আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশে শকুন কেন ক্রমাগত কমছে? বাঁচাতে কী করা হচ্ছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২২, ১৫:০৫

শকুন রক্ষায় বাংলাদেশের সরকার বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর কমছে মহাবিপন্ন এই প্রাণীটির সংখ্যা। সর্বশেষ ২০১৪ সালের শুমারি বলছে, এই মুহূর্তে দেশটি মোটে ২৬০টি শকুন রয়েছে। সবই বাংলা শকুন।

এ প্রজাতি ছাড়াও দেশে আরও পাঁচ জাতের শকুন দেখা যায়। কিন্তু সেসব প্রজাতির শকুন অনিয়মিত ভিত্তিতে দেখা যায়।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএন বলছে, শকুন এখন সংস্থাটির লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী।

এর মানে হচ্ছে, প্রকৃতি থেকে যদি কোনো প্রাণীর মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশই হারিয়ে গিয়ে থাকে তা হলে সেটি রেডলিস্ট বা লাল-তালিকাভুক্ত প্রাণী হয়।

আইইউসিএন বলছে, এ মাসেই বাংলাদেশে আরেকটি শকুন শুমারি শুরু হয়েছে, যা চলবে মার্চ মাস পর্যন্ত। শুমারি শেষে বলা যাবে, দেশে শকুনের বর্তমান সংখ্যা কত আর তাদের প্রজননের কী অবস্থা।

বর্তমান পরিস্থিতি কী
পৃথিবীতে শকুন আছে প্রায় ২৬ লাখ বছর ধরে।
শকুন বড় ডানাওয়ালা বৃহদাকার পাখি, এটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী শিকারি পাখিবিশেষ। এদের মাথা, ঘাড় এবং গলায় পালক নেই, তাদের ঠোঁট খুব ধারালো। এরা ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খায়।

অনেক ওপর থেকে এরা মৃত পশুর দেহ দেখতে পায়, তার পর সেখানে নেমে আসে, এর পর সেই মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে।

তাদের পাকস্থলীর জারণ ক্ষমতা অসাধারণ, মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে শকুন।

আইইউসিএন বলছে, এই উপমহাদেশে এক সময় চার কোটি শকুন ছিল, কিন্তু সে সংখ্যা দ্রুত কমছিল।

১৯৭০ সালের শকুন শুমারিতে দেখা গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মানে আজকের বাংলাদেশে ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল।

বাংলাদেশে ২০০৮-০৯ সালে চালানো শুমারিতে দেখা যায় শকুনের সংখ্যা নেমে আসে ১৯৭২টিতে। এর কয়েক বছর পর ২০১১-১২ সালে শকুনের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ৮১৬টিতে। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালে শকুন কমতে কমতে দাঁড়ায় মাত্র ২৬০টিতে।

অথচ এক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখা মিলত বৃহদাকার এই পাখিটির।

কিন্তু এখন সিলেট এবং সুন্দরবন এলাকাতেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শকুনের দেখা মেলে।

সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়।

বাংলাদেশে এক সময় সাত প্রজাতির শকুন ছিল। কিন্তু এর মধ্যে রাজ শকুন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। এর মানে হচ্ছে গত ৪০ বছরে একটিও রাজ শকুন দেখা যায়নি দেশের কোথাও।

আইইউসিএনের শকুন বিষয়ক দক্ষিণ এশিয়া সমন্বয়কারী সারোয়ার আলম দীপু বিবিসিকে বলেছেন, এই মূহুর্তে বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে। এদের মধ্যে দুইটি প্রজাতি পরিযায়ী, মানে শীত মৌসুমে আসে এবং এপ্রিল মাস পর্যন্ত থাকে। এই দুই প্রজাতি হচ্ছে হিমালয়ান শকুন ও ইউরেশীয় শকুন।

তবে বাংলাদেশে প্রধানত দেখা যায় বাংলা শকুন, শকুন শুমারিতে যে ২৬০টি শকুন পাওয়া গেছে তারা সবাই বাংলা শকুন প্রজাতির।

বাংলা শকুন বাদে অন্য প্রজাতির শকুন নিয়মিত দেখা যায় না।

ইজিপশিয়ান শকুন খুবই বিরল। এই শকুন গত ১০ বছরে মাত্র দুইবার দেখা গেছে বাংলাদেশে। এছাড়া আছে কালো শকুন, এরাও বিরল।

বছরে তিন থেকে পাঁচটি শকুন দেখা যায় প্রতি বছর। সবশেষে আছে সরুঠোঁটি শকুন, এটি মূলত সুন্দরবনে বাস করে। কিন্তু এরাও বিরল, কারণ পাঁচ বছরে একটি শকুনের দেখা মেলে।

শকুন কেন কমছে? সংখ্যা কেন বাড়ছে না?
আইইউসিএন বলছে, পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া দুইটি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে।

শকুন গবেষক আলম বলছেন, ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন। কারণ শকুনের এনজাইম নাই।

এনজাইম হচ্ছে এক ধরনের প্রোটিন জাতীয় পদার্থ যা জীবদেহে অল্পমাত্রায় বিদ্যমান থেকে বিক্রিয়ার হারকে ত্বরান্বিত করে, কিন্তু বিক্রিয়ার পর নিজেরা অপরিবর্তিত থাকে।

এর বাইরে এখন গবাদি পশু পালন এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে গত কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, যে কারণে আগের মত সংখ্যায় গরু বা বড় প্রাণী অসুখে মারা যায় না। ফলে শকুনের খাদ্য সংকট হচ্ছে।

এ ছাড়া বনাঞ্চল উজাড় এবং বড় উঁচু গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে নিরাপদ আবাসস্থলের ঘাটতি হচ্ছে শকুনের।

আলম উল্লেখ করেছেন, এর বাইরে শকুনের প্রজনন প্রক্রিয়াও জটিল, যে কারণে এদের বংশবৃদ্ধি হার অত্যন্ত ধীর।

‘শকুন বছরে একটি ডিম পাড়ে, এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে এদের প্রজননের হার খুব ধীর, বলেন আলম।

তবে আইইউসিএন বলছে, এখন হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায় শকুনের প্রজনন সফলতা বেড়েছে। ২০১৪ সালে এটা ছিল ৪৪ শতাংশ, ২০২০ সালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশে এখনো কোন শকুন প্রজনন কেন্দ্র নেই। কিন্তু গবেষকেরা বলছেন, দেশে এখনো শকুনের কৃত্রিম প্রজননের কথা ভাবা হচ্ছে না। বাড়তি খাবার দিয়ে জঙ্গলে তাদের প্রজননে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

শকুন রক্ষায় কী করা হচ্ছে?
শকুন রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার এবং আইইউসিএন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ তে শকুনকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে একে রক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালে এক দশকব্যাপী অর্থাৎ ২০১৬-২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে।

বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ তে শকুন সংরক্ষণ কর্মসূচীতে বলা হয়েছে, সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক, এবং ২০১৭ সালে দেশের দুইটি এলাকায় কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এর বাইরে ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের দুইটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রথমটি সিলেট, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ, এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল এবং ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ মিলে মোট সাড়ে ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ছাড়া আইইউসিএনের সাথে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন সময়ের জন্য দুইটি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে এবং অপরটি সুন্দরবনে।

রেমা-কালেঙ্গায় এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শকুন দেখা যেত।

এ ছাড়া ২০১৬ সালে অসুস্থ এবং আহত শকুন উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার এবং পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

আলম বলছিলেন এখনো ওই কেন্দ্রে ২০টি হিমালয়ান গৃধিনী প্রজাতির শকুন রয়েছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

 এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ