বরগুনায় কৃষি মৎস্য ও তাঁতশিল্পে কাজ করছেন গৃহবধূরা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:০৪

উপকূলীয় বরগুনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গৃহবধুরা কৃষি  কাজ করে, নদীতে মাছধরা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তাঁতে কাপড় বুনে সংসারে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ আনছেন; নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

পাথরঘাটা উপজেলার পাথরঘাটা সদর ও চরদুয়ানী ইউনিয়নের ৮টি গ্রামের গৃহবধু নারীরা দলবদ্ধ হয়ে পুরুষের সাহায্য ছাড়াই ধান, বিভিন্ন খাদ্য শস্যসহ নানা ফসল উৎপাদন করছেন। ধানের চাষসহ মাড়াই, সিদ্ধ-শুকনো করে ভাঙিয়ে চাল তৈরি করছেন নিজেরাই। অ্যাকশন এইড নামের একটি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় ৮ গ্রামের ২৫ জন করে মোট ২০০ গৃহবধু নারীকে নিয়ে বিভিন্ন নামে ৮টি নারী দল গঠিত হয়েছে। সেই নারীরা কৃষিকাজে নারীর অংশীদারিত্বসহ নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি মাঠে কাজ করাসহ সচেতনতা প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছেন।

পাথরঘাটার বলেশ্বর নদ -সংলগ্ন গাববাড়িয়া গ্রামে ধান কাটার মৌসুমে ধানের ক্ষেতের একপ্রান্তে থেকে দল বেঁধে নারীরা ধান কাটেন। ওই দলের নাছিমা বেগম, জয়নব বেগম, মমতাজ বেগম জানিয়েছেন, ধান কাটা শেষে ধান মাড়াই করে ঘরেও তোলেন নিজেরাই। চলতি মৌসুমেও তাদের কৃষিকাজ অব্যাহত রয়েছে।

পৃথিবীর আদি কৃষকের উত্তরসূরী ওই নারীরা আলাপকালে জানিয়েছেন, স্থানীয় বেশিরভাগ পরিবারের মতো মাছ ধরার কাজেতারা তাদের স্বামীদের সহযোগিতা করতেন। এখন সম্মিলিতভাবে কৃষিকাজ করছেন। ধানসহ নানা মৌসুমি সবজি, ফসল ফলাচ্ছেন। সফলতা পাওয়ায় নিজেদের আয় নিজেরাই জমা রাখেন, সংসারের কাজে খরচ করেন। স্বামীর কাছে আর হাত পাততে হয় না।

জেলা কৃষি বিভাগের সহকারী উপপরিচালক এসএম বদরুল আলম জানান, সম্মিলিতভাবে কাজ করে দেশের জন্য উদাহরণ তৈরি করছেন পাথরঘাটার এ নারীরা। এ কাজের ধারাবাহিকতা রাখতে তাদেরকে পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেওয়া অব্যহত রাখা হবে। কৃষি দফতর ওই নারীদের পরামর্শ দিয়ে আসছে।

উপকূলীয় জেলেবধূরা স্বামীর সঙ্গে সমান তালে মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ বা বিপণনে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। জেলেদের জীবন সংগ্রামে তারা সমান নয় বরং একটু বেশিই অবদান রেখে চলেছেন।

তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙ্গা গ্রামের জেলে আমজেদ হোসেনের স্ত্রী রাবেয়া বেগমের প্রতিদিনকার গল্প এরকম.... ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বেড়িয়ে পরেন স্বামীর সাথে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে পায়রা নদী তীরে। রাবেয়া নদীতে পাতা ইলিশের জাল তোলায় স্বামীকে সহায়তা করেন। আহরিত মাছ রক্ষণাবেক্ষণসহ মাছধরা জাল দেখভাল করেন। মাছ বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন তিনি। রোদ, বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়ায় হাড়ভাঙা শ্রমে কিন্তু কোন ছুটি নেই। এ অতিরিক্ত কাজের বাইরে পরিবারের খাবার রান্না-বান্না আর ঘরগেরস্থলীর কাজ তো বাধ্যতামূলক আছেই। শিশু সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর কাজটিও তাকে করতে হয়। আবার সুর্য অস্ত যাওয়ার পর স্বামীর সাথে নদীতে যাত্রা জাল ফেলতে। কেবল রাবেয়াই নয় উপকূলীয় জেলে বধূরা পুরুষের সাথে সমানতালেই লড়াই করে বাঁচেন।

বরগুনা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, জেলার ৬ উপজেলার পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকায় তালিকাভূক্ত কার্ডধারী ৪৫ হাজার ৬শত ২১ জন জেলের বাস। এদের মধ্যে কমপক্ষে দশ হাজার জেলেবধূ সরাসরি মাছ ধরার কাজে শ্রম দিলেও পরিবারের অন্য নারীদের সবাই কমবেশি মাছধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপননসহ নানা ভাবে পরিশ্রম করেন।

বামনা উপজেলার বিষখালী নদীতীরের কলাগাছিয়া জেলে পল্লীর সুভাষ দাস জানান, নদীতে মাছ ধরায় পরিবারের মহিলাদের শ্রমও প্রয়োজন হয়।

বরগুনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ^জিৎ কমার দেব জানিয়েছেন, উপকূলীয় জেলে পরিবারের নারীরা মাছ ধরার কাজে পুরুষকে সহায়তা করে। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান মৎস্য দপ্তরে সংরক্ষিত নেই।

জেলার তালতলীতে রাখাইন পাড়ায় পাড়ায় রাখাইন গৃহবধূ তাঁতিদের কর্মব্যস্ততা থাকে সারা বছরই। তাদের তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত রাখাইন পল্লীগুলো জানান দেয় রাখাইন হস্তশিল্পের জনপ্রিয়তা ও ঐতিহ্যকে। মায়ানমার (বার্মা) থেকে আমদানীকরা সুতা দিয়ে শীতের চাদর, শার্ট পিস, ব্যাগ, লুঙ্গী, ও গামছা বুনে রাখাইন নারী  তাঁতিরা তাদের হস্তচালিত তাঁত বস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। গৃহবধু এ সকল রাখাইন তাঁতিদের উৎপাদিত এ সকল বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে স্থানীয় বাজারগুলোতে চাদর, শার্ট পিস, লুঙ্গী এ কাপড় খুব চলছে বলে ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে।

রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে তৈরি লতা পাতা ফুল ও বিভিন্ন কারুকাজে তৈরি এ সকল কাপড় যেমন ভাল ওম দেয় তেমনি তার আকর্ষণও রয়েছে। সারা বছর বেশি চাহিদা না থাকলেও শীত মৌসুম, ঈদে চাহিদা বেড়ে যায়। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই তালতলীর ১৭টি রাখাইন পল্লী সরগরম হয়ে রয়েছে। তালতলীর আগাঠাকুর পাড়ার উসিট মং জানান, তালতলী উপজেলার তিন ইউনিয়নের তালতলী পাড়া, ছাতন পাড়া, মনুখে পাড়া, আগাঠাকুর পাড়া, সওদাগর পাড়া, তালুকদার পাড়া, কবিরাজ পাড়া, নামিষে পাড়া, লাউ পাড়া ও অংকুজান পাড়াসহ ১৭টি রাখাইন পল্লীতে দুই শতাধিক হস্তচালিত তাঁত  রয়েছে। কোন কোন পরিবারে ২-৩টি করেও তাঁত রয়েছে। সকলেই ব্যস্ত কাপড় উৎপাদনে।

ছাতনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন রাখাইন তরুণী অংতেন তালুকদার। তিনি জানান, তাঁতে কাপড় বোনা রাখাইন নারীদের পারিবারিক ঐতিহ্য। রাখাইনদের মধ্যে এমন প্রচলন আছে, পরিবারের যে মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত চালাতে জানেনা তাদের ভালো বিয়ে হয় না।

বরগুনার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ জাহাঙ্গীর কবির বলেন, নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে উপকূলের প্রান্তি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভাবেস্ববলম্বী হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণে এসব কর্মঠ নারী অনন্য উদাহরণ তৈরি করছেন।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ