বিবিসির প্রতিবেদন
প্রযুক্তির সাহায্যে যেভাবে মহাসাগরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার চেষ্টা চলছে

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:১২

বিশ্বের সমুদ্রগুলোতে প্লাস্টিকের যে দূষণ, তার সমাধানের জন্য বয়ান স্ল্যাট বহুদিন ধরে ‘এক দীর্ঘ এবং যন্ত্রণাদায়ক’ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি অলাভজনক পরিবেশ সংস্থা ‘দ্য ওশেন ক্লিন-আপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ২৮ বছরের এই ওলন্দাজ উদ্যোক্তা। প্রশান্ত মহাসাগর হতে প্লাস্টিক বর্জ্য কীভাবে ছেঁকে তোলা যায়, ১০ বছর ধরে সেই কাজে ব্যস্ত তিনি।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, যতটা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে কাজটা অনেক বেশি কঠিন বলেই তার মনে হচ্ছে।
‘আমাদের এই গ্রহটা তো আসলে অনেক বড়’, বলছিলেন তিনি।
‘আমাদের প্রায় এক হাজার নদী এবং সমুদ্রের পাঁচটি এলাকার বর্জ্য নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কাজেই প্রথম কয়েকটি বছর আমাদের কেটে গেছে কেবল সমস্যাটা উপলব্ধি করতে।’
বিশ্বে সমুদ্রের সবচেয়ে বিশাল যে জায়গাটি জুড়ে প্লাস্টিক দূষণ ঘটেছে, সেটিকে সাধারণত ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ’ বলে বর্ণনা করা হয়। এটির অবস্থান উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে। সেখানে বড় মাছ ধরার জালের ছেঁড়া অংশ থেকে শুরু করে ছোট প্লাস্টিকের কণা জমে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরাট সমস্যা তৈরি হয়েছে।
‘দ্য ওশেন ক্লিন-আপ’ টিম যেসব এলাকা প্লাস্টিকের দূষণ-মুক্ত করতে চাইছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
জাল পেতে প্লাস্টিক অপসারণ
ওশেন ক্লিন-আপ সাগর থেকে প্লাস্টিক অপসারণের জন্য একটি দীর্ঘ ‘ইউ’ আকৃতির প্রতিবন্ধক ব্যবহার করে, যেটি আসলে জালের মতো। নৌকা দিয়ে এই জালটি প্লাস্টিকের বর্জ্য জমেছে সাগরের যেসব এলাকায়, তার মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি টানা হয় খুব ধীরে ধীরে, যাতে সামুদ্রিক প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি না হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে পরিচালিত ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণ সাগর-পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা হয় প্লাস্টিকের বর্জ্যের সন্ধানে। এই ক্যামেরা আবার যুক্ত থাকে কম্পিউটারের সঙ্গে। ফলে ওশেন ক্লিন-আপ টিমের সদস্যরা বুঝতে পারেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এলাকাটিকে টার্গেট করতে হবে। ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচের দিকে নজর দিলে আপনি বুঝতে পারবেন, অনেক এলাকায় প্লাস্টিকের বর্জ্যের ঘনত্ব অনেক বেশি। আবার অনেক এলাকা আছে, যেখানে প্লাস্টিক নেই বললেই বলে’, বলছিলেন বয়ান স্ল্যাট।
‘প্লাস্টিক দূষণের এই বড় এলাকাগুলোতে যদি আমরা সর্বক্ষণ পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে পারতাম, তাহলে আমাদের অভিযানে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সাফল্য পেতাম।’
ওশেন ক্লিন-আপের প্লাস্টিক অপসারণের এই নতুন যন্ত্রটি প্রায় ৮০০ মিটার দীর্ঘ। তাদের তৈরি এটি এরকম দ্বিতীয় কোন যন্ত্র। সাগর থেকে প্লাস্টিক অপসারণের পর সেগুলো রিসাইক্লিংয়ের জন্য এই যন্ত্রকে মাঝেমধ্যে তীরে ফিরে যেতে হয়।
বয়ান বলেন, এই সিস্টেমের মাধ্যমে তারা এ পর্যন্ত সাগর হতে প্রায় দুই লাখ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক অপসারণ করেছেন।
কিন্তু বিশ্বের একটি মহাসাগরের সবচেয়ে বড় একটি প্লাস্টিক দূষণ এলাকা, যেখানে কি না ভাসছে ১০ কোটি কিলোগ্রাম প্লাস্টিক, সেখানে এই অপসারিত প্লাস্টিকের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ মাত্র।
কিন্তু বয়ান মনে করেন, তারপরও এই কাজের একটা মূল্য আছে, ‘সব বড় কাজই তো শুরু হয় ছোট কিছু দিয়ে, তাই না?’
ওশেন ক্লিন-আপ টিমের বিশ্বাস, তাদের যন্ত্র দিয়ে তারা এ বছরের শেষ নাগাদ সাগরের এই এলাকাটি হতে এক শতাংশ বর্জ্য অপসারণ করতে পারবেন। কিন্তু তারা তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াচ্ছেন যাতে কাজটি আরও দ্রুত করা যায়।
তারা এখন তৃতীয় একটি যন্ত্র তৈরি করছেন, যেটি প্রায় ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, এটি আকারে অনেক বড়। এবারের গ্রীষ্মে তারা এটি ব্যবহার করবেন।
ওশেন ক্লিন-আপ টিম আশা করছেন, যদি এরকম সুবিশাল দশটি যন্ত্র তারা অদূর ভবিষ্যতে সাগরে নামাতে পারেন, সেগুলো দিয়ে এই দশকের শেষ নাগাদ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের প্লাস্টিকের বর্জ্যের ৮০ শতাংশ অপসারণ করা সম্ভব।
প্লাস্টিক বর্জ্য থামানোর চেষ্টা
ওশেন ক্লিন-আপ ২০২১ সালে এক গবেষণা চালিয়েছিল, যাতে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় এক হাজার নদী থেকেই আসলে সাগরগুলোতে ৮০ শতাংশ প্লাস্টিকের দূষণ ঘটছে।
বয়ান বলেন, ‘নদীগুলো হচ্ছে ধমনীর মতো, এগুলো দিয়েই স্থলভাগের প্লাস্টিক বর্জ্য এসে সঞ্চিত হচ্ছে সাগরে। যখন বৃষ্টি হয়, প্লাস্টিক রাস্তা থেকে ভেসে যায় নালায়-নর্দমায়-খালে, সেখান থেকে নদীতে, এবং সবশেষে এই প্লাস্টিক গিয়ে পৌঁছায় সাগরে।’
তিনি বলেন, নদীতে স্রোত যে রকম তীব্র, সেকারণে নদীর পানি থেকে প্লাস্টিক অপসারণ অনেক বেশি কঠিন।
‘নদীতে কোনো প্লাস্টিক অপসারণের জন্য আপনি একবার মাত্র সুযোগ পান- যদি আপনি এটি তুলতে না পারেন এই প্লাস্টিক ভেসে চলে যায়, এবং নিশ্চিতভাবেই এই প্লাস্টিক সাগরে গিয়ে পড়ে,’ বলছেন তিনি।
ওশেন ক্লিন-আপ তাদের ‘ইন্টারসেপ্টর’ দিয়ে নদীর প্লাস্টিক সাগরে পৌঁছানোর আগেই আটকানোর চেষ্টা করে।
এ জন্য তারা নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। মূলত নদীর বিস্তার, গভীরতা ও স্রোতের গতি কতটা তীব্র সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে ঠিক করা হয় কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এক্ষেত্রেও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পরিচালিত ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নদী থেকে বর্জ্য অপসারণের জন্য ব্যবহার করা হয় একটি কনভেয়ার বেল্ট।
‘আমরা এখন বিশ্বের ১১টি নদীতে প্লাস্টিক অপসারণের কাজ করছি,’ বলছেন বয়ান। ‘কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের দূষণের শিকার এক হাজার নদীতে এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা।’
গোড়াতেই থামাতে হবে প্লাস্টিকের দূষণ
ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারের প্রফেসর রিচার্ড লাম্পিট ২০১৮ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, জাহাজ দিয়ে জাল টেনে সাগর থেকে প্লাস্টিক ছেঁকে তোলা, এবং এরপর এগুলো আবার জাহাজে করে তীরে পাঠানো- এতে করে কিন্তু উল্টো পরিবেশ দূষণ ঘটে কার্বন নির্গমনের বিষয়টি গোনায় ধরলে, সেদিক থেকে এর পরিবেশগত মূল্য অনেক বেশি পড়ছে।
কয়েক বছর পর তিনি এখনও বেশ সন্দিহান এভাবে প্লাস্টিক কতটা অপসারণ করা যাবে। তবে তিনি নদী থেকে প্লাস্টিক অপসারণের বিষয়টি নিয়ে বেশ ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
‘এর পরিবেশগত ঝুঁকি এখন অনেক কমে এসেছে’, বলছেন তিনি। ‘কারণ প্লাস্টিক ছেঁকে তোলার জন্য আপনাকে সাগরের দেড় হাজার কিলোমিটার গভীরে যেতে হচ্ছে না।’
মাইক্রো-প্লাস্টিক বা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা আমাদের সামুদ্রিক প্রাণ সম্পদের জন্য কী বিরাট হুমকি তৈরি করছে, সেটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত এই প্লাস্টিক যেন পানিতে যেতেই না পারে সেটা নিশ্চিত করা, একে তার উৎসেই বন্ধ করে দেয়া।’
‘প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বা সাগর থেকে এই প্লাস্টিক আপনি আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলের কোন ক্ষতি না করে কীভাবে অপসারণ করবেন, সেটা আমি বুঝতে পারছি না। আর এটা করতে গিয়ে তো আপনাকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানিও পোড়াতে হবে।’
বিশ্বের সমুদ্র দূষণ মোকাবেলার এই চেষ্টা নিঃসন্দেহে খুবই কঠিন, এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং এর উৎপাদন কমানোর ওপরই বেশি নির্ভর করে। কিন্তু বয়ান তার কার্যক্রম নিয়ে বেশ আশাবাদী।
‘আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করি, আমাদের এসব প্রযুক্তি দিয়ে আমরা এত দিন ধরে সঞ্চিত প্লাস্টিকের জঞ্জাল সাগর থেকে সরাতে পারবো। আর অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এই কাজে সময় দিতে হবে না।’
এবিএন/এসএ/জসিম
ওশেন ক্লিন-আপ সাগর থেকে প্লাস্টিক অপসারণের জন্য একটি দীর্ঘ ‘ইউ’ আকৃতির প্রতিবন্ধক ব্যবহার করে, যেটি আসলে জালের মতো। নৌকা দিয়ে এই জালটি প্লাস্টিকের বর্জ্য জমেছে সাগরের যেসব এলাকায়, তার মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি টানা হয় খুব ধীরে ধীরে, যাতে সামুদ্রিক প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি না হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে পরিচালিত ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষণ সাগর-পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা হয় প্লাস্টিকের বর্জ্যের সন্ধানে। এই ক্যামেরা আবার যুক্ত থাকে কম্পিউটারের সঙ্গে। ফলে ওশেন ক্লিন-আপ টিমের সদস্যরা বুঝতে পারেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এলাকাটিকে টার্গেট করতে হবে। ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচের দিকে নজর দিলে আপনি বুঝতে পারবেন, অনেক এলাকায় প্লাস্টিকের বর্জ্যের ঘনত্ব অনেক বেশি। আবার অনেক এলাকা আছে, যেখানে প্লাস্টিক নেই বললেই বলে’, বলছিলেন বয়ান স্ল্যাট।
ওশেন ক্লিন-আপ ২০২১ সালে এক গবেষণা চালিয়েছিল, যাতে দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় এক হাজার নদী থেকেই আসলে সাগরগুলোতে ৮০ শতাংশ প্লাস্টিকের দূষণ ঘটছে।
ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফি সেন্টারের প্রফেসর রিচার্ড লাম্পিট ২০১৮ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, জাহাজ দিয়ে জাল টেনে সাগর থেকে প্লাস্টিক ছেঁকে তোলা, এবং এরপর এগুলো আবার জাহাজে করে তীরে পাঠানো- এতে করে কিন্তু উল্টো পরিবেশ দূষণ ঘটে কার্বন নির্গমনের বিষয়টি গোনায় ধরলে, সেদিক থেকে এর পরিবেশগত মূল্য অনেক বেশি পড়ছে।
এই বিভাগের আরো সংবাদ