কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতর মহানায়ক বিমল মিত্র
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:১৬
বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি ছিলেন একজন নিবিষ্ট পথিকৃৎ। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় তার মত সারল্যের আচ্ছাদন অন্য কারো লেখায় এতোটা মিলেনি। তিনি সহজকে অতি সহজে চিত্রিত করেছেন তার শৈল্পিক সৃজনে। তিনি কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতর এক মহানায়ক।
ধারণা করা হয় তার রচিত উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। কিন্তু এর সঠিক কোনও তথ্য মিলেনি। তবে তার কম-বেশি তো হবেই। যদিও তখন না ছিল কম্পিউটার, না ছিল এতো উন্নত প্রযুক্তি। তারপরও হাজার হাজার পৃষ্ঠা হাতে লিখেই সৃজন-সাধন করেছিলেন বিমল মিত্র।
মানুষের জীবনচক্র যে কত বৈচিত্র্যের, চরিত্রে-চরিত্রে কতো রকমের যে বাঁক সেটি আমাদের স্বাভাবিক চোখে ধরা না পড়লেও অনেক আগে থেকেই এইসব চরিত্র দেখতে পেয়েছিলেন কথাশিল্পী বিমল মিত্র। সমাজ-সংসারে নানা প্রকারের নির্মম-নৃশংস চরিত্রগুলোকে তিনি তুলে ধরেন তার ক্ষুরধার শৈল্পিক লিখনিতে। বলছি, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কথাশিল্পী বিমল মিত্রের কথা।
আজ ২ ডিসেম্বর সুনির্মল এই কথাশিল্পীর ২৮তম প্রয়াণদিন। ১৯৯১ সালের এইদিনে কীর্তিমান এই সাহিত্যিক না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বিমল মিত্র ১৯১২ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশচন্দ্র মিত্র। শিক্ষাজীবনে তিনি চেতলা স্কুল, আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন।
রেলে চাকরি করতে করতে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন বিমল মিত্র। প্রথম উপন্যাস ‘চাঁই’। পাঁচের দশকের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাস লিখে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এরপর রেলের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যসৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ। তার অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’, ‘চলো কলকাতা’, ‘পতি পরম গুরু’, ‘আসামী হাজির’ ইত্যাদি।
প্রায় পাঁচশোটি গল্পেরও লেখক ছিলেন বিমল মিত্র। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গ্রন্থের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়াও তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। তার রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
নিজের সম্পর্কে নিজেই মূল্যায়ন করেছেন বিমল মিত্র ‘...সত্যিই আমার কিছু হয়নি। অবশ্য তা নিয়ে আমি দুঃখও করি না। কারণ জীবনে যে কিছু হতেই হবে তারই বা কী মানে আছে। আকাশের আকাশ হওয়া কিংবা সমুদ্রের সমুদ্র হওয়াটাই তো যথেষ্ট। লেখক আমি হতে না-ই বা পারলাম, মূলত: আমি একজন মানুষ। মানুষ হওয়াটাই তো আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। কারণ তরুলতা অরি সহজেই তরুলতা, পশু-পাখি অতি সহজেই পশু-পাখি, কিন্তু মানুষ অনেক কষ্টে অনেক দুঃখে অনেক যন্ত্রণায় অনেক সাধনায় আর অনেক তপস্যায় তবে মানুষ। আমি কি সেই মানুষই হতে পেরেছি?’
মানুষ হতে পেরেছিলেন কিনা, নিজের কাছে সে প্রশ্ন রেখেছিলেন বিমল মিত্র। কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যে একজন পথিকৃৎ ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলার বাইরে বিভিন্ন প্রদেশে বাঙালি সাহিত্যিক হিসাবে তিনি আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
তার লেখা অসংখ্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থসমূহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্র, মঞ্চ-নাটক ও যাত্রায় সফলভাবে রূপায়িত হয়েছে তাঁর একাধিক উপন্যাস । কাহিনির ঠাস বুননে আর সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা বাস্তব চমকপ্রদ চরিত্রগুলির দুর্নিবার আকর্ষণ সিনেমা ও নাটকের বিদগ্ধ দর্শককূলকে বিমোহিত করেছে দিনের পর দিন।
বিমল মিত্র রচিত চলচ্চিত্রায়িত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি - 'সাহেব বিবি গোলাম’ ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ‘স্ত্রী’ ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’ । আবার কলকাতার রঙমঞ্চগুলিতে সগৌরবে অভিনীত হয়েছে ‘একক দশক শতক’ ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ এবং সুবৃহৎ উপন্যাস ‘আসামী হাজির’-এর নাট্যরূপ।
বাংলার আধুনিক মানস রূপান্তরের চিত্রকল্প এই উপন্যাসগুলি লেখকের নিজস্ব ঘরানার স্বাতন্ত্র্য চিনিয়ে দিয়েছে। আবার কিছু উপন্যাস যেমন ‘নিবেদন ইতি’, ‘প্ররস্ত্রী’, ‘স্ত্রী জাতক’, ‘বেনারসী’ ‘চলো কলকাতা’ ইত্যাদি কোনভাবে বেষ্ট সেলার না হলেও তাঁর লেখনী শৈলীতে রসোত্তীর্ন হতে পেরেছে। নিজস্ব ঘরানায় কিশোর সাহিত্যেও তার অবাধ বিচরণ ছিল।
তার বিখ্যাত কালোত্তীর্ণ উপন্যাস ‘সাহেব বিবি গোলাম’। পরাধীন সমাজ ব্যবস্থা এবং সরল গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে শহুরে কৃত্রিমতার তারতম্য এই উপন্যাসটিতে তিনি নিপুণভাবে গ্রন্থিত করেছেন। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কয়েক কিস্তি প্রকাশের পরপরই নিন্দুকেরা অপপ্রচার, কুৎসাভরা চিঠি পাঠানো শুরু করে। এমন কি তিনি প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছিলেন। তার রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
১৭৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের সময়কাল নিয়ে তার লেখা পাঁচটি ভিন্ন কাহিনির উপন্যাস যথাক্রমে ‘বেগম মেরি বিশ্বাস’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’ আর ‘চলো কলকাতা’। কথায় কথায় জেনে ফেলার আগ্রহজাগানিয়া কলকাতার ইতিহাস। বিমল মিত্রের লেখার অনুরাগীরা বলে থাকেন, বাংলায় আর কোনও বই না পড়লেও প্রত্যেক বাঙালির এই কয়েকটা বই অবশ্যই পড়ে রাখা উচিত।
মানুষ হিসাবে বিমল মিত্র ছিলেন নিরহংকারী, পরোপকারী এবং অত্যধিক সাহসী । অহংকারশূন্য ছিলেন বলে মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারতেন। তেমনি আজও জনমনে মিশে আছে তার অনন্য সৃজনসম্ভান। কীর্তিমান এই কথাশিল্পীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি
এই বিভাগের আরো সংবাদ