আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

এসএসসিতে এগিয়ে, কিন্তু উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম কেন?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৫৮

২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাসের হার এবং জিপিএ ফাইভের দিক থেকে এগিয়ে আছে নারী শিক্ষার্থীরা। পাঁচ বছর ধরেই নারী শিক্ষার্থীদের এই ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে।

তবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে নারী শিক্ষার্থীদের সাফল্যের এ জয়জয়কার থাকলেও উচ্চশিক্ষায় তাদের সংখ্যা পুরুষ শিক্ষার্থীদের অনুপাতে অনেকটাই কম।

বাংলাদেশের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুারোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় সমান। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকই নারী শিক্ষার্থী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই সংখ্যা অনেকটাই কমে দাঁড়ায় ৩৬.৩০ শতাংশে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থী
এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন এবং নারী শিক্ষার্থী ছিল ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন। এসএসসি পরীক্ষায় মোট পাসের হার ছিল ৮৭.৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থীর পাসের হার ছিল ৮৭.১৬ শতাংশ এবং  নারী শিক্ষার্থীর ৮৭.৭১।

এ ছাড়া ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৬ জন পুরুষ শিক্ষার্থী এবং ১ লাখ ২১ হাজার ১৫৬ জন নারী শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের অনুপাত প্রায় সমান। অংশগ্রহণের দিক থেকে পুরুষ শিক্ষার্থীরা কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পাশের হার এবং ভালো ফলাফলের দিক থেকে এগিয়ে আছে নারী শিক্ষার্থীরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে কীভাবে এলো সমতা?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের সমান অংশগ্রহণকে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি জায়গা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।

সরকারের খাত সংশ্লিষ্ট নানা পদক্ষেপ ও প্রণোদনার জন্য এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নারী শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির মতো আর্থিক সহায়তা পায়। এতে করে পরিবারগুলো মেয়ে সন্তানদের শিক্ষার বিষয়ে উৎসাহিত হয় এবং তাদের স্কুলে পাঠায়। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীর মধ্যে সমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে।

উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থী কম কেন?
বাংলাদেশের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুারোর (ব্যানবেইস) হিসাবে, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ৩৬.৩ শতাংশ। ভালো ফলাফলের পরও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোকেই দেখছেন রাশেদা কে চৌধুরী। 

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় অর্জন হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তা ধরে রাখতে না পারার কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে নির্দিষ্ট করেছেন তিনি।

একটি হলো নারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা এবং অন্যটি হলো পড়াশোনার ব্যয়ভার।

নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেলেও এখনো উচ্চতর শিক্ষার সিদ্ধান্তে পরিবারগুলো ছেলে সন্তানকেই এগিয়ে রাখছে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

তিনি বলেন, ‘ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে কাকে পাঠাবোর বিবেচনায় সমাজের বড় অংশ ছেলে সন্তানের পক্ষে মতামত দেয়।’

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার ব্যয়ে বেশ বড় অংক খরচ হয়, যার ব্যয়ভার পরিবারকেই বহন করতে হয়।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সীমিত আয়ের পরিবারগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাধ্য না হলে খরচ করে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে মেয়ে সন্তানের অন্য কোন ব্যবস্থা করে বা বিয়ে দিয়ে দেয়।

পেশাগত শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ভিন্ন চিত্র
উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলেও পুরো ভিন্ন চিত্র মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো পেশাগত শিক্ষায়।

এ বছর মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় ৭৯ হাজার ৩৩৭ জন উত্তীর্ণ  শিক্ষার্থীর ৫৫ দশমিক ১৩ শতাংশই ছাত্রী।

নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত এমবিবিএস পাস করা ৪৮ হাজার ৭৭৭ জন দেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ২৬ হাজার ৯০১ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫৫ শতাংশ। এ ছাড়া বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে উত্তীর্ণদের ৬০ শতাংশের ওপরে ছিল নারীরা।

সরকার কী ভাবছে?
কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জের বিষয়টিকেই উচ্চতর পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।

‘বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই কর্মসংস্থানের জন্যই উচ্চশিক্ষার দিকে যায়। কিন্তু সার্বিকভাবে সমাজে নানাভাবে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত চাকরিতে এখনো চ্যালেঞ্জ আছে। আর তাই অনেক নারী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে যান না।’

কর্মসংস্থানে কোটা প্রথা উঠে যাবার কারণে কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া আর্থ-সামাজিক কারণে নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় বলেও মনে করেন মি চৌধুরী।

‘আগে প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। এখন আরও পরে দেয়া হচ্ছে।’

নারীদের অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে নেওয়ার জন্য  সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান মহিবুল হাসান চৌধুরী।

‘আমাদের ভবিষ্যত লক্ষ্য হচ্ছে এই শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার দিকে ঠেলে দেয়া। সেই উদ্দেশ্যে মেয়েদের জন্য আলাদা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, আবাসন সংকট কাটাতে মেয়েদের আলাদা হোস্টেলের মতো নানা খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।’

নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো সম্ভব?
তিনটি দিকে নজর দিলে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী।

প্রথমত উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া। উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবারগুলোর যে বড় অংকের ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হয় তাতে ভর্তুকি দিলে খরচ অনেকটাই কমে আসবে। আর এতে করে পরিবারগুলো তাদের মেয়ে সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

দ্বিতীয়ত ভর্তুকি দেওয়ার জন্য শিক্ষার ওপর রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে শিক্ষায় মোট জিডিপির হার ১২-১৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে গিয়ে খুব বেশি ভর্তুকির সুযোগ থাকে না।

তাই শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী।

একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে বিনিয়োগের মনিটরিং করার কথাও জানান তিনি। আর সবশেষে সমাজের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারলে উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের দৃশ্যপট বদলানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ