আজকের শিরোনাম :

৫২ বছরে দেশের বাজেট বেড়েছে হাজার গুণ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ১০:২১

স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে ১৯৭২ সালে যে যাত্রার সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরে বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট নিয়ে আসছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। যার আকার প্রায় পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকা।

৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার নতুন বাজেট প্রস্তাব বিবেচনায় নিলে ৫২ বছরে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয়ের ফর্দ বাড়ছে প্রায় ১ হাজার গুণ।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব দেবেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল; তা পাস হবে ঈদের ছুটির আগে। ১ জুলাই শুরু হচ্ছে নতুন অর্থবছর। এবারের বাজেটের শিরোনাম ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। এতে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ করার কথা তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’।

এবারের বাজেট হবে দেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট। আকারের দিক থেকে এটিই হবে দেশের বৃহত্তম বাজেট। সর্বশেষ বাজেটের তুলনায় এর আকার হবে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সংসদে পঞ্চম বাজেট উপস্থাপন করবেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৯ জুন তিনি ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন।

মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৩ জুন তার প্রথম বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) উপস্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালের ১১ জুন উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় বাজেট। ২০২১ সালের ৩ জুন উপস্থাপন করেন তৃতীয় বাজেট। গত বছরের ৯ জুন উপস্থাপন করেন তার চতুর্থ বাজেট। বৃহস্পতিবার দিতে যাচ্ছেন তার পঞ্চম বাজেট।

বাংলাদেশে আর্থিক বছর শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। আর শেষ হয় ৩০ জুন। সে কারণে প্রথা অনুযায়ী জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার সংসদে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। সংসদে আলোচনার পর ৩০ জুনের মধ্যে পাস হয় সেই বাজেট। ১ জুলাই থেকে শুরু হয় নতুন বাজেট বাস্তবায়ন। ২৮ অথবা ২৯ জুন দেশে ঈদুল আজহা (চাঁদ দেখা সাপেক্ষে) উদযাপিত হবে। ২৭ জুন থেকে শুরু হবে ঈদের ছুটি। ছুটি শেষ হতে হতে জুন মাস শেষ হয়ে যাবে। সে কারণে এবার ২৭ জুনের মধ্যে বাজেট পাস করতে হবে। আর এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এ বছর জুন মাসের প্রথম দিনই বৃহস্পতিবার হওয়ায় সে দিনটিতেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী।

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মধ্যেই পৌনে ৮ লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। বৈশ্বিক সংকট সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। একদিকে স্বস্তি দিতে গিয়ে অন্যদিকে টান পড়ছে। প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আইএমএফের শর্ত, যেন কোনো অবস্থাতেই ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো আটকে না যায়।

অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ যেকোনো মুহূর্তে দুই অঙ্কের ঘর (ডাবল ডিজিট) ছাড়িয়ে যেতে পারে। রোজার মাসে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে। এরই মধ্যে চিনি, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে; গ্যাস-বিদ্যুতের দামও প্রতি মাসে বাড়ছে। সরকার আর কোনো খাতে ভর্তুর্কি দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। নানা চাপের মধ্যে এগিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচন। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে ইতোমধ্যেই জোর রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে কারণে সংকটকালেও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে বড় বাজেট নিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।

নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরায় অর্থমন্ত্রীর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।  তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন মূল্যস্ফীতি। এই সূচক বেড়েই যাচ্ছে। বাজারের যে অবস্থা তাতে মে মাসেই এটি দুই অঙ্কের ঘরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতির জন্য আন্তর্জাতিক কারণও আছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ডলারের দৌঁড় থামছে না। সব মিলিয়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। আর এই মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে গরিব মানুষ, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।’

‘তাই আমার বিবেচনায় এই অসহায় মানুষের জন্যই বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতেই হবে,’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। সেই যুদ্ধ এখনো চলছে; তার মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বকে। আর এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই আরেকটি বাজেট দিতে হচ্ছে তাকে।

বাংলাদেশের বাজেট পরিক্রমা

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সামরিক থেকে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন সরকারে ১৪ জন অর্থমন্ত্রী (অর্থ উপদেষ্টা অথবা সামরিক আইন প্রশাসক) ৪৭টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন এর আগে।

মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৩ জুন তার প্রথম বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) উপস্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালের ১১ জুন উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় বাজেট। ২০২১ সালের ৩ জুন উপস্থাপন করেন তৃতীয় বাজেট। গত বছরের ৯ জুন উপস্থাপন করেন তার চতুর্থ বাজেট। বৃহস্পতিবার দিতে যাচ্ছেন তার পঞ্চম বাজেট।

সংসদে সমান ১২ বার বাজেট পেশ করে রেকর্ড করেন প্রয়াত এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে টানা ১০টি বাজেট দেয়ার রেকর্ড শুধু প্রয়াত মুহিতের।

শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন মুহিত। এর আগে তিনি এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ এই দুই অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনে একটি স্থানে এখনো অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ, যিনি সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী মোট যে ১৪ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তারা ছিলেন হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সেনা কর্মকর্তা অথবা অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী। এরা কেউই পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন না।

এক অর্থবছরে দুবার বাজেট উপস্থাপনের উদাহরণও আছে বাংলাদেশে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে মূল আর্থিক কাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে বাজেট উপস্থাপন করেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া।

বাজেট যে শুধু অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেন, তা নয়। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে তিনটি বাজেট উপস্থাপন করেন।

তাজউদ্দীন আহমদ তিনটি, শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছয়টি, এম সাইদুজ্জামান চারটি বাজেট দেন। অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দুটি এবং ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একটি বাজেট পেশ করেন।

এরশাদ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী এম এ মুনিম দুটি এবং ওয়াহিদুল হক একটি বাজেট উপস্থাপন করেন।

বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে মীর্জা নুরুল হুদা একটি বাজেট দেন। খন্দকার মোশতাক সরকারের আমলে দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট দেন এ আর মল্লিক।

চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের চারজন অর্থমন্ত্রী ২২টি বাজেট দিয়েছেন। বিএনপির তিন মেয়াদের শাসনামলে তিনজন ১৬টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন।

জাতীয় পার্টির আমলে ৯টি বাজেট চারজন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন। তিনটি বাজেট দিয়েছে দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। এই তিন মেয়াদের প্রথম অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, নতুন বাজেটে তা পৌনে ৮ লাখ টাকা হতে যাচ্ছে, যা শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

এভাবে প্রতিবছরই বেড়েছে বাংলাদেশের বাজেট।

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকেই বিপর্যস্ত ছিল দেশের অর্থনীতি। উৎপাদনের চাকা ঘোরেনি বহু দিন। নিম্ন আয়ের মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও রপ্তানি আয় কমে গিয়েছিল। আমদানিও হ্রাস পেয়েছিল। ওই দুই বছরে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় আর বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই ছিল নেতিবাচক।

করোনার ধকল কাটতে না কাটতেই ধেয়ে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কালো থাবা। অস্বাভাবিক আমদানিতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে টান পড়ে; ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা গেলেও রিজার্ভ কমছেই। ডলারের সংকট কাটছে না। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ঋণ রিজার্ভে জমা হলেও বাড়ছে না বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক। মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কাটছে না। প্রতি দিনই কমছে টাকার মান। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ১ ডলারের জন্য এখন হাতে গুণে ১০৯ টাকা দিতে হচ্ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স নিম্নমুখী।

এ অবস্থার মধ্যেও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) লক্ষ্য চলতি অর্থবছরের মতো ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ