আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশের জন্য বিশেষ বার্তা

কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ বন্ধ করবে জি৭ জোটের সদস্যরা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ১৪:১২

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এটি নিরসনে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সহায়ক কর্মকাণ্ড কমানো ও পরিত্যাগ করার প্রয়াস ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি জি৭ জোটভুক্ত দেশ জাপানও কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে একমত হয়েছে। অনেক আগেই বাকি দেশগুলো এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বন্ধ করেছে, বাকি ছিল শুধু জাপান। দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে ক্রমে সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্ক বার্তা বটে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান বর্তমানে ১৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করছে। দেশটি কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়বে বৈকি। তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক গ্যাসের অভ্যন্তরীণ মজুদ ফুরিয়ে আসায় স্বল্প ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কয়লানির্ভর কেন্দ্র স্থাপনকে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার। এখন পর্যন্ত ২১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশ এতটা কয়লাসমৃদ্ধ দেশ নয় যে এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে কয়লার সরবরাহ নিজেরাই করতে পারবে। বরং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সিংহভাগ চালানোর জন্য কয়লা আমদানি করতে হবে। পরিকল্পনার সময়ে সস্তায় কয়লা পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী কয়লার দাম বাড়তির দিকে। যেসব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বেশি, তারাও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকে দেখছে উন্নয়নের বাধা হিসেবে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা বাড়ালে তা বাংলাদেশের জন্যও কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আশার কথা, জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন ঘটছে। ১৬টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন বাতিল করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে খবরে প্রকাশ। দ্রুতই এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। ঘটনাপ্রবাহে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই বিশ্বে কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার বড় ধরনের শঙ্কা রয়েছে। আর সেটা হলে দেশের বিশাল বিনিয়োগ আটকে যাবে। দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের অগ্রগতিও আশানুরূপ নয়। ফলে এ মুহূর্তে সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।

বর্তমানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ব্যবসায়িকভাবেও খুব একটা লাভজনক হিসেবে দেখা হচ্ছে না। তিন বছর আগেও বিশ্বের ৪২ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র লোকসানে চলছিল বলে কার্বন ট্র্যাকারের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বর্তমানে কয়লার দাম ওই সময়ের তুলনায় আরো বেশি এবং আরো বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কার্বন প্রাইসিংয়ের কারণে সামনের দিনগুলোয় এ ঊর্ধ্বমুখিতা অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরো লোকসানি হয়ে উঠবে। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা কমাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য কয়লার বৃহত্তম ভোক্তাদেশ চীনের ক্ষেত্রেও। অন্যরা এ খাতে আর বিনিয়োগ করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে না। পুরনো বহু কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন, আর এতদিন ধরে সেটি করে আসছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলো। তারা বিনিয়োগ বন্ধ করে দিলে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের পক্ষে বিপুল ব্যয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। জাপানের অর্থায়নে বাংলাদেশেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এতে অর্থায়ন করছে জাপানেরই প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে প্রকল্প নিয়ে কোম্পানিগুলো নিজ দেশে বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের চাপের মুখে পড়েছে। জি৭ জোটের নেয়া এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের প্রকল্পে কী প্রভাব পড়বে, তা দ্রুত বিশ্লেষণপূর্বক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। ভারতে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শ্লথ হয়ে পড়ার মূল কারণ হলো, ব্যাংকগুলো আর এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও উচিত আন্তর্জাতিক প্রবণতা অনুসরণপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সরকারের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। ঋণদাতা দেশগুলো এ প্রকল্প থেকে সরে গেলে আমাদের অর্থের অপচয় হবে বিপুল। এটি বিবেচনায় রেখে বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। জাপানের মতো দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিলে চীন ও কোরিয়ার ওপরও চাপ বাড়বে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ কমিয়ে আনার। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে চলমান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিনিয়োগ স্বল্পতায় বাস্তবায়নে সংশয়ে পড়বে।

কয়লার ব্যবহার কমানো এবং চূড়ান্তভাবে বন্ধ করার পথে আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকে মনোযোগের কেন্দ্রে রেখে। বিশ্বজুড়ে সবাই সেই চেষ্টাই করছে। কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে বিশ্বকে মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখার স্বার্থে। সেজন্য গ্রিনহাউজ গ্যাস সৃষ্টিকারী জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ওপরই সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে। সুখের বিষয়, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এরই মধ্যে উৎসাহজনক সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য অন্যান্য জ্বালানির দিকেই আরো জোর দিতে হবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে।  দেশগুলো গতানুগতিক দেশীয় জ্বালানি উেসর পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে বাংলাদেশেরও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আমদানি করা কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বদলে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য প্রাকৃতিক গ্যাস, বায়ু ও সৌর জ্বালানির দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কয়লা ছেড়ে জ্বালানির নবায়নযোগ্য উেসর পক্ষে কথা বলছে। নবায়নযোগ্য ও স্থানীয় জ্বালানির উৎস ব্যবহার করলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংকট ও জ্বালানি সরবরাহ ক্ষেত্রের আঘাত থেকে রক্ষা পাবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরিবেশ দূষণ এড়ানো যাবে। সর্বোপরি বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা সংশোধন করে পরিবেশ ও বিনিয়োগবান্ধব করা প্রয়োজন। নইলে সেটি বাস্তবায়নে অর্থ মিলবে না।

সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ