আজকের শিরোনাম :

প্রভাবশালীদের চক্ষুশূল সাংবাদিক নাদিম চেয়েছিলেন নিজের নিরাপত্তা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩, ০৯:৩৯

সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম
সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের সময় বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেয়ারম্যানের ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত নাদিমকে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেন।

সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যার এ বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সাংবাদিক আল মুজাহিদ। ঘটনার দিন বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে মুজাহিদ গোলাম রব্বানীর সঙ্গে উপজেলার পাটহাটি মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুজনকে আলাদা দুটি মোটরসাইকেলে করে যেতে সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে।

সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, একটি বাইকে থাকা সাংবাদিক রব্বানীকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে পেটাতে পেটাতে সিসিটিভির আওতার বাইরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এরপর কি ঘটেছিল সেই বর্ণনা দিয়েছেন আল মুজাহিদ। নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানীকে মামা ডাকতেন মুজাহিদ।

মুজাহিদ বলেন, রাত ১০টার দিকে নাদিম মামা আর আমি একসঙ্গে বাসার দিকে রওনা হই। বকশীগঞ্জের পাটহাটি মোড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটু এগিয়ে বলি, মামা বৃষ্টি আসতেছে, আমি বাসায় চলে যাই। নাদিম মামা বলেন, যাও বাসায় যাও। এর মধ্যে আমার পেছন থেকে মামা বলে ডাক দেয়। পেছন ফিরে দেখি, চলতি মোটরসাইকেল থেকে নাদিম মামার শার্টের কলার ধরে রাস্তার মধ্যে ফেলে দেয়। এরপর মনির, সাইদুর ও আরও কয়েকজন মামাকে কিলঘুষি মারতে মারতে মোড় থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়।

মুজাহিদ আরও বলেন, টিঅ্যান্ডটি সড়কে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে ছিল আরও ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী। সবাই মিলে যে-যেভাবে পারছিল রব্বানীকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু। একপর্যায়ে কেউ একজন লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে রব্বানীকে আঘাত করেন। সাংবাদিক গোলাম রব্বানী বারবার বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন। তবু তাকে নির্মমভাবে মারছিল তারা। একপর্যায়ে মৃত ভেবে তাকে ফেলে সবাই চলে যায়।

সেখান থেকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে মারা যান নাদিম। মাথায় গুরুতর আঘাতের কারণেই সাংবাদিক নাদিমের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল শুক্রবার জানাজা শেষে নাদিমকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু পলাতক রয়েছেন।

সংবাদ প্রকাশের জেরেই হত্যা: দাবি পরিবারের

বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারির একাধিক সংবাদ প্রকাশের জেরেই সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে, দাবি পরিবারের। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ে জড়িত চেয়ারম্যান ও তার ছেলে রিফাতকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসির দাবিও জানিয়েছে পরিবার।

সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, চেয়ারম্যান বাবুর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তারা আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবুর নির্দেশে ও তার ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাতের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। আমি এই হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১০ মে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে সন্তানের স্বীকৃতি ও স্ত্রীর মর্যাদা চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সাবিনা ইয়াসমিন নামের এক নারী। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রমাণ হিসেবে দুটি কাবিননামা উপস্থাপন করেন ভুক্তভোগী নারী। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলানিউজে সংবাদ প্রকাশ করেন সাংবাদিক নাদিম। যার কারণে ১৪ মে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে নাদিমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন চেয়ারম্যান বাবু। মামলাটি আদালত খারিজ করে দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন চেয়ারম্যান বাবু।

স্থানীয়রা জানান, গত ১১ এপ্রিল আরেক দফা সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা হয়। ‘বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহিনা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক বাবুল তালুকদার রাজাকারের সন্তান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করায় ওই হামলার ঘটনা ঘটে।

নাদিমের মামাতো ভাই এমদাদুল হক লালন বলেন, গোলাম রব্বানী নাদিম স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত সাহসী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যার কারণে প্রভাবশালীদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। এর আগেও তিনি একাধিকবার হামলা-মামলার শিকার হন। রাষ্ট্রের কাছে নিজের নিরাপত্তাও চেয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে তাকে জীবন দিতেই হলো।

শোক এলাকাজুড়ে

গোলাম রব্বানী নাদিমের হত্যায় পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের আহাজারিতে শোক নেমেছে এলাকাজুড়ে। গতকাল জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলা শহরের গরুহাটি কাচারিপাড়া গ্রামে নাদিমের বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এর আগে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, উঠানে নাদিমের মরদেহ রাখা হয়েছে। আর সেই মরদেহ ঘিরে স্বজনদের চলছে আহাজারি। পাশেই বসে দোষীদের বিচার দাবি করে কাঁদছিলেন নাদিমের মা-বাবা, স্ত্রী ও তার তিন সন্তান।

নাদিমের মা আলেয়া বেগমকে বলতে শোনা যায়, ‘নাদিম আমার সোনামানিক। আমার নাড়িছেঁড়া ধন। আমার পোলাডা কথা কয় না ক্যা! আমার বাবাডারে আইনা দেও কেউ। আমার পোলাডারে ওই বাবু চেয়ারম্যান মাইরা ফালাইছে। বাবু চেয়ারম্যানের ফাঁসি চাইগো।’

খুনিদের গ্রেপ্তারে রাজপথে সাংবাদিকরা

সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। হত্যায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সব জেলায় মানববন্ধন, পথসভা, বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা। দাবি মানা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন সাংবাদিকরা। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিতসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

টিআইবির উদ্বেগ

ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যা বাংলাদেশে যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ রকম ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতার আনুকূল্যে বিচারহীনতা ভোগ করাও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, মন্তব্য করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

শুক্রবার সাংবাদিক গোলাম রব্বানী হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

এ হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেই সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান ও তাদের যোগসাজশকারী কর্তৃক সাংবাদিকের ওপর হামলা, নির্যাতন, আটক, গুম এমনকি হত্যা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে। মুক্ত সাংবাদিকতার এই সংকট নিরসনে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তবে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক সরাসরি জড়িতদের পাশাপাশি যাদের নির্দেশে, যোগসাজশে ও যাদের স্বার্থ-সুরক্ষায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানীকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।

জড়িতদের ধরতে কাজ করছে র‌্যাব

সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে র‌্যাব কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, যারাই এতে জড়ি থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি। এ হত্যাকাণ্ডে র‍্যাব ছায়াতদন্ত করছে। র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-১৪ আসামিদের ধরতে কাজ শুরু করেছে।

এবিএন/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ