের দাবি তোলেন তিনি। এদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সামনে রেখে তার দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি সরিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন শেখ মুজিব। তবে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের জন্য নিজেকে নিবেদিত করার মতো এমন ঘটনার নজির ইতিহাসে বিরল। ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর সামরিক আইন ঘোষণার পরপর আবারও বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার এবং তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৪ মাস কারাবাস শেষেছাড়া পাওয়ার পর তাকে ফের কারাগারের গেটে আটক করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে পাকিস্তান সরকার এভাবেই তাকে একাধিকবার জেলে পাঠায়।

আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন

১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। তিনি মূলত পূর্ববাংলার জনগণের স্বার্থে দলকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। ১৯৫৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব বিরোধী অবস্থান থেকে ফাতিমা জিন্নাহর সমর্থনে তিনি সারা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। তৃণমুলে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবশালী নেতৃত্বের শক্তিতে বিচলিত হয়ে নির্বাচনের মাত্র ১৪ দিনের আগে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। তবে হাইকোর্টের আদেশে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা।

ছয় দফা আন্দোলন

১৯৫৬ সালে ভারত-পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় পূর্বপাকিস্তানের মানুষের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পশ্চিমের অবহেলা আরও প্রকটভাবে ধরা পড়ে। অরক্ষিত এই ভূখণ্ডের পৃথক রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আলাদা মনোভাব পোষণ করতে বাধ্য করে তরুণ-যুবা ও রাজনীতিকদের। পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন শেখ মুজিব। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন বা রাষ্ট্রীয় অধিকারের দাবিগুলির একটি বিস্তৃত তালিকা ছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। ছয় দফা কর্মসূচির কয়েকটি মূল দাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল- পূর্ব পাকিস্থানের জন্য পৃথক মুদ্রা, স্বতন্ত্র বাণিজ্য নীতি এবং একটি পূর্ব পাকিস্তান মিলিশিয়া গঠন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন

১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিদ্রোহের আশঙ্কা করে আইয়ুব খানের সরকার। এসময় সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টার অভিযোগে শেখ মুজিব এবং তার ৩৪ জন সহযোগীর নামে মামলা দায়ের করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য) ৮ মার্চ ১৯৬৬ থেকে ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ শেখ মুজিবকে প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকতে হয়। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তে এবং আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ছাত্র আন্দোলনের চাপে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ জানুয়ারি শেখ মুজিব ও তার সহযোগীদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তি পাওয়ার পরে ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে ছাত্ররা তাকে স্বাগত জানায়। সেই সভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে মাঠের সর্বকোণ থেকে 'জয় বাংলা' উচ্চারণের মাধ্যমে তা অনুমোদিত হয়। সেদিন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান বৃহত্তর পরিসরে 'বঙ্গবন্ধু' নামে পরিচিতি লাভ করেন। এদিকে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে ওঠায় আইয়ুব খান পরবর্তী সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচন

ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ দিন পরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৩০ শে মার্চ তারিখে 'দ্যা লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও )' গ্রহণের মাধ্যমে একটি জাতীয় নির্বাচন এবং নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। নির্বাচন ঘোষণার পরে ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু একটি ভাষণ দেন, যা পরে রেডিও পাকিস্তান প্রচার করে। ভাষণে তিনি শুধু ফেডারেল পরিকল্পনাই উপস্থাপন করেননি বরং সংবিধান প্রণয়নের জন্য তাকে সমর্থন করতে পাকিস্তানি ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এসবের মধ্যেই, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলার উপকূলীয় জেলাগুলিতে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনও সরকারি সহায়তা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেন শেখ মুজিব। সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘূর্ণিঝড় থেকে বেঁচে যাওয়াদের সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। ব্যালটের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন অর্জনের প্রত্যাশা জানিয়ে সেদিন তার বক্তব্য শেষ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পরিস্থিতি যদি দাবি করে তবে তিনি বুলেট ব্যবহার করতেও পিছপা হবেন না। এই বক্তব্যের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু। সেই বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের দাবিদার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৪৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮৮টি-তে জেতে।

৭ই মার্চের ভাষণ

আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে দুটি দফার সঙ্গে ঐকমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় ভুট্টো ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ নবনির্বাচিত সংসদের নির্ধারিত প্রথম অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্তের কারণে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি শিক্ষার্থীরা ছয় দফা আন্দোলনের দাবি ছাড়িয়ে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও দেশবাসীর অব্যাহত আন্দোলনের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারা বদলে যায়। যেহেতু ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন যে, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসসদের অধিবেশন ডাকা হবে, তার এই ঘোষণার প্রতিবাদে সব অঞ্চল থেকে ব্যাপক বিদ্রোহ ও অসহযোগ অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, কর্মী-সমর্থক, শিক্ষার্থী এবং আপামর জনতা অব্যাহত সংগ্রামের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে তাদের নেতার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার প্রত্যাশা করছিল। এমন এক মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। লাখ লাখ জনতা 'জয় বাংলা' স্লােগানে বরণ করে নেয় তাদের নেতাকে। শেখ মুজিব সেদিন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, কারণ একটি অপরিণত সিদ্ধান্ত হয়তো অব্যাহত সংগ্রামের গতি নষ্ট করে দিতে পারতো। সেদিন যদিও কোনও লিখিত ভাষণ ছিল না, তবুও শেখ মুজিবের বক্তব্যে সম্ভাব্য সমস্ত বিবেচনাগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। দীপ্ত কণ্ঠে তিনি কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। রেসকোর্স ময়দানে তার কণ্ঠ এতটা বেপরোয়া ছিল যে, মানুষের মধ্যে এক ধরণের সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মানুষকে উৎসাহিত এবং প্রস্তুত করার জন্য বক্তব্যে তীব্র আবেগ প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তার বক্তৃতার শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে- আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র 'নিউজউইক' ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে 'রাজনীতির কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করে। ৭ মার্চের ভাষণের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধানের উপায় খুঁজতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছিল।

স্বাধীনতা ঘোষণা

দুর্ভাগ্যক্রমে, আলোচনার তাৎপর্যপূর্ণ ফল পাওয়া যায়নি। কারণ ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালানোর জন্য সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করতে কিছুটা সময় ব্যয় করার পরিকল্পনা হিসেবে আলোচনায় বসে। অবশেষে একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েক হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মূলত পূর্ববঙ্গের জনগণকে শোষণ করার জন্য এবং তাদের স্বাধীনতার অধিকারকে অস্বীকার করার কৌশল হিসাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের আগে রেডিওতে নিম্নলিখিত বার্তা প্রেরণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন:

'এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।'

বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলেও তার নির্দেশনা মেনে বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করেছিল।

স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রাম

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। জীবনে তিনি জেলকে দ্বিতীয় বাড়ি হিসাবে বিবেচনা করতেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে তিনি তার জীবনের সোনালী সময়ের একটা বড় অংশ কারাগারে কাটিয়েছেন। পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে তার আপোষহীন আচরণ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সাথে মাত্র কয়েক বছর অতিবাহিত করেছেন। তার স্যুটকেস সর্বদা সাজানো থাকতো, কারণ পুলিশ বা সেনাবাহিনী তাকে কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রায়ই প্রস্তুত থাকতো। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি শাসকরা যে কী পরিমাণ ভয় পেতো তা গভর্নর আব্দুল মোনেম খানের বক্তব্যের মাধ্যমে পরিষ্কার জানা যায়। আব্দুল মোনেম খান একবার বলেছিলেন যে- তিনি শেখ মুজিবকে দিনের আলো দেখতে দেবেন না।

দেশের মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির স্বার্থে প্রিয় স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকার বেদনাও হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকার তার কাছে ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান কয়েক পৃষ্ঠায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। অতএব, আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ক্ষুন্ন করে। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে আমাদের উচিত এই মহান ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।

 

লেখকঃ অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্রঃ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ওয়েবপেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ