আজকের শিরোনাম :

একটি গভীর সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২২, ১৩:৩৮

বৃহৎ পরাশক্তির ছত্রচ্ছায়ায় প্রণীত সুপরিকল্পিত প্রয়াস ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান। এদিনটি শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং আরও কিছু লোকের হত্যাকান্ডের স্মারক বা আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা নয়। এটি ছিল রাষ্ট্র শাসন এবং সরকারি যন্ত্রের ভিন্ন পথে সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে যাত্রার সূচনা। 

 এই অভ্যুত্থান যেমন ছিল একটি বৃহৎ পরাশক্তির ছত্রচ্ছায়ায় প্রণীত সুপরিকল্পিত প্রয়াস, তেমনি এর টাইমিং ছিল গভীর চিন্তাপ্রসূত। বস্তুত, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু করে। বেসামরিক সরকার উৎখাত প্রাপ্ত হয়ে সামরিক শাসনের অনাচারি ইতিহাস রচিত হতে থাকে।

হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম তার ‘সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাত্ত পঁচাত্তর’ বইতে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকে একটি বৃহৎ পরাশক্তির ছত্রছায়ায় প্রণীত সুপরিকল্পিত প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। হাফিজ উদ্দিন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ এবং সাবেক মন্ত্রী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ভেতর থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার। ’৭৫-এ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপদগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদের এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থে তার নির্মোহ বয়ানে উঠে এসেছে সেসব চিত্র।

তিনি লিখেন, ‘পনেরই আগস্টের অভ্যুত্থান ছিল একটি বৃহৎ পরাশক্তির ছত্রছায়ায় প্রণীত সুপরিকল্পিত প্রয়াস। এর টাইমিং ছিল গভীর চিন্তাপ্রসূত। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস, দেশটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ও সামরিক বাহিনী সেদিন দিবসটি উদযাপনে ব্যস্ত থাকে। ঘটনা ঘটানো হয় শুক্রবারে। বাংলাদেশে এটি জুমার নামাজের দিন। ফলে, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিরা অনেকটা ছুটির মেজাজে থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সংকট কালে প্রধান ভরসা রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ১৫ আগস্টে সরকারি কাজে বিদেশে অবস্থান করছিলেন। ফলে, অভ্যুত্থানকারীদের বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।’

হাফিজ আরও লিখেন, অন্যদিকে সামরিক গেয়েন্দা বাহিনীর ডিজিএফআইয়ের প্রধান রূপে মাত্র কয়েকদিন আগে নিয়োগ পেয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জামিল উদ্দিন। তিনি ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ পদে ধাতস্থ হওয়ার আগেই অভ্যুত্থান ঘটে যায়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হওয়ার পরপরেই জামিলকে ফোন করে তার সাহায্য চান। জামিল সিভিল ড্রেসে তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে একাকী ৩২ নম্বরের উদ্দেশ্যে ছুটে যান। বোঝাই যাচ্ছে তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেননি।  সোবহানবাগ এলাকায় পৌঁছালে অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। 

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হাসান উজ্জামান তার ‘১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান মুজিব হত্যা ও ধারাবাহিকতা’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেবল শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডই ঘটেনি, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারেরই ক্ষমতাচ্যুতি হয়নি, ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার, সরকার পরিবর্তনে তাদের ইচ্ছে-শক্তি ও রায়কে অস্বীকার করা হয়েছিল। কার্যত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেই নিধন করা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান সংঘটিত করে শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযোগীদের হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, নিজেদের ইচ্ছে মাফিক বেয়নেটের ডগায় রাষ্ট্রপতি বানিয়ে, মন্ত্রী সভা গঠন করে, সরকার তৈরি করে সম্পূর্ণভাবে সংবিধান-বিযুক্ত করে ‘সুপ্রা কনস্টিটিউশনাল’ কর্তৃকত্ব সমগ্র দেশকে সামরিক আইনের আওতায় আনা হয়েছিল। তার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণাত্মক এই বইটি ১৯৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থটিতে হাসান উজ্জামান আরও বলেন, ১৫ আগস্টের অন্যায় স্পর্ধাকে জাতি মেনে নিয়েছিল বলেই ১৫ বছর ধরে এ দেশে যথাক্রমে জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক স্বৈরাচার চলতে পেরেছে। ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানকে অবৈধ বলে প্রতিরোধ করা হলে একের পর এক দুই ডজনেরও অধিক অভ্যুত্থান প্রক্রিয়া ঘটতো না। একের পর এক এত হত্যাকান্ড হতো না। ১৫ বছর দেশ সামরিক শাসনের কব্জায় থাকতো না।

বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র কয়েক দিন পর ২৮ আগস্ট ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখে ১৫ আগস্টের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেন বাংলাদেশের জনগণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা এবং সামরিক শাসনের কালে প্রত্যাবর্তন করেছে। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কয়েক বছর পর ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনেও বলা হয়, ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও শেখ মুজিবের হত্যার পর গণতান্ত্রিক আমলের অবসান হয়।

এদিকে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছিল, তা যে সাংবিধানিকভাবে বৈধ ছিল না খোদ সরকার প্রধান হিসেবে খন্দকার মোশতাক আহমদও তার প্রথম ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মোশতাক সামরিক আইনের জবর দখলকারী স্বত্বের জোরে সরকার প্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশে রেডিও ও টেলিভিশনে এদিন এক ভাষণ দেন। 

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়। ভাষণে মোশতাক এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূতপবিত্র কর্তব্য সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য করুণাময়ের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তবে, তিনি বলেন, দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। মোশতাকের এই ভাষণে অবশ্য আরো একটি দাবি করা হয়েছে, সেনাবাহিনীও এই পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছে এবং সরকারের (তার) প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। তবে, সেনাবাহিনীর পুরো অংশ এই ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিল কিনা তা কিন্তু এখনো উদঘাটিত হয়নি। আর বিধান অনুযায়ী পরিবর্তন সম্ভব না হওয়ার কথা বলে নিজেই নিজের সরকারকে অবৈধতার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। 

বিশিষ্টজনদের মতে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারায় মৌলবাদের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে।
তথ্যসূত্র : বাসস

এবিএন/এসএ/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ