মিয়ানমারের সংঘাত : প্রায় জনশূন্য নাইক্ষ্যংছড়ির ৭ গ্রাম

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:০২ | আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:০৮

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু বাজার এলাকা
ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই। সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে পড়ছে তাদের ছোড়া গুলি ও মর্টারশেল। এরইমধ্যে এক বাংলাদেশিসহ দুজন নিহত ও একাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভয় ও আতঙ্কে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম।

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আনোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে এ পর্যন্ত সেখানে সাতটি পাড়ার ৪০টি পরিবারের শতাধিক লোক আশ্রয় নিয়েছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু বাজার এলাকায় মুদি দোকানি– দিল মোহাম্মদ তার দোকানের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল সিএনজি অটোরিকশায় তুলছেন নিরাপদে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে। মিয়ানমারের অভ্যন্তীরণ সংঘাতের মধ্যে দেশটি থেকে ছোঁড়া মর্টার শেল পড়ে গতকাল সোমবার দুপুরেই তমব্রু বাজারের পাশের ওয়ার্ডে দুজন নিহত হয়েছেন। এরপর রাতভর ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী (মিয়ানমারের) এলাকায় গোলাগুলি চলতে থাকে। এমন পরিস্থিতি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মানুষজন নিরাপদে সরে গিয়েছেন।

তমব্রু বাজারে প্রায় ৪০টির মতো দোকান আছে। বাজারের পাশের কোনারপাড়া, হিন্দুপাড়া সীমান্তের জিরো পয়েন্ট নিকটবর্তী। এই এলাকায় অনেক বাড়ি-ঘরে মর্টার শেল, গুলিও পড়েছিল। সোমবার রাতে তুমুল গোলাগুলির পর হাজার হাজার মানুষ নিজ দায়িত্বে নিরাপদে সরে গিয়েছেন। এ বাজারের দোকানিরা আজ মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে কিছু দোকান খোলার চেষ্টা করেন। তবে গোলাগুলির আতঙ্কে তা আবারো বন্ধ করে দেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে। 

তমব্রু বাজারে দোকানি দিল মোহাম্মদ বলেন, "ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আমাদের নিরাপদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দোকানের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিয়ে যাচ্ছি বাসায়।" 

তমব্রু বাজারের আরেক দোকানি নুরুল আলম বলেন, "আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি আরো তিন দিন আগে। তবে দোকান খোলা ছিল। কিন্তু, গতকাল দুজন নিহত হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের ওদিক থেকে গোলাগুলি অনেক বেড়ে যায়। এজন্য এখানে এখন কোন মানুষ নেই। সবাই নিরাপদে চলে গেছে। অবস্থা খুব খারাপ।"

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তনু কুমার দাশ। তিনি বলেন, "আমরা দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বলা হয়েছে, সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ বসতির লোকজনকে নিরাপদে সরাতে।"

তবে কী পরিমাণ লোকজন নিরাপদে আশ্রয়ের ঘর-বাড়ি ত্যাগ করেছেন, তা জানাতে পারেননি তিনি। 

ঘুমধুম মৈত্রী সড়কের পাশে অবস্থিত নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "আমাদের এখানে অনেক বেশি গোলাগুলি চলছে। বিশেষ করে, সোমবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে গোলাগুলির মুহুর্মুহু শব্দ শোনা যাচ্ছে। গুলি এসে বাড়িঘরে পড়েছে। এজন্য পরিবার নিয়ে আমরা এলাকা ছেড়েছি। আমাদের পাড়ার সব ঘর-বাড়ি এখন মানুষশূন্য।"

এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)।

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন।

পরিদর্শন শেষে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, "ঘুমধুম সীমান্তের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। সীমান্ত এলাকার ২৪০ পরিবারের লোকজন ঝুঁকিতে রয়েছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান তাঁদের নিরাপদে সরে যেতে সহযোগিতা করছেন। ইতোমধ্যে, সীমান্তবর্তী ১৫০ পরিবার নিজ উদ্যোগে নিকট স্বজনদের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে জলপাইতলী এলাকা থেকে ৩০ পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, দুটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ওখানে অন্যান্যরা যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এটা প্রশাসনের পক্ষে অনুরোধ।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে মাইকিং করে বলা হচ্ছে তুমব্রু, কোনা পাড়া, মাঝের পাড়া, ভাজা বনিয়া পাড়া, বাজার পাড়া, চাকমা হেডম্যান পাড়া,পশ্চিবকুল পাড়া, ঘুমধুম নয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, মাধ্যম পাড়া এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, "আজকে টানা ৫-৬ দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী।"

সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার ঝুঁকি মাথায় রেখে দুটি স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসা বুলেট ও বোমার অংশে তাৎক্ষণিকভাবে হাত না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, অবিস্ফোরিত বুলেট ও বোমা  বিস্ফোরণে হতাহত হতে পারেন যে কেউ, তাই সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

জেলা প্রশাসক সোমবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে নিহত হোসনে আরা বেগমের বাড়িতে যান এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিয়ে ২০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।

এসময় বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, জেলা প্রশাসন ও বিজিবির সাথে পুলিশও সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে। কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘাত বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসতঘরে। এর প্রেক্ষিতে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকাবাসীকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার নিদের্শনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দরকারি নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের সামনে টিকতে না পেরে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা। সবশেষ মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) নতুন করে উখিয়া, টেকনাফ এবং তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বিজিপি সদস্যসহ দেশটির অন্যান্য বাহিনীর ১৪৯ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সবমিলিয়ে তিনদিনে বিজিপির ২৬৪ জন সদস্য আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে।

অন্যদিকে সীমান্তে উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ওপারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজনও অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার উখিয়ার পালংখালী সাতটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় অস্ত্রসহ ২৪ জনকে আটক করেছেন স্থানীয়রা। অনুপ্রবেশে বাধা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ছোড়া হাতবোমার আঘাতে আহত হয়েছেন চারজন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের একদম কাছাকাছি।

ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে। 

সংঘর্ষের জেরে সীমান্ত-লাগায়ো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের গণমাধ্যম দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদন অনুসারে, গত চার দিনে রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ ঘাঁটি আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। এ পর্যন্ত সংঘাতে জান্তা বাহিনীর অন্তত ৬২ জন সৈন্য নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। 

পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং সশস্ত্র সংগঠনগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্য, সাগাইং, মগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলের পাশাপাশি কাচিন ও কারেন রাজ্যে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে তাদের হামলা জোরদার করার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

 

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ