আজকের শিরোনাম :

যে কারণে ‘লাপাতা লেডিস’ নিয়ে এত আলোচনা

  ইউএনবি

০৯ মে ২০২৪, ১৩:০৯ | অনলাইন সংস্করণ

প্রেম, হাস্যকৌতুক ও নারীর অধিকারের সচেতনতা নিয়ে বলিউড চলচ্চিত্র 'লাপাতা লেডিস'
২৬ এপ্রিল বিশ্ব নন্দিত ওটিটি (ওভার-দ্য-টপ) প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে প্রিমিয়ার হলো কিরণ রাওয়ের ‘লাপাতা লেডিস’ চলচ্চিত্র। এর আগে ১ মার্চ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই শোরগোল শুরু হয়ে গেছে হিন্দি ভাষার ছবিটি নিয়ে। প্রথম সারির কোনো অভিনয়শিল্পী না থাকলেও সিনেমাটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন স্বনামধন্য বলিউড তারকারা। মিডিয়াপাড়াজুড়ে এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে কেন এত আলোচনা, চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।

‘লাপাতা লেডিস’ চলচ্চিত্রের কলাকুশলী
পরিচালক কিরণ রাওয়ের শুরুটা ছিল ২০১০ সালে রোমান্টিক সিনেমা ‘ধোবি ঘাট’ দিয়ে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে এবার তিনি ফিরলেন স্যাটায়ার নিয়ে।

প্রযোজনা কমিটিতে তার সঙ্গে রয়েছেন জ্যোতি দেশপান্ডে এবং প্রাক্তন স্বামী বলিউডের তারকা অভিনেতা আমির খান। বিপ্লব গোস্বামীর গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য ও সংলাপ নির্মাণ করেছেন স্নেহা দেশাই।

সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা হলেন নিতানশি গোয়েল, প্রতিভা রান্তা, স্পর্শ শ্রীবাস্তাব, ছায়া কদম, অভয় ডুবে, রবি কিষাণ, দুর্গেশ কুমার, এবং গীতা আগারওয়াল।

ছবিটির সংগীত আয়োজন করেছেন রাম সম্পাথ এবং গানের কথায় ছিলেন দিব্যনিধি শর্মা, প্রশান্ত পান্ডে এবং স্বানন্দ কিরকিরে। সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন বিকাশ নওলাখা এবং সম্পাদনায় জাবীন মার্চেন্ট।

ছবিটি সর্বপ্রথম ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর টিআইএফএফ (টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল) এ প্রদর্শিত হয়েছিল।

‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমার অভিনয়শিল্পী স্পর্শ শ্রীবাস্তব, নিতানশি গোয়েল

ব্যঙ্গধর্মী রচনার নেপথ্যের বার্তা
২০০১ সালের ভারতের গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত লাপাতা লেডিস ফুল কুমারী এবং জয়া নামের দুই নববধূকে নিয়ে। একই ট্রেনে আরও অনেক বর-কনের সঙ্গে ফুল তার বর দীপক কুমারের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল। প্রত্যেকটা কনের সাজ ছিল একই এবং মুখ ঢাকা ছিল ঘোমটার আড়ালে। ফলে অতর্কিতে দীপক ফুলকে রেখে আরেক নববধূ জয়াকে নিয়ে বাড়ি রওনা হয়। স্বভাবতই বাড়ি ফিরে শুরু হয়ে যায় লঙ্কা কাণ্ড। কিন্তু ঘটনার ঝড়ো প্রবাহ লাগাম ছাড়া হয়ে যায়, যখন দীপক ফুলকে খুঁজতে দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসার শ্যাম মনোহরের শরণাপন্ন হয়। এরপর থেকে অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনার মোড়কে তীর্যকভাবে মোড় নিতে থাকে হাস্যরসাত্মক ঘটনাগুলো।

সুচিন্তিত প্রহসনের প্রতি পরতে পরতে থাকে দর্শকদের জন্য সামাজিক বার্তা। তবে আনন্দদায়ক মুহূর্তগুলো আর বার্তা কোনোটিই একে অন্যকে ছাপিয়ে যায়নি। বরং নিপুণ হাস্যরস এবং চরিত্রায়নে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে পিতৃতন্ত্রে মিথষ্ক্রিয়া।

ছোট ছোট আবেগঘন মুহূর্তগুলোর স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেছে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা এবং নারী-পুরুষের সমতার কথা। এমনকি এই প্রচারণাটা চলেছে পুরুষদের কোনো রূপ অবমাননা বা কুসংস্কারের পৃষ্ঠপোষকতা না করে।

লাল ঘোমটাতে মুখ ঢাকা কনে সামনের রাস্তা দেখতে পারে না। তাকে বলা হয় স্বামীর পা অনুসরণ করে নিজের পায়ের ধাপের দিকে খেয়াল রাখতে। এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গৌণ চরিত্রের উক্তিতে প্রচারিত হয়, মুখ ঢেকে রাখা নারীর পরিচয় লুকানোর শামিল।

তাছাড়া অন্ধ বিঃশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই, যেখানে প্রতিটি বিনিয়োগ সুষ্পষ্ট বোঝাপড়ার দাবি রাখে। তাই কাবিন নামায় স্বাক্ষর করার আগে নারী-পুরুষ উভয়েরই নথিগুলো ভালোভাবে পড়ে নেওয়া উচিৎ।

বিয়ে হয়ে নতুন যে গ্রামে সারাজীবন থাকতে যাচ্ছে ফুল সে গ্রামের নাম জানে না। তাকে কেবল রান্না করা, ঘোরদোর পরিষ্কার করা এবং শ্বশুরবাড়ির দেখাশোনা করা শেখানো হয়েছে। অন্যদিকে জয়া পড়াশোনায় অনেক ভালো করলেও তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এক দৃশ্যে মঞ্জু মাই চরিত্রটি ফুলের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, সে তা অর্জন করেছে। এতে ফুলের হাস্যজ্জ্বল অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দেয় যে নারীদেরও নিজস্ব সত্ত্বা রয়েছে। আর সেই সত্ত্বার প্রধান জ্বালানি হচ্ছে আত্মমর্যাদা।

এই প্রেক্ষাপটটি বাচ্চাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের ক্যারিয়ার গঠনের অধিকারকে ফুটিয়ে তোলে। কেননা কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাদের নিজেদের পছন্দনীয় বিষয়টিতে তারা আরও ভালো করতে পারে।

জয়াকে মূলত জোর করে বিয়ে করানো হচ্ছিল এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। তার ব্যাপারে গুঞ্জন রয়েছে- সে তার প্রথম স্ত্রীকে হত্যা করেছে। জয়ার বাবা যৌতুক হিসেবে স্বর্ণ এবং মোটরবাইক দেওয়ার জন্য জমি বিক্রি করেছেন। আর মা বলেছেন, জয়া যদি ভালো বউ হয়, তাহলে তার স্বামী তাকে ইচ্ছে মতো পড়াশোনা করতে দেবে।

কিন্তু জয়া ভালো করেই জানতো তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কারণ চাহিদার থেকেও যৌতুক কয়েক হাজার কম ছিল বলে সেই পাষণ্ড লোকে তার মাকে অপমান করেছিল।

তাই ট্রেন থেকে নামার সময় ভুল বরকে দেখেও জয়া চুপচাপ দীপককে অনুসরণ করে। এটি ছিল সেই লম্পট বর থেকে তার মুক্তির একমাত্র উপায়।

এই অংশটি বেশ মর্মান্তিক হলেও আদোতে এটি জরুরি মুহূর্তে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ঝুঁকি নেয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। এই সময়গুলোতে দ্বিধা মানেই জীবনকে এক চরম স্থবিরতার দিকে ঠেলে দেয়া। অন্যদিকে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি গ্রহণ অসহায়ত্বের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। অবশ্য প্রাথমিক ভাবে এমন সিদ্ধান্তের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো ধৈর্য্য ধরে মোকাবিলা করলে দীর্ঘমেয়াদে সুখের দেখা পাওয়া যাবে।

ভারতের গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত নিয়ে বলিউড চলচ্চিত্র 'লাপাতা লেডিস'

কেন ‘লাপাতা লেডিস’ নিয়ে এত আলোচনা
লাপাতা লেডিস এমন একটি ছবি, যার গ্রাম্য পরিবেশে বৃহৎ পরিসরের মুভি দর্শকরা নিজেদেরকে খুঁজে পান। অবচেতনেই তারা নিজেদেরকে গল্পের এক চরিত্র মনে করতে শুরু করেন।

নিজের চারপাশ পরিবর্তনের জন্য কখনই দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোযোগ হারানো উচিত নয়। সহজ-সরল বা সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার পরেও নিজের সিদ্ধান্ত ও ঝুঁকি অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এই আবেগপ্রবণ বিষয়টি দর্শকদের মনের মুকুরে নিমেষেই স্পর্শ করতে পারে, যখন চরিত্রগুলো খুব যত্নের সঙ্গে বিকশিত হয়। একবিংশ শতাব্দির উষালগ্নে কাল্পনিক গ্রামটি যেন সেই সব চরিত্রগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে।

ট্রেন যাত্রা শেষে ছবির নবদম্পতি গ্রামে পৌঁছানোর জন্য একাধিক পরিবহনে ভ্রমণ করার সময় নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এই দৃশ্য অধিকাংশ দর্শকদেরই জীবনের ছবি, আর কিরণ রাও তা বেশ নৈপুণ্যের সঙ্গেই ধারণ করেছেন। এতে করে দর্শকরা আগে থেকেই বুঝতে পারছিলেন যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হতে চলেছে। কিন্তু গল্পের চরিত্ররা সেটা জানে না। তাই সেই ভুলের পরে ক্যামন বিড়ম্বনা শুরু হয়, তা দেখার জন্য দর্শকদের মনে সাস্পেন্স তৈরি হতে থাকে।

এটি শুধু কেবল একটি দৃশ্যেই নয়, প্রায় পুরো সিনেমাজুড়েই এমন নাটকীয়তার সয়লাব। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতি কোন ভাবেই ছবির আবেগ এবং হাস্যরসের সঙ্গে কোন রূপ সংঘর্ষে যায়নি। বরং হাস্যরসের দৃশ্য অবতারণার সময় বিষয়গুলোকে এতটাই অবমূল্যায়ন করা হয় যে, তা অত্যন্ত মজার প্রহসনে রূপ নেয়। এতকিছুর মধ্যেও রাও নস্টালজিয়া দিকটি এড়িয়ে যাননি। পুরাতন ট্রেনের বগি, অস্বাস্থ্যকর টয়লেট, বাসে যাতায়াত, জামাকাপড় পরিবর্তন; সব মিলিয়ে চরিত্রগুলো যেন সাধারণ মানুষের গল্পই দেখিয়েছে।

‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমার অভিনয়শিল্পী রবি কিষাণ

আর চরিত্র চিত্রায়নের ক্ষেত্রে নিতানশি গোয়েল, স্পর্শ শ্রীবাস্তব এবং প্রতীভা রান্তা তিনজন-ই দুর্দান্ত। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই খাঁটি, কাঁচা, এবং বাস্তব অভিনয়টা বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন নির্দেশক রাও। বিশেষ করে ইন্ফ্লুয়েন্সার নিতানশী গোয়েল তার অভিনয়ে একজন কোমলমতী, সহজ-সরল, এবং আবেগে ভরপুর কিশোরীর পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন দারুণভাবে।

রবি কিষানের মতো একজন অভিজ্ঞ অভিনয়শিল্পীকে প্রধান পরিদর্শক হিসেবে রাখাটা ছিল একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে তার ভূমিকায় তিনি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি কি করছেন তা খুব ভালো করেই জানেন। তার কারণেই মুলত হাস্যরস, প্রেম এবং অপ্রত্যাশিত নারীবাদের সংমিশ্রণটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তার সঙ্গে সমান ভাবে তাল মিলিয়ে গেছেন ছায়া কদম, দুর্গেশ কুমার, এবং গীতা আগারওয়াল।

পরিশেষে
সর্বপরি, প্রেম, হাস্যকৌতুক ও নারীর অধিকারের সচেতনতা মিলিয়ে লাপাতা লেডিস একটি পরিপূর্ণ নির্মল বিনোদন। বলিউডের প্রথম সারির তারকাদের ভাষ্যে প্রধান জায়গা পেয়েছে সিনেমার গল্প এবং অভিনয়। এর অধিকাংশ কৃতিত্বই কিরণ রাওয়ের পরিচালনা। তার মুভি নির্মাণ দক্ষতায় বড় পর্দায় খুব পরিচিত মুখ না হয়েও পরিপক্ক অভিনয় দিতে পেরেছে অভিনয়শিল্পীরা। তাই এ কথা অনস্বীকার্য, দীর্ঘ দিন বাদে কিরণ রাওয়ের চিত্রজগতে ফিরে আসাটা সার্থক হয়েছে।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ