দুই বাসের রেষারেষিতে প্রাণ গেল বিসিএস ক্যাডার রুবেলের

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:১৫

স্বপ্ন তো সবাই দেখে কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারে কয়জন? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই স্বপ্নবাজ। কেউ কেউ কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে কেউবা ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। ব্যর্থতা জানা সত্ত্বেও যারা চেষ্টা করে যায় তারাই আজ সফল। সমাজে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। এমনই এক তরুণ স্বপ্নবাজ রুবেল পারভেজ। রুবেলের ছিলো স্বপ্ন দেখার নেশা। স্বপ্ন দেখতেন বিসিএস ক্যাডার ও দেশসেরা লেখক হবার। স্বপ্ন যেন হাতের মুঠোয় হাতছানিও দেয় ৪১ বিসিএস পরীক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্তও হলেন, অপেক্ষা কেবল যোগদানের। লেখক হবার স্বপ্নও যেন পূর্ণতা পায় ‘শিলা তলে পদ্মপাতা', 'ফুলেশ্বরি' লিখা থেকে শুরু করে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন।রুবেল চেতনা-৭১ এ (ভাইস-চেয়ারম্যান কার্যালয়) ধামরাই আবৃত্তি আসর নামের একটি সংগঠনে করতেন নিয়মিত আবৃত্তি, সাহিত্যমনা মানুষদের সাথে দিতেন খুনসুটি আড্ডা। তার সব স্বপ্ন আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পিচঢালা রাস্তায় আর স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে তার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কলম। আবৃত্তি আসরের কর্ণধার উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিনও যেন তার বিদায়কে মেনে নিতে পারছেন না। তার ফেজবুকের পাতায় লিখেছেন, " কি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি দুর্ঘটনা নয়, সেলফি নামক ঘাতক স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ওপর হামলে পরে তিনজনের তাজা প্রাণ কেড়ে নিল। "

স্বপ্নবাজ তরুণ কবি ও কথা সাহিত্যিক রুবেলের সর্বশেষ ফেজবুক ওয়ালে লিখা ছিলো -"আব্বা বহু কষ্টে ঘরটা বানাইছিল। আব্বা নাই, ঘরটা তবুও দাঁড়িয়ে আছে! আব্বা তার নামটাও লিখতে পারতো না! তার বড় ছেলে আজ বিসিএস ক্যাডার! ছোট দুই ছেলেও দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। "

ঢাকার ধামরাই বাসস্ট্যান্ডে গতকাল বৃহস্পতিবার বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক কর্মকর্তা রুবেল পারভেজ। উদ্দেশ্য কর্মস্থল মানিকগঞ্জের ঝিটকা। কিন্তু একটি বেপরোয়া বাসের চাপায় আর গন্তব্যে যাওয়া হয়নি তার। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত রুবেল। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রুবেল, মান্নানসহ কয়েকজন মানিকগঞ্জগামী বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী সেলফি পরিবহনের দুটি বাস একে অন্যকে ওভারটেক করতে গিয়ে গাড়ির অপেক্ষারত যাত্রীদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই দুজন মারা যান। আহত আক্তারুজ্জামান নামে একজনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তার অবস্থাও গুরুতর হওয়ায় ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

রুবেল পারভেজ মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের বন্দ্যেকাউলজানী গ্রামের মৃত মোকাদ্দছ আলীর ছেলে। ২০০৭ সালে বন্দ্যেকাউলজানী খাদেম আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে ধামরাই সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

রুবেলের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছোলে স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা কুলসুম বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন স্ত্রী ফারজানা আফরিন (২২)। এদিকে রুবেলের এক বছর বয়সী কন্যা সন্তান এখনো কথা বলতে শিখেনি।তবুও কন্যার সাথে বাবার যেন সর্বক্ষণ কথা হয়! রোবেলের ফেসবুক ঘাটলেই চোখে পড়বে তাদের খুনসুটি। রোবেলের ওয়ালে এখনো ভাসছে -"আমাদের গল্পগুলো ফুল,নদী,পাখি,ফারিহার মুখে শুনি," বাবা, প্র কিতি। আমি বলি সুন্দর জাহাঙ্গীরনগর।" আজ রোবেলের বাড়িতে শোকের মাতম, তার ছোট্ট রাজকন্যা শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবাকে হারিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনাথ হয়ে গেলো ফারিহা ।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক মাহমুদ ইকবাল লিখেছেন,রুবেল পারভেজ...
"তোমার এই মৃত্যুর জন্য সড়ক ও জনপদের 
কতিপয় কর্মকর্তারা দায়ী! 
যারা সড়কে মৃত্যুফাঁদ বানিয়েছে!" 

কলামিস্ট মাহমুদুর রশিদ লিখেছেন- "চোখের পানি রাখতে পারলাম না প্রিয় রুবেল। তুমি  সাহিত্যিক, নব্য বিসিএস ক্যাডার, নব্য সংসারি হলে। বাসের জন্য স্টপিজে দাঁড়িয়ে ছিলে আর তখনই দুটি বাস (সেলফি পরিবহন, ঢাকা মানিকগঞ্জ রুটে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা সৃষ্টকারী বাহন) বিভৎস প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে সাইডে দাঁড়ানো সত্ত্বেও তোমাকে সহ কয়েকজনকে পিষে চলে গেল।"

সেলফি পরিবহনের রুট পারমিট ও লাইসেন্স বাতিল এখন কেবল সময়ের দাবি, এমনটিই বলছেন সচেতন মহল।

নিরাপদ সড়ক চাই ধামরাইয়ের সভাপতি নাহিদ মিয়া বলেন,"আর কতো প্রানের বিনিময়ে আমরা নিরাপদ সড়ক পাবো? কি দোষ ছিল তাদের যারা আজ মৃত্যুর পথযাত্রী হলো নিরবে? কে বা কারা করবে এর বিচার? "

সচেতন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক ইমরান বলেন, রাতদিন সড়কের উন্নয়ন করছে -"শৃঙ্খলা রক্ষার দায় কার?

রাষ্ট্র বা প্রশাসন পরিববন মাফিয়াদের নিকট অসহায় কেন?"

এছাড়া রুবেলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটকের সামনে অভিযুক্ত সেলফি পরিবহনের প্রায় পঁচিশটি বাস আটক করে। এ সময় এই বাসের রুট পারমিট বাতিলসহ ঘাতক বাস চালকের শাস্তি ও নিহতের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রনি হোসাইন বলেন, মালিকপক্ষ যেন নিহত রুবেলের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয় এবং সেলফি পরিবহনের লাইসেন্স বাতিল করে, সে বিষয়ে আমরা হাইওয়ে থানা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

এবিএন/কুমার সপ্তর্ষি রায়/জসিম/গালিব

এই বিভাগের আরো সংবাদ